সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩২ পূর্বাহ্ন
আকতার ফারুক শাহিন॥ বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় করোনা থেকে সুস্থ হওয়া মানুষের মাত্র ১৮ ভাগ হাসপাতালের সেবা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। বাকি ৮২ ভাগই করোনাকে জয় করেছেন ঘরে থেকে নিজস্ব চেষ্টায়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে টেলিফোনসহ বিভিন্ন উপায়ে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়েছেন তারা।
স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এখানে মোট আক্রান্তের ৪৭ ভাগই ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে গেছেন। তাছাড়া বিভাগের ৬ জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১শ’ জনে মারা যাচ্ছেন প্রায় ২ জন। ফলে করোনা নিয়ে সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এখানকার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
এ দিকে রেড জোন ঘোষিত বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে পাইলটিং হিসেবে ২টি ওয়ার্ড লকডাউন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। বৃহস্পতিবার রাতে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। তবে কবে থেকে এই লকডাউন শুরু হবে সে ব্যাপারে অবশ্য স্পষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি।
বরিশালের বিভাগীয় স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, শুক্রবার পর্যন্ত বরিশালসহ বিভাগের অপর ৫ জেলা যথাক্রমে বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ঝালকাঠিতে মোট ১ হাজার ৮৭৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্য থেকে সুস্থ হয়েছেন ৪৯৩ জন। যা মোট আক্রান্তের ৪৭ শতাংশ।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার দাসের মতে, ‘দিনে দিনে মানুষ চেষ্টা করছে করোনাকে প্রতিরোধ করে চলার। আর এ কারণেই সামাজিকভাবে পরস্পরকে সচেতন করছে সবাই। এতে করে সুস্থতার হার বাড়ছে। এই হার আশাব্যঞ্জক।’
বরিশালের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘এখানে পুরুষের চেয়ে নারীর সংক্রমণের সংখ্যা অনেক কম। কারণ নারীরা ঘর থেকে কম বের হন। বাইরের মানুষের সংস্পর্শে কম আসেন বিধায় তারা আক্রান্তও কম হচ্ছেন।
হিসাব বলছে, বরিশাল বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করোনা শনাক্ত হয়েছে বরিশাল জেলায়। এই সংখ্যা ১ হাজার ৯০ জন। এরমধ্যে ৭২৭ জন পুরুষ এবং ৩৬৩ জন নারী। অর্থাৎ এখানে নারীর তুলনায় পুরুষের আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় তিন গুণ।
আক্রান্তের বয়স হিসাবে আবার ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। কারণ বহু চেষ্টা করেও এই বয়সের মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যায়নি। তাছাড়া জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে যারা ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হয় তাদের বয়সও মূলত ২১ থেকে ৪০’র মধ্যেই।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে জেলাওয়ারী হিসাবে বরিশালে ১ হাজার ৯০, পটুয়াখালীতে ২২২, ভোলায় ১৭৬, পিরোজপুরে ১৩৩, বরগুনায় ১৪৬ ও ঝালকাঠিতে ১১১ জনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে আবার প্রায় অর্ধেক শনাক্ত হয়েছে বরিশাল নগরীতে। এই সংখ্যা ৮৬০।
পুরো বিভাগে মারা যাওয়া ৩৫ জনের মধ্যে বরিশাল মহানগরে মারা গেছে ৮ জন। অর্থাৎ মোট মৃত্যুর প্রায় এক-চতুর্থাংশ বরিশাল নগরে। জেলাওয়ারী হিসাবে বরিশাল জেলায় মারা গেছে ১৪ জন, পটুয়াখালীতে ১০, ঝালকাঠিতে ৪, পিরোজপুরে ৩, ভোলায় ২ এবং বরগুনায় ২ জন। পুরো বিভাগে মোট আক্রান্তের হিসাবে মৃত্যুর এই হার ১.৯ শতাংশ।
শুরু থেকে এ পর্যন্ত যে সব তথ্য-উপাত্ত স্বাস্থ্য বিভাগ এবং বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পাওয়া গেছে তার বিশ্লেষণে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা অর্থাৎ হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নেয়া করোনা রোগীদের তুলনায় নিজের বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেয়া রোগীরা অনেক বেশি সুস্থ হয়েছেন। শতকরা হিসাবে এই সংখ্যা ৮২ ভাগ।
শুক্রবার বরিশাল শেবাচিম হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ১৭ মার্চ থেকে গতকাল পর্যন্ত এই হাসপাতালে করোনা শনাক্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন মোট ১৭০ জন। এদের মধ্যে ২১ জন মারা গেছেন। শুক্রবার এই হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৯২ জন। অথচ একই সময়ে পুরো বিভাগে করোনা শনাক্তের মোট সংখ্যা ১ হাজার ৮৭৮ জন।
এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, পুরো বিভাগে একমাত্র এই হাসপাতালেই করোনা রোগীদের জন্য রয়েছে ডেডিকেটেড করোনা ইউনিট। তাছাড়া বিভাগের ৮৬ লাখ মানুষের মধ্যে করোনা শনাক্তদের জন্য যে ১৮টি আইসিইউ বেড রয়েছে সেই বেডগুলোও রয়েছে এই শেবাচিম হাসপাতালে।
শতকরা ৮২ ভাগ করোনা রোগীর বাড়িতে থেকে সুস্থ হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার বলেন, করোনা পজিটিভ অথচ খুব বেশি অসুস্থ নয় এমন রোগীদেরকে তো আমরাই বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দেই। শ্বাসকষ্ট না থাকলে হাসপাতালে যেতে নিষেধ করা হয় সবাইকে। তাছাড়া মৃদু উপসর্গ যে সব রোগীর রয়েছে তারা হাসপাতালে না এলেও চলে।
কেবল শেবাচিম হাসপাতাল নয়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা হাসপাতালগুলোতেও করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা ঠিক যে আক্রান্তের খুব সামান্য একটা অংশ হাসপাতালে আসে চিকিৎসার জন্য। তবে বাড়িতে থেকে যারা চিকিৎসা নেয় তাদেরকেও মোবাইলে কিংবা টেলিফোনে সবরকম পরামর্শ দেন আমাদের চিকিৎসকরা।
করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে বিদেশি নাগরিকসহ ভিন্ন জেলা (সংক্রমিত) থেকে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে রাখার কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে। গত ১০ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত বরিশাল সিটি কর্পোরেশনসহ বিভাগের ৬ জেলায় মোট ১৮ হাজার ৭৯১ জনকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছিল। যার মধ্যে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয় ১৬ হাজার ৯৪৫ জনকে। এদের ১৪ হাজার ২০৫ জন হোম কোয়ারেন্টিন থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন।
এ ছাড়া বর্তমানে বিভাগের বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে (প্রাতিষ্ঠানিক) কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন ১ হাজার ৮৪৬ জন এবং ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে ১ হাজার ১০৭ জনকে। শেবাচিম হাসপাতালসহ বিভাগের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে আইসোলেশনে চিকিৎসাপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৭০ জন এবং এরই মধ্যে ৫৩৫ জনকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া বিভাগের সবচেয়ে বড় রেড জোন বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এলাকার দুটি ওয়ার্ড পাইলট প্রকল্প হিসাবে লকডাউন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। ওয়ার্ড দুটি হল ১২ ও ২৪। কিন্তু কবে নাগাদ ওয়ার্ড দুটিতে লকডাউন কার্যকর করা হবে তা জানানো হয়নি।
প্রথম দফায় এই ওয়ার্ড দুটিতে লকডাউন কার্যকর করে তার অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তী ওয়ার্ডগুলো লকডাউন এবং করোনার প্রাদুর্ভাব কমিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা।
প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেয়া ম্যাপ অনুযায়ী, বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এলাকার ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৭টিকেই রোড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলায় ২টি উপজেলা এবং একটি পৌরসভাকে রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
Leave a Reply