শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৮ অপরাহ্ন
এম. কে. রানা :
জেলা পরিষদ নিয়ন্ত্রিত বরিশালের দুটি খেয়াঘাটে ভাড়া আদায়ের নামে চলছে চাঁদাবাজী। মিরগঞ্জ খেয়া ঘাটের ইজারাদার আসাদুজ্জামান মিলন ও রাজগুরু খেয়া ঘাটের ইজারাদার রসুল জোমাদ্দারের রক্তচোষা ভাড়ায় অতিষ্ট চার উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ। দরপত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রতিবন্ধিদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়সহ তালিকার থেকেও ১০ গুন পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। খোদ জেলা পরিষদ সদস্যরাই এর প্রতিবাদ করলেও তাতে কর্নপাত করছেননা চেয়ারম্যান মইদুল ইসলাম। অভিযোগ রয়েছে তার মদদেই ইজারাদাররা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের মাধ্যমে প্রতি মাসে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। এতে করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে দাবী ভুক্তভোগীদের।
জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, বাংলা ১৪২৫ সালের জন্য বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার মিরগঞ্জ ও রাজগুরু খেয়াঘাট ইজারা দেয়া হয়েছে। দরপত্রের ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী রাজগুরু খেয়াঘাটের টোল নির্ধারন করা হয়েছে মানুষ জনপ্রতি ৩ টাকা, চালকসহ সাইকেল ৫ টাকা, চালকসহ মটর সাইকেল ১২ টাকা, রিক্সা-ভ্যান ১০ টাকা, গরু-মহিষ ১০ টাকা, ১৫ কেজির উপরে মালামাল কেজি প্রতি ২০ পয়সা, আসবাবপত্র ১২ টাকা ও বস্তা ৭ টাকা।
অন্যদিকে এ অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন মিরগঞ্জ খেয়াঘাটে টোল নির্ধারন করা হয়েছে মানুষ জনপ্রতি ৬ টাকা, চালকসহ সাইকেল ৭ টাকা, চালকসহ মটর সাইকেল ১৬ টাকা, রিক্সা-ভ্যান ১২ টাকা, গরু-মহিষ ২০ টাকা, ১৫ কেজির উপরে মালামাল কেজি প্রতি ৩০ পয়সা আসবাবপত্র ১৫ টাকা ও বস্তা ৮ টাকা। এই তালিকা সম্বলিত সাইনবোর্ড দুটি খেয়াঘাটের প্রবেশদ্বারে থাকলেও তা মানছেনা ইজারাদাররা। বরং তারা মুল্য তালিকার দ্বিগুন থেকে ১০ গুন পর্যন্ত ভাড়া আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরগঞ্জ খেয়াঘাটে মানুষ জনপ্রতি ১০ টাকা, চালকসহ সাইকেল ২০ টাকা, চালকসহ মটর সাইকেল ৩০ টাকা, রিক্সা-ভ্যান ২০০ টাকা, গরু-মহিষ ২০০ টাকা, ওষুধের কার্টন ১০০ থেকে ১৫০ টাকা ও আসবাবপত্র বাবদ ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আদায় করছে।
অন্যদিকে রাজগুরু খেয়াঘাটে মানুষ জনপ্রতি ৫ টাকা, চালকসহ সাইকেল ১০ টাকা, চালকসহ মটর সাইকেল ৩০ টাকা, রিক্সা-ভ্যান ২০০ টাকা, গরু-মহিষ ২০০ টাকা, ওষুধের কার্টন ১০০ থেকে ১৫০ টাকা ও আসবাবপত্র বাবদ ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আদায় করা হয়। তবে এখানেই ক্ষ্যান্ত হয়নি ইজারাদাররা। তারা আরো লাভের আশায় তাদের নির্ধারিত ট্রলার ছাড়াও রিজার্ভ ট্রলারের ব্যবস্থা করেছেন।
এই দুই ঘাটের যাত্রীরা জানিয়েছেন, ঘাটে যত টাকা টোল রাখা হয় ঠিক তত টাকাই আবার রিজার্ভ ট্রলারে দিতে হয়। ঐ টাকার একটা অংশ ইজারাদার পায় বলে দাবী তাদের। আর এই কারনেই ইজারাদারদের নির্ধারিত দুটি ট্রলার সময়ক্ষেপন করে ঘাট ছাড়ে। ফলে সময় বাঁচাতে যাত্রীরা দুইবার ভাড়া দিয়ে রিজার্ভ ট্রলারে পার হয়। এছাড়া সরকারী, আধাসরকারী, স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থী ও প্রতিবন্ধিদের বিনা ভাড়ায় পারাপার করানোর শর্ত দরপত্রে থাকলেও মানছেনা ইজারাদার। তাদেরও অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই নদী পার হতে হচ্ছে। কেউ যদি তা দিতে রাজি না হয় তাদের ঘাট পরিচালনাকারীদের দ্বারা শুধু অকথ্য গালিগালাজই নয় মাঝেমধ্যে লাঞ্ছিতও হতে হয়।
জানা গেছে, বাবুগঞ্জের কেদারপুর ইউনিয়নের ৯ টি ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের বাবুগঞ্জ ও বরিশালের সাথে চলাচলের প্রধান মাধ্যম হলো রাজগুরু খেয়া। অন্যদিকে মুলাদী, হিজলা, কাজিরহাট ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার একাংশের মানুষদের বরিশালের সাথে চলাচলের একমাত্র পথ হলো মিরগঞ্জ খেয়া। এ অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষতো বটেই ৩০ থেকে ৪০ টি সরকারী ও আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানের কয়েকশত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রতিদিন অন্তত দুইবার এই খেয়া পার হতে হয়। এসকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফ্রি পারাপারতো দূরের কথা অনেক সময় ভাড়ার জন্য নানাভাবে নাজেহাল ও লাঞ্ছিত করা হয়। চাকুরীর স্বার্থে তাদের এসব উপেক্ষা করেই প্রতিদিন পার হতে হয় বলে জানা গেছে। মুলাদীতে কর্মরত সরকারী ব্যাংক কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, চাকুরীর সুবাদে তাকে প্রতিদিন মিরগঞ্জ খেয়া কমপক্ষে দুইবার পার হতে হয়। সরকারী কর্মকর্তা হওয়া সত্তেও তাকে প্রতিদিন ৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে মটর সাইকেল পার করতে হয়। কখনই প্রতিবাদ করে কোন শুরহা হয়নি দাবী করে জানান, হয়েছে বরং উল্টো। ব্যাংকের একটি কম্পিউটার মনিটর বরিশাল থেকে মেরামত করিয়ে নিতে মিরগঞ্জ ট্রলার পারাপারে ২০০ টাকা করে দিতে হয়েছে। সরকারী প্রতিষ্ঠানের মালামাল বলতেই ঘাট পরিচালনাকারীরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে বলে জানান আনোয়ার হোসেন। তিনি আরো জানান শুধু সরকারী-আধাসরকারীই নয় এ অঞ্চলের কয়েকশ’ স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীসহ প্রতিবন্ধিদেরও অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই নদী পার হতে হয়। এরকম চলতে থাকলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নহবে বলে মনে করেন তিনি।
এই দুটি খেয়ায় নিয়মিত যাতায়াতকারী হেলাল উদ্দিন নামের এক যাত্রী জানান, ইজারাদাররা প্রতিদিনের কয়েক হাজার যাত্রী পারাপারের জন্য মাত্র দুটি ট্রলার বরাদ্দ রেখেছে। কিন্তু তা আবার সময়ক্ষেপন করে চালানো হয়। যাতে করে যাত্রীরা তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত রিজার্ভ ট্রলারে দ্বিগুন ভাড়া দিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তাছাড়া সন্ধ্যা হলেই ইজারাদারদের নির্ধারিত ট্রলার বন্ধ করে শুধুমাত্র রিজার্ভ ট্রলার চালানো হয়। ইজারাদারদের এই দূর্নীতি আর অনিয়মের পিছনে খোদ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের মদদ রয়েছে বলে দাবী করেন এ যাত্রী। তাকে ম্যানেজ না করলে কোন ভাবেই প্রকাশ্যে ভাড়ার নামে এই চাঁদাবাজী করতে পারতোনা। এ দাবী অনেকটা স্পষ্ট জেলা পরিষদের কর্মকান্ডেও। গতবছরও মিরগঞ্জ খেয়ার ইজারা পান আসাদুজ্জামান মিলন। তখনও তিনি এভাবেই রক্তচোষা ভাড়া আদায় করেন। তারপরও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে আবারো তাকে ইজারা দেয়া হয়। প্রকাশ্যে এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়কে তিনি চাঁদাবাজীর সাথে তুলনা করেন। মিরগঞ্জ ও রাজগুরু খেয়া ঘাটে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ড (বাবুগঞ্জ) সদস্য ফারজানা ওহাবসহ একাধিক সদস্য একাধিকবার পরিষদের চেয়ারম্যান মইদুল ইসলামকে জানালেও তিনি কোন পদক্ষেপ নেননি বলে জানা গেছে। বরং তিনি বিষয়টি হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে ফারজানা ওহাব বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার বিষয়টি আমি এবং জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাতে নাতে ধরেছি। এরপর এ নিয়ে জেলা পরিষদের মাসিক সভায় আলোচনা হয়েছে। পরবর্তীতে ইজারাদারদের অফিসিয়াললি লিখিত নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। তবুও বন্ধ হচ্ছেনা যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়। রিজার্ভ ট্রলার প্রসংঙ্গে বলেন, দরপত্রের শর্তানুযায়ী ইজারাদারদের নিজস্ব ব্যতিত আর কোন ট্রলার ঘাটে পারাপারের সুযোগ নেই। কিন্তু অজ্ঞাত কারনে পরিষদের প্রশাসন তা না দেখার ভান করছেন বলে দাবী করেন তিনি।
অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার কথা স্বীকার করে রাজগুরু খেয়া ঘাটের ইজারাদার রসুল জোমাদ্দার বলেন, ইজারা নিয়েছি শুধু ঘাটের। ট্রলারেরতো আর নেই নাই। তাই ঘাটে প্রবেশ ও ট্রলার ভাড়া দুটোই যাত্রীদের দিতে হয়। তাছাড়া এর আগে ঘাট নিয়েছি ১০ লাখ টাকায়, আর এবার ঘাট নিয়েছি ১৭ লাখ টাকায়। এর সাথে অফিস খরচতো আছেই। তাই অতিরিক্ত টাকা উঠাতেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয় বলে দাবী করেন তিনি।
অন্যদিকে মিরগঞ্জ খেয়া ঘাটের ইজারাদার আসাদুজ্জামান মিলন অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কথা অকপটে স্বীকার করে বলেন, জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে যে ভাড়া নির্ধারন করা হয়েছে তা নৌকায় পারাপারের জন্য। আর আমি পারাপার করছি ট্রলারে। তাই বেশী ভাড়াতো নেবই। তিনি আর কিছু বলতে অপারগতা স্বীকার করেন। জানা গেছে, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মইদুল ইসলামের সাথে বিশেষ সখ্যতা থাকায় অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া সত্তেও এই নিয়ে টানা দ্বিতীয়বারে মতো মিরগঞ্জ ঘাট ইজারা পেলেন আওয়ামীলীগ নেতা আসাদুজ্জামান মিলন। চেয়ারম্যান মইদুল ইসলাম ইজারাদারদের কাছ থেকে বিশেষ কোন সুবিধা পাচ্ছেন বলেই ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করেও বীরদর্পে তারা টিকে আছেন বলে দাবী করেন ঘাট দুটিতে নিয়মিত পারাপারকারী একাধীক স্থানীয় যাত্রী।
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মানিক হার রহমান বলেন, দরপত্রে উল্লেখিত ভাড়ার বাইরে কোন টাকা নেয়ার অধিকার ইজারাদারদের নেই। তাতে তারা যে বাহনেই যাত্রী পারপার করুক না কেন। অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার প্রমান আমরাও পেয়েছি। এ নিয়ে পরিষদের মাসিক সভায় আলোচনা হয়েছে। ইতোমধ্যেই ইজারাদারদের শোকজ করা হয়েছে। তবে তারা কোন জবাব দেননি। তাই দরপত্র বাতিলের ব্যবস্থা গ্রহনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাছাড়া শিগ্রই জেল জরিমানার মতো শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে জানান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
জেলা পরিষদের সাথে ইজারাদারদের কোন অনৈতিক সম্পর্ক নাই দাবী করে চেয়ারম্যান মইদুল ইসলাম তাদের পক্ষ নিয়ে বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার অভিযোগ আমিও পেয়েছি। তবে লিখিত অভিযোগ না পেলে আমার কিছু করার নেই। ইজারাদাররা ভাড়ার রশিদ দেননা, তাই অভিযোগ প্রমান করা কঠিন। তবে তারা অনিয়মের উদ্দেশ্যেই ঘাট সংলগ্ন জেলা পরিষদের টানানো ভাড়ার তালিকা ছিড়ে ফেলেছে বলে স্বীকার করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ঘাট পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তিনি অনিয়ম পেয়েছেন। আমরা ইজারাদারদের শোকজ নোটিশ করেছিলাম। তারা জবাব দেয়নি। এখন পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
Leave a Reply