বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২৫ পূর্বাহ্ন
শাকিব বিপ্লব॥ বরিশাল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পদ অর্জনে বয়স ও যোগ্যতা লাগে না। আবার কখন কাকে কোন অজুহাতে পদচ্যুৎ করা হলে তারও কোনো যথার্থ অভিযোগের প্রয়োজনও পড়ে না। শীর্ষ এক নেতার বিরাগভাজন হলেই ঘটে বিপত্তি, মামলার আসামি হয়ে পুলিশ দিয়ে দৌড়ের ওপর থাকার উদাহরণও আছে। স্থানীয় রাজনীতিতে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা যুব বয়সি ওই শীর্ষ নেতার ইচ্ছ-অনিচ্ছাই এভাবেই চলছে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি। এই অভিমত দলীয় নেতৃবৃন্দের মুখেই ঘুরপাক খেতে শোনা যাচ্ছে। তবে এনিয়ে দলের মধ্যে প্রতিবাদের জো না থাকলেও ক্ষোভ-অসন্তোস যখন চলমান ঠিক তখনই এক বিতর্কিত এবং কথিত ছাত্রনেতাকে জেলা শ্রমিকলীগের শীর্ষ পদে বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরু হয়েছে কমবেশী নেতিবাচক আলোচনা। অনেক সিনিয়র শ্রমিক নেতাকে উপেক্ষা করে কেনো তরুণ বয়সি এই ছাত্রনেতাকে শীর্ষ দুটি পদের একটি অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ এই পদে বসানো হচ্ছে, তা নিয়ে নিয়ে সংগঠনের মধ্যে কানাঘুষায় বেরিয়ে এসেছে যে, বরিশাল নথুল্লাবাদ টার্মিনাল ওই নেতার কজ্বায় নিতেই এই সিদ্ধান্ত অনেকটাই চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা অপেক্ষামান মাত্র।
দলীয় সূত্রগুলোর দাবি, যেকোনও সময় প্রক্রিয়াধীন এই বিষয়টি ঘোষণার মাধ্যমে জেলা শ্রমিকলীগের রদবদল অথবা নতুন কমিটি গঠন হতে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে ওই ছাত্রনেতা সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হচ্ছেন, তা অনেকটাই নিশ্চিত। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে দুটি কারণ নিহীত রয়েছে বলে প্রকাশ পেয়েছে। এক শীর্ষ এই নেতার স্বার্থগত মাঠের রাজনীতিতে লাঠিয়ালের ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাবলীতে পরীক্ষায় সফল ও সাহসের পরিচয় দেওয়ায় উপহার হিসেবে এই পদে তাকে বসানোর সিদ্ধান্ত তরান্বিত হয়। এই তরুণকে ছাত্র অঙ্গনে পদ দেওয়া সম্ভব নয় বিধায় এ কৌশল নেওয়া হয়েছে। কারণ একেতো ছাত্রত্ব না থাকা এবং ছাত্রনেতার পদ পেতে সাংগঠনিক যে নিয়ম-কানুন রয়েছে, এর কোনো ক্যাটাগরিতে তার যোগ্যতা বহু আগেই উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, তাছাড়া বৈবাহিক জীবনে প্রবেশও করেছেন তিনি।
এতদিন অপেক্ষায় ছিলো, বিএম কলেজ ছাত্র সংসদ ভেঙে দিয়ে ওই তরুণকে ভিপি অথবা জিএস পদে প্রার্থী করার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে তাকে একটি ক্ষমতার বলয় তৈরী করে দেওয়া। কিন্তু বর্তমান ছাত্র সংসদ ভাঙা যেমন সম্ভব হয়নি, প্রকারান্তরে ওই দুটি পদে আরও যোগ্যতাসম্পন্ন দুজন ছাত্রনেতা প্রার্থিতার আকাঙ্খায় পাইপলাইনে রয়েছে। ভিপি-জিএস পদ প্রত্যাশী এই তরুণের সাথে বিরোধ এবং দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রায় প্রকট আকার ধারন করে।
তবে পর একটি সূত্র বলছে, এসব কারণ বিবেচ্চ্য বিষয় নয়। মূলত নথুল্লাবাদ টার্মিনালের রাজনীতি নিজ অংশের নিয়ন্ত্রণে রাখতেই ওই তরুণকে এখন পদ-পদবী দিয়ে রাজনীতিতে আরও একধাপ সামনে আনার প্রক্রিয়া হিসেবে শ্রমিকলীগে অন্তর্ভুক্ত করার পদক্ষেপের উদ্যোগটি ওই শীর্ষ নেতার কৌশল।
তবে এই সিদ্ধান্ত আসে অনেকটা কাকতালীয়ভাবে। সম্প্রতি পদবিহীন ওই তরুণ ছাত্রনেতা নথুল্লাবাস টার্মিনালে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দখল নিতে তাকে ব্যবহার করে সংঘাতবিহীন সফলতা এবং তার শক্তি-সামর্থের যোগ্যতার মাপকাঠি প্রমাণিত করে। পাশাপাশি বর্তমান সময়ে বিসিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘাতের ঘটনায় আলোচ্চ্য তরুণ অগ্রভাগে থেকে বরিশাল কাঁপিয়ে তোলায় নেতা তাকে হাল সময়ে তার সমাসাময়িকদের অপেক্ষা আনুগত্য বলেই মনে করছেন।
ওই সূত্রের অভিমত, নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হিসেবে স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যান ও টেম্পুশ্রমিক নেতা হিসেবে প্রথমে দুর্দান্ত বেপরোয়া এক যুবককে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিলো অনেকটাই চূড়ান্ত। পরিকল্পনার ছকে এই শ্রমিক নেতাকে দিয়ে সাম্প্রতিক বাস-মালিক সমিতির নেতৃত্বের শীর্ষে থাকা আফতাব আহম্মেদকে হটিয়ে দিয়ে গোটা টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ নিতে ওই শীর্ষ নেতা পর্দার অন্তরালে থেকে নিজের কারিশমা দেখিয়েছেন। এনিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি, আন্দোলনের মাধ্যমে অচল করে ওই বাস-মালিক সমিতির শক্তিমান নেতাকে চাপের মুখে টার্মিনাল থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন, যদিও তিনিও ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত এবং পদধারী নেতা। কিন্তু নেতার প্রত্যাশা অনুযায়ী টার্মিনাল দখলে আসা ওই টেম্পুশ্রমিক নেতা শেষান্তে কুট-রাজনীতিতে নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতে পারেননি। তার চেয়েও বড় বিষয় হয়ে দাড়ায় শীর্ষ নেতা অর্থাৎ গুরুর সাথে একটি বিষয় নিয়ে শ্রমিক নেতার বিরোধ তুঙ্গে ওঠে।
একটি সূত্রের দাবি, নেতা চেয়েছিলো তার এক ঘনিষ্ট আত্মীয়কে বাস-মালিক সভাপতির আসনে বসাতে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ওই যুবকের যেমন ক্ষমতা খর্ব হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয় এবং আত্মীয়করণের বিষয়টি তিনি মেনে নিতে পারেননি।
তার দাবি, টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রাথমিকভাবে তাকে ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া নিজের শক্তির বিবেচনায় নেতার এই সিদ্ধান্ত তার প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।
এমন শীতল বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধি হিসেবে টার্মিনাল এলাকায় পারিবারিক প্রভাব ও নিজের শক্তিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সম্ভাব্য নেতার ধারনা, এই যুবক নেতার বলয়ের বাইরে অবস্থান নিয়েছেন।
শ্রমিক সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ওই টেম্পুশ্রমিক নেতাকে শেষান্তে রোষানলে পড়ে দুটি চাঁদাবাজির মামলায় পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, যেতে হয়েছে অসীম ক্ষমতা নিয়েও কারাগারে। প্রকারান্তরে জামিনে মুক্ত হয়ে নেতার সাথে নমনীয় হলেও তাকে আর বিশ্বাসযোগ্য মনে না হওয়ায় কথিত ওই ছাত্রনেতাকে তার বিকল্প হিসেবে টার্মিনাল এলাকায় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত থেকেই শ্রমিক লীগের নতুন কমিটি বা নেতৃত্বের রদবদলের সিদ্ধান্ত আসে। শীর্ষ নেতা এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পরই ওই ছাত্রনেতা এখন টার্মিনাল এলাকায় অনেকটা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন, শোনা যাচ্ছে।
অবশ্য এতদিন শ্রমিক লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ছিলোনা। সভাপতি হিসেবে পরিমল চন্দ্র দাস সংগঠনটি নিয়ন্ত্রণ করছিলেন শীর্ষ ওই নেতার আস্থাভাজন হিসেবে। এখন তাকে পদোন্নতি দিয়ে সভাপতি করা হতে পারে। আভাস পাওয়া গেছে, ক্ষমতাসীন দলীয় ছাত্রনেতা হিসেবে নগরজুড়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটে হৈইচৈই ফেলে দেওয়াসহ অনেকটা বেপরোয়া আচারণে অভ্যাস্ত এই বিতর্কিত তরুণ এখন শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার বিষয়টি অনেকেই ভাল চোখে নিচ্ছেন না। ইত্যমধ্যে তিনি সংগঠনে নিজের বলয় ও সমর্থন বৃদ্ধিতে তার অনুগত এলাকাভিক্তিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের শ্রমিক সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দিয়ে ‘ফিল্ড ওয়ার্ক’ শুরু করেছেন। সম্ভাবত শ্রমিক সংগঠনভিক্তিক ওয়ার্ড কমিটি গঠন প্রক্রিয়াও শুরু হতে যাচ্ছে। সেই সাথে টার্মিনাল এলাকায় এখনই খবরদারি শুরু করায় খোদ শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক, সেই সাথে অসন্তোস দানা বেধে উঠছে।
গত কয়েকদিন ধরে বরিশালের ক্ষমতাসীন দলীয় রাজনীতিতে এই বিষয়টি বেশ আলোচনায় এসেছে, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর বিপরীতে প্রতিক্রিয়ারও খবর কমবেশী পাওয়া গেছে।
জেলা শ্রমিক লীগের গুরুত্বপূর্ণ এই পদে এধরনের মারদাঙ্গা তরুণের অন্তর্ভুক্তি এবং বয়সগত দিক থেকে অসম বিষয় বলে মনে করছে দলের মধ্যেকার সুশীল অংশটি। আবার শ্রমিক সংগঠনের অপরাপর নেতাদের অভিমত, একজন তরুণের নির্দেশনায় দীর্ঘদিনের পোড়খাওয়া নেতা-কর্মীদের বিষয়টি মেনে নেওয়া সহজতর হবে না। তাছাড়া এই তরুণ যতটা বেপরোয়া তদুপরি অতিরিক্ত মাত্রায় বিতর্কিত হওয়ায় সাধারণ শ্রমিকরাও এরুপ সিদ্ধান্তের আগাম খবর পেয়ে সংক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে।
অপর একটি মাধ্যমের ভাষ্য, শ্রমিকলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসার অপেক্ষায় থাকা এই তরুণ চেয়েছিলেন তার নিজ এলাকা কাউনিয়ায় আগামীতে কাউন্সিলর হিসেবে দলীয় প্রার্থী হয়ে মাঠে নামবেন। সেলক্ষে কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেখানে ওয়ার্ড আ’লীগের একজন নেতা একই প্রস্তুতি নিয়েছেন, তিনিও চালিয়ে যাচ্ছে আগাম কার্যক্রম। এনিয়ে দুজনের মধ্যে এলাকাভিক্তিক শীতল লড়াই চলার খবর কমবেশি জানাজানি এবং প্রকাশ পেয়েছে।
উল্লেখ্য, দুজনেই একই নেতার অনুসারী হওয়ায় কৌশলগত কারণেই এই বিরোধ অবসানে ছাত্রনেতার তকমা লাগানো এই তরুণকে শ্রমিকলীগে অন্তর্ভুক্ত করার আরেকটি পদক্ষেপ হতে পারে। মহানগর রাজনীতির সাথে জড়িত ওই শীর্ষ নেতার একক ক্ষমতাবলে এমন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ায় সংগঠনের মধ্যে বিশেষ করে শ্রমিকলীগে ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও তোপের মুখে পড়ার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস নিচ্ছে না অথবা ভুমিকায় যেতে নারাজ। যে কারণে কারও কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।’
Leave a Reply