মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩০ অপরাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ অগ্নিঝরা মার্চের ২৩তম দিন আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তান দিবসের বিপরীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা বাংলাদেশে পালিত হয় ‘লাহোর প্রস্তাব দিবস’। আর স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে দিনটি পালিত হয় ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এ দিনটি ছিল সাধারণ ছুটির দিন। সারা দেশের প্রতিটি বাড়ি, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সুপ্রিমকোর্ট, যানবাহন- সবখানেই কালো পতাকার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলিত হয়। রাজধানী ঢাকা পরিণত হয় পতাকার নগরীতে। স্বাধীনতাকামী প্রতিটি বাঙালির মুখ যেন ছিল নব সূর্যের নব আলোকে উদ্ভাসিত। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য! কড়া পাহারাবেষ্টিত প্রেসিডেন্ট ভবন, গভর্নর হাউস এবং ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ২৩ মার্চের স্মৃতিচারণ করেন এভাবে- সকালে বাড়িসুদ্ধ সবাই মিলে ছাদে গিয়ে কালো পতাকার পাশে আরেকটা বাঁশে ওড়ালাম স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন পতাকা। বুকের মধ্যে শিরশির করে উঠল। আনন্দ, উত্তেজনা, প্রত্যাশা, ভয়, অজানা আতঙ্ক- সবকিছু মিলেমিশে একাকার অনুভূতি। নাস্তা খাওয়ার পর সবাই মিলে গাড়িতে করে বেরোলাম, খুব ঘুরে বেড়ালাম সারা শহরের বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে। সবখানে সব বাড়িতে কালো পতাকার পাশাপাশি সবুজ-লাল-হলুদে উজ্জ্বল নতুন পতাকা পতপত করে উড়ছে। ফটো তুললাম অনেক। ঘুরতে ঘুরতে ধানমণ্ডি দুই নম্বর রোডে বাঁকার বাসায় গিয়ে নামলাম। সেখানে খানিকক্ষণ বসে গেলাম ডা. খালেকের বাসায়।
বাঁকার বাসার ঠিক সামনেই রাস্তার ওপাশে ডা. খালেকের বাসায় দেখা হল তার শ্যালিকা মদিরা ও তার স্বামী নেভির অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডার মোয়াজ্জেমের সঙ্গে। অবসর নেয়ার পর মোয়াজ্জেম একটা রাজনৈতিক দল গঠন করেন দু’বছর আগে। নামটা বেশ বড়, ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি’। মোয়াজ্জেমের সঙ্গে যখনই দেখা হয়, তিনি হেসে হেসে বলেন, শেখ সাহেবের ছয় দফা, আমার কিন্তু এক দফা। তা হল- পূর্ববাংলার স্বাধীনতা।
এদিকে এদিন পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন। ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালন উপলক্ষে এ আয়োজন করা হয়।
এদিন সাধারণ ছুটি থাকায় জনতার স্রোত নামে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মিছিলের পর মিছিল আসতে থাকে। সবার হাতে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা। এ সময় বাম হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরে ডান হাত জনতার উদ্দেশে বাড়িয়ে মুক্তিকামী মানুষের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলার মানুষ কারও করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতাবলেই তারা স্বাধীনতার লালসূর্য ছিনিয়ে আনবে।
৭ মার্চের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে বঙ্গবন্ধু বলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। যতদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হবে, যতদিন একজন বাঙালিও বেঁচে থাকবে- ততদিন এ সংগ্রাম চলবেই চলবে। মনে রাখবেন, সর্বাপেক্ষা কম রক্তপাতের মাধ্যমে যিনি চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন, তিনিই সেরা সিপাহসালার। তাই বাংলার জনগণের প্রতি আমার নির্দেশ, সংগ্রাম চালিয়ে যান, শৃঙ্খলা বজায় রাখুন, সংগ্রামের কর্মপন্থা নির্ধারণের ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন। বাংলার দাবির প্রশ্নে কোনো আপস নাই। শোষক-কায়েমি স্বার্থবাদীদের কিভাবে পর্যুদস্ত করতে হয় আমি তা জানি।
এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক হয়নি। তবে উভয়ের উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে দু’দফা বৈঠক হয়। প্রথম বৈঠক দুপুর ১২টা থেকে ১ ঘণ্টা এবং দ্বিতীয় বৈঠক সন্ধ্যা ৬টা থেকে ২ ঘণ্টা চলে। এতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন। ইয়াহিয়ার পক্ষে ছিলেন বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা, এমএম আহমদ ও কর্নেল হাসান। আলোচনা শেষে তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘শেখ সাহেব ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে যেসব ব্যাপারে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেসব ব্যাপারেই আমরা প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি।’ তিনি বলেন, ‘পরবর্তী বৈঠকের সময় এখনও ঠিক হয় নাই।’ বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা করেছেন জানতে চাইলে তাজউদ্দীন আহমদ তা জানাতে অসম্মতি জানান।
বিকালে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে পশ্চিম পাকিস্তানের ছয় নেতা তার সঙ্গে মিলিত হন। এরা হলেন- কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা মিয়া দৌলতানা, ন্যাপ (ওয়ালী) প্রধান ওয়ালী খান, জমিয়তে ওলামায়ে পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা মাওলানা শাহ আহমেদ নূরানী, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মুফতি মাহমুদ, পাঞ্জাব কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি সরদার শওকত হায়াত খান ও বেলুচিস্তান ন্যাপের সভাপতি গাউস বক্স বেজেঞ্জো। বৈঠকে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও ড. কামাল হোসেন।
ঢাকায় আসার পর এদিনই প্রথমবারের মতো জেনারেল ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে সেনানিবাসে যান। সেখানে দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এছাড়া জুলফিকার আলী ভুট্টোও এদিন লে. জেনারেল পীরজাদার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন। এসব বৈঠকেই ২৫ মার্চ গণহত্যার জন্য প্রণীত ‘অপারেশন সার্চলাইট’র নীলনকশা চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়।
এদিন সংবাদপত্রে পাঠানো বিবৃতিতে মি. ভুট্টো বলেন, ‘বর্তমানে দেশে ক্ষমতার তিনটি উৎস বিদ্যমান। পিপলস পার্টি, আওয়ামী লীগ এবং সেনাবাহিনী।’ এর তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলেন, মি. ভুট্টো আপনি ও আপনার দোসররা এটা জেনে রাখুন, দেশের জনসাধারণ যখন তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অপেক্ষা করছে, তখন সেই উদ্দেশ্যকে বানচাল করে দেয়ার জন্যই এ ধরনের ভণ্ডামিপূর্ণ বিবৃতি দেয়া হচ্ছে।
Leave a Reply