সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৪ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিনিধি॥ মিথ্যা অভিযাগে দায়ের করা মামলা ও তদন্ত কর্মকর্তার পক্ষপাতিত্ব থেকে পরিত্রাণ পেতে মামলার সুষ্ঠ তদন্ত চেয়ে বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি’র কাছে আবেদন করে বেকায়দায় পড়েছেন এক সংবাদকর্মী। এমনকি ডিআইজির কাছে আবেদন হয়েছে এমন তথ্য জানতে পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই পুলিশ সদস্য মনগড়া তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিবেদন গ্রহণ করে অভিযুক্ত সংবাদকর্মীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে গড়মিলের বিষয়ে জানতে চাইলে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি ওই তদন্ত কর্মকর্তা। শেষে ওসিকে দিয়ে প্রতিবেদককে ‘ধমকি’ দেওয়ান। ঘটনাটি ঘটেছে ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থানায়।
জানা গেছে, দৈনিক কালবেলা পত্রিকার বরিশাল ব্যুরো প্রধান এবং দি বাংলাদেশ টুডে পত্রিকার ফটো সাংবাদিক খান মাইনউদ্দিন। তার গ্রামের বাড়ি উত্তর জুরকাঠির আজিজিয়া দাখিল মাদ্রাসায় একজন পরিছন্নতাকর্মী কাম দপ্তরী নিয়োগ প্রদানে ঘুষ আদান-প্রদানের বিষয়ে মাদ্রাসা সুপারের কাছে জানতে চাইলে ক্ষুব্ধ হন মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় সংবাদ প্রকাশ বন্ধ করতে সাংবাদিক খান মাইনউদ্দিনের বিরুদ্ধে ৮ সেপ্টেম্বর ঝালকাঠি সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতে নালিশি মামলা দায়ের করেন ‘ঘুষ দিয়ে চাকরী নেওয়া’ দফতরী মানিক বেপারী। নালিশি তদন্তে সংশ্লিষ্ট থানাকে নির্দেশ দিলে তদন্তভার পান এএসআই নজরুল। তিনি তদন্তে গিয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সাথে যোগসাজশ করে শুধু বাদী পক্ষের লোকদের বক্তব্য গ্রহণ করেন। খবর পেয়ে স্থানীয়রা তদন্তস্থলে গেলে তাদের মাদরাসা থেকে বের করে দেন এএসআই নজরুল।
একই সাথে প্রকাশ্যে মাদরাসার ম্যানেজিং কমিটির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন, বাদীর মনমত প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
এই খবর জানতে পেরে ২ অক্টোবর বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজির কাছে সুষ্ঠ তদন্ত প্রার্থনা করে আবেদন করেন খান মাইনউদ্দিন। আবেদনটি খতিয়ে দেখতে ঝালকাঠি পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন রেঞ্জ ডিআইজি মোঃ শফিকুল ইসলাম। খান মাইনউদ্দিনের আবেদন বর্তমানে তদন্ত করছেন পুলিশ সুপার।
ওদিকে রেঞ্জ ডিআইজির কাছে আবেদন হয়েছে এমন তথ্য জানতে পেরে খান মাইনউদ্দিনকে বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের জিরো পয়েন্টে ডেকে নেন এএসআই নজরুল ইসলাম। মুৃঠোফোনে খান মাইনউদ্দিন জানান, ডেকে নিয়ে এএসআই নজরুল খুবই খারাপ ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, তোর বিরুদ্ধে মামলা হইছে তুই থানায় যাবি। আমি তদন্ত করছি-আমার সাথে সমঝোতা করবি। কিন্তু তুই ডিআইজির কাছে আমার বিরুদ্ধে আবেদন করেছ। দেখি এখন ডিআইজি কেমনে বাচায়। মাইনউদ্দিন বলেন, তখনই তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে আমার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করবেন বলে হুমকি দিয়ে যান। অপর এক প্রশ্নের জবাবে মাইনউদ্দিন বলেন, শুধু হুমকি দিয়ে চলে যান। কিন্তু কোন টাকা-পয়সা দাবী করেননি।
এএসআই নজরুল ৪ অক্টোবর এই হুমকি দেন বলেও জানান মাইনউদ্দিন। নজরুলের হুমকির শিকার এই সাংবাদিক বলেন, আমি ডিআইজি স্যারের কাছে আবেদন করেছি যেন সঠিক তদন্ত হয় সেকারনে। কিন্তু আবেদন করায় যে ক্ষুব্ধ হবেন নজরুল তা বুঝিনি।
এরপরপরই তরিঘরি করে ১২ অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন এএসআই নজরুল এবং ওইদিনই তা অগ্রগামী করেন ওসি সাখাওয়াত হোসেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, খান মাইনউদ্দিনের পূর্বের আশঙ্কা অনুসারে নিরপেক্ষ তদন্ত না করে বাদীর আত্মীয়-স্বজন ও মাদরাসার শিক্ষকদের লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করেই মাইনউদ্দিনকে দোষী করে চার্জশীট প্রদান করেন তদন্ত কর্মকর্তা। তদন্ত প্রতিবেদনে এএসআই নজরুল উল্লেখ করেছেন, মাইনউদ্দিনের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের ৭ নভেম্বর (মামলা নং-২) একটি মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলাসহ একাধিক মামলা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে। কিন্তু নলছিটি থানাসূত্রে জানা গেছে, এএসআই নজরুল যে মামলাটি তদন্ত করছেন সেটি ছাড়া আর কোন মামলা মাইনউদ্দিনের বিরুদ্ধে নেই। তাছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে ২০০৪ সালে দায়ের হওয়া যে মামলাটি চলমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি থেকে ২০০৬ সালের ১৬ অক্টোবর ঝালকাঠি সহকারী দায়রা জজ (২য়) আদালতের বিচারক লিয়াকত আলী মোল্লা বেকসুর খালাস প্রদান করেন। রায়ের পর্যালোচনায় বিচারক উল্লেখ করেন, জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে খান মাইন উদ্দিনের বরিুদ্ধে ওই মামলা হয়। কিন্তু যে অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে তাতে সন্দেহাতীতভাবে নির্দোশ প্রমানিত হন মাইনউদ্দিন, তার পিতা আব্দুল আজিজ খান ও ভাই গিয়াস উদ্দিন।
এই রায়ের বিষয় না উল্লেখ করে মাইনউদ্দিনকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ফাঁসাতে মামলায় খালাসের তথ্য চেপে গিয়ে ‘বিচারাধীন’ উল্লেখ করেন এএসআই নজরুল ইসলাম।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, আজিজিয়া দাখিল মাদ্রাসায় বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তাকে ঘায়েল করতে সুযোগবাদীরা দীর্ঘ পরিকল্পনা করে চাঁদাবাজী মামলায় ফাঁসিয়েছেন। মামলাটি সাজানো ঘটনায় দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া চাঁদা দাবীর বিষয়ে এজাহারে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তেমন কোন ঘটনা এলাকায় ঘটেছে বলে কেউ শোনেওনি।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত এএসআই নজরুল ইসলাম মুঠোফোনে গতকাল দুপুরে জানান, বিচারাধীন ও খালাস তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব আমার না। মাইনউদ্দিনের বিরুদ্ধে অনেক মামলা চলমান রয়েছে বলে শুনেছি। বাকিটা আদালত দেখবেন। এই তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, আমিইতো শেষ কথা নয়। আমার উপরে অনেক কর্মকর্তা রয়েছে। তাদের কাছে জিজ্ঞেস করেন এমন প্রতিবেদন হয়েছে কেন। শেষে এএসআই নজরুল বলেন, বিকেলে নলছিটি থানায় আসেন। সামনাসামনি সব বুঝিয়ে দিব।
সন্ধ্যায় এএসআই নজরুলের ফোন দিয়ে প্রতিবেদককে কল দেন নলছিটি থানার ওসি সাখাওয়াত হোসেন। সাখাওয়াত হোসেন ক্ষুব্ধ হয়ে জানতে চান, কেন এএসআই নজরুলকে ফোন দেওয়া হচ্ছে? সমস্যা কি? প্রশ্নের জবাবে প্রতিবেদক সবিস্তারে বললে ওসি বলেন, তথ্যের জন্য আদালতে যান; থানায় ফোন দিচ্ছেন কেন? আর তারপরও কোন কিছু জানতে চাইলে সরাসরি থানায় আসেন।
ওসি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিচারাধীন ও খালাস শব্দের অর্থ জানতে চাও-তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতা কি? লেখাপড়া করলে সরকারী চাকরীর চেষ্টা করো। এসব ছাড়ো।
অপর প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন যাইহোক এখন মাইনউদ্দিন আদালতে আবেদন করে জামিন নিক।
ঝালকাঠি জেলা আইনজীবী সমিতির আ.স.ম মোস্তাফিজুর রহমান মনু বলেন, খালাস ও বিচারাধীন শব্দ দুটি সম্পূর্ণ আলাদা। খালাস বলতে মামলাটির সমাপ্তি। আর বিচারাধীন বলতে চলমান। খালাস পাওয়া কোন মামলাটি বিচারাধীন বলে উপস্থাপন করা সঠিক তথ্যের উপস্থাপন নয়। বর্তমানে গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সাংবাদিক খান মাইনউদ্দিন।
Leave a Reply