শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:৪৩ অপরাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক:ফেনীর সোনাগাজীতে দুর্বৃত্তদের আগুনে দগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি ‘ডাইং ডিক্লারেশন’ (মৃত্যুশয্যায় দেওয়া বক্তব্য) দিয়েছেন।রোববার (৭ এপ্রিল) তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, নেকাব, বোরকা ও হাতমোজা পরিহিত চারজন ওড়না দিয়ে হাত বেঁধে তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। ওই চারজনের একজনের নাম ছিল শম্পা। আগুনে ওড়না পুড়ে গেলে তার হাত মুক্ত হয়।ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট সূত্র তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে ওই ছাত্রী একজন চিকিৎসকের কাছে বক্তব্য দেন। মুমূর্ষু রোগীদের কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য নেওয়া হয়ে থাকে, যা পরবর্তী সময়ে আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ছাত্রীকে উদ্ধৃত করে সূত্রটি জানাচ্ছে, কয়েক বছর ধরে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি করে আসছেন। তিনি পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র দিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখাতেন। তাঁর কথায় রাজি না হলে তিনি হেনস্থা করতেন। আগে এ বিষয়ে পরিবারকে না জানালেও গত ২৭ মার্চ তাঁর সঙ্গে অধ্যক্ষ অশোভন আচরণ করেন। বিষয়টি ওই শিক্ষার্থী পরিবারকে জানান, মাদ্রাসার অন্য শিক্ষার্থীদেরও জানান। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর থেকে তিনি ভাইয়ের সঙ্গে মাদ্রাসায় যাচ্ছিলেন। ঘটনার দিন তাঁর ভাইকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
ওই ছাত্রী বলেন, কেন্দ্রে ঢোকার পর একটা সময় তাঁকে ছাদে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি নেকাব, বোরকা, হাতমোজা পরিহিত চারজনকে দেখতে পান। তাঁদের মধ্যে মূলত কথা বলছিলেন একজন। তিনি মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বলেন এবং অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ অসত্য এ কথা বলতে চাপ দেন। মাদ্রাসাছাত্রী এতে অস্বীকৃতি জানালে ওই চারজন ওড়না দিয়ে তাঁর হাত বেঁধে ফেলেন। তাঁর গায়ে ওঁরা কিছু একটা ছুড়ে দেন। তারপর বলেন, যা এবার পালা। গায়ে আগুন লাগা অবস্থাতেই তিনি দৌঁড়ে পালান।
চারজনের কেউ কারও নাম উচ্চারণ না করলেও কোনো একপর্যায়ে একজন শম্পা বলে একজনকে ডাকেন। তিনি যে কণ্ঠ শুনেছেন, তা নারীকণ্ঠ। তবে মুখ ঢাকা থাকায় কাউকে চিনতে পারেননি বলে জানিয়েছেন।অগ্নিদগ্ধ ওই ছাত্রী বলেন, ওড়নাটা ছাই হয়ে যাওয়ার পর হাতের বাঁধন খুলে যায়।সোমবার (৮ এপ্রিল) সকালে নুসরাত জাহান রাফিকে ‘লাইফ সাপোর্টে’ নেওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা সংকটাপন্ন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।এদিকে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় বোরকা পরা চার নারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন সাতজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ঘটনার দিন থেকে শুরু করে সোমবার পর্যন্ত থানা-পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে এই সাতজনকে আটক করেছে। তবে এঁদের মধ্যে আফছার উদ্দিন ও আরিফুল ইসলামকে আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন বলেন, সকালে তার অবস্থা পর্যবেক্ষণের পর অস্ত্রোপচারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা দেখেন, তার অবস্থা ভালো নয়। তখনই তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।রাতে তিনি জানান,নুসরাত জাহানের ব্যাপারে পাঠানো চিঠির উত্তরে আরও তথ্য চেয়েছে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ফেনীর পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, ঘটনার তথ্য-প্রমাণ ও বোরকাপড়া চার তরুণীকে শনাক্তের জন্য এখন একজনকে প্রয়োজন, যে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়েছিল। পুলিশ তাকেই হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করা সম্ভব হবে। যত প্রভাবশালীই হোক, কেউ পার পাবে না।গত শনিবার সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে যায় ওই ছাত্রী। এরপর কৌশলে তাকে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে ৪/৫ জন বোরকা পরিহিত ব্যক্তি ওই ছাত্রীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করে তার স্বজনরা প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠান। সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়।রোববার তার চিকিৎসায় ৯ সদস্যের বোর্ড গঠন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরীক্ষা কেন্দ্রে ছাত্রীর ওপর এমন নির্মমতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সার্বিক চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেছেন। পাশাপাশি জড়িতদের গ্রেফতারেরও নির্দেশ দিয়েছেন। সন্ধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নুসরাতকে দেখতে যান।
এর আগে গত ২৭ এপ্রিল ওই ছাত্রীকে নিজ কক্ষে নিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাকে আটক করে পুলিশ। ওই ঘটনার পর থেকে তিনি কারাগারে। এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন।এদিকে এ ঘটনায় রোববার থেকে আগামী ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মাদ্রাসার স্বাভাবিক কার্যক্রম ও অনির্দিষ্টকালের জন্য হোস্টেল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।ওই ছাত্রীর স্বজনরা বলেন, ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলা নুসরাতকে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে শ্নীলতাহানি করেন। ওই ঘটনায় থানায় মামলা করেন তার মা। ওই মামলায় অধ্যক্ষ কারাগারে রয়েছেন। মামলা তুলে নিতে অধ্যক্ষের লোকজন হুমকি দিয়ে আসছিল বারবার। আলিম পরীক্ষা চললেও আতঙ্কে স্বজনরা পরীক্ষা কেন্দ্রের কক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন। মামলা তুলে না নেওয়াতেই ক্ষিপ্ত হয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয় নুসরাতকে।
Leave a Reply