রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৬ পূর্বাহ্ন
লালমোহন প্রতিনিধি॥ গরমে শান্তির পরশ পেতে শীতল পাটির জুড়ি মেলা ভার। তীব্র গরমে তাই কদর বেড়েছে দ্বীপজেলা ভোলার লালমোহনের ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটির। এ কারণে শীতল পাটির বিক্রি বর্তমান মৌসুমে যেমন বেড়ে গেছে, তেমনই পাটি তৈরির কারিগরদের ব্যস্ততাও বেড়েছে কয়েক গুণে।
উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামেই আট বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধরা ব্যস্ত সময় পার করছেন শীতল পাটি বোনার কাজে।
পাটিশিল্পের কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বহুকাল ধরেই রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে লালমোহনের শীতল পাটি সমাদৃত হয়ে আসছে। এখানকার চিকনবেতির শীতল পাটির চাহিদাও প্রচুর। এ অঞ্চলে অতিথিদের সামনে একটি ভাল মানের শীতল পাটি বিছিয়ে নিজেদের আভিজাত্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম পাটিশিল্প। তীব্র তাপেও খুব গরম হয় না বলেই এই পাটিকে শীতল পাটি বলা হয়।
পাইত্রাবা মোর্তানামে এক ধরণের বর্ষজীবী উদ্ভিদের কান্ড থেকে বেতি তৈরি করা হয়। পরিপক্ক পাটিগাছ কেটে পানিতে ভিজিয়ে তার পর পাটির বেতি তোলা হয়। এরপর ভাতের মাড় ও পানি মিশিয়ে বেতি জ্বাল দেয়া হয়। এর ফলে বেতি হয়ে ওঠে মসৃণ ও সাদাটে। বেতির উপরের খোলস থেকে শীতল পাটি পরের অংশ তুলে বুকারপাটি এবং অবশিষ্ট অংশ চিকন দড়ি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়।
বর্তমানে লালমোহন উপজেলায় প্রায় তিনশ’রও বেশি পরিবার এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। চরভূতা ইউনিয়নের নম গ্রামে রয়েছে প্রায় দুই-তিন শ’র বেশি পরিবার। এরা সবাই পাটি বুনে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ গ্রামের শতশত হেক্টর জমি জুড়ে রয়েছে বিশাল নজর কাড়া হোগলাপাতা ও পাটি গাছের বাগান। এখানে শীতল পাটি, নামাজের পাটি ও আসন পাটি নামে তিন ধরনের পাটি তৈরি করা হয়। পাটির বুনন পদ্ধতি প্রধানত দুই ধরনের।
প্রথমত, পাটির জমিনে ‘জো’ তুলে তাতে রঙিন বেতি দিয়ে নকশা তুলে। পরে পাটির জমিন তৈরি হলে তার চারপাশে অন্য রঙের বেতি দিয়ে মুড়ে দিয়ে। পারিবারিক ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাটি কারিগরদের পেশা এগিয়ে চলছে। শৈল্পিক উপস্থাপনা এবং নির্মাণ কুশলতার কারণে দক্ষ ও সুনিপুন একজন পাটি কারিগরের কদরও রয়েছে সর্বত্র। একটি পাটি বুনতে তিন-চারজনের দুই-তিনদিন সময় লাগে।
একটি পাটি পাঁচ শ’ থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হয়। মহাজনরা প্রতি পাটিতে এক শ’ থেকে পাঁচ শ’ টাকা লাভ করেন। পাইত্রাবা চাষ ও কেনার জন্য প্রচুর মূলধন প্রয়োজন হয়। এই জন্য পাটিশিল্পের কারিগরদের মূলধনের জন্য মহাজন ও এনজিওদের কাছে হাত পাততে বাধ্য হন। ফলে শিল্পের সাথে জড়িতদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হচ্ছে না। শীতল পাটি শিল্পীর জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা না থাকায়ও পুঁজির জন্য কারিগররা দাদনব্যবসায়ী, সুদখোর মহাজনদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকেন।
বিদেশে বিপুল চাহিদা সত্ত্বেও এখনো রপ্তানিযোগ্য পণ্যের স্বীকৃতি পায়নি শীতল পাটি। নম গ্রামের রীতা রানী, সুমিত্রা রানী ও দাধব চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমাদের তৈরি শীতল পাটি দেশ বিদেশে সমাদৃত। দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। শীতল পাটির আয় অনেক বেশি হলেও পরিশ্রমও বেশি। শুধু শীতল পাটি বিক্রি করেই সংসারের খরচ ও ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া চালাই। তবে শীত মৌসুমে ও বর্ষার সময় আর্থিক সংকটে ভুগতে হয়। সরকার যদি বিনা সুদে ঋণ দিতো, তাহলে বেশি পরিমাণে পাইত্রাবা কিনে শীতল পাটি তৈরি করা সম্ভব হতো।’
স্থানীয় দিলীপ চন্দ্র দাস (পাটি কারিগর) বলেন, ‘গরমে একটু প্রশান্তির জন্য যুগযুগ ধরে দেশের মানুষ শীতলপাটি ব্যবহার করে আসছে। সরকারের নিকট এ গ্রামেরপাটিশিল্পীদের সরকারিভাবে কৃষিব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ সহায়তার আবেদন জানাই।’
লালমোহনের কলেজ শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম ও স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিন বলেন, শীতল পাটির চাহিদা দেশজুড়েই বিখ্যাত এবং শীতল পাটি তীব্র গরমে শান্তির পরশ জোগায় । এ শীতল পাটির চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বছরের একটি সময় তাদের বসে থাকতে হচ্ছে। স্থানীয় সচেতন মহলের প্রানের দাবী সরকার যেন অতি দরিদ্র কারিগরদের সঠিক তালিকার মাধ্যমে ঋণের ব্যবস্থা করেন।
Leave a Reply