মান্তা জনগোষ্ঠীর জীবনে ছোঁয়া লাগেনি সভ্যতার, পায় না কোনো সরকারি সুবিধা Latest Update News of Bangladesh

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:২৪ পূর্বাহ্ন

বিজ্ঞপ্তি :
Latest Update Bangla News 24/7 আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি ভয়েস অব বরিশালকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] অথবা [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।*** প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে!! বরিশাল বিভাগের সমস্ত জেলা,উপজেলা,বরিশাল মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ড ও ক্যাম্পাসে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে! ফোন: ০১৭৬৩৬৫৩২৮৩




মান্তা জনগোষ্ঠীর জীবনে ছোঁয়া লাগেনি সভ্যতার, পায় না কোনো সরকারি সুবিধা

মান্তা জনগোষ্ঠীর জীবনে ছোঁয়া লাগেনি সভ্যতার, পায় না কোনো সরকারি সুবিধা




পটুয়াখালী প্রতিনিধি॥ মান্তা। উপকূলের নৌকায় বসবাস করা একটি জনগোষ্ঠী। নদীর জলে ভাসা নৌকায় তাদের জন্ম, বিয়ে, জীবন-জীবিকা এবং মৃত্যু। দেশের বিভিন্ন এলাকার নদীভাঙা মানুষগুলোর পূর্বপুরুষের ঠিকানা হারিয়ে আশ্রয় জুটেছে জলে। নৌকায় তাদের আলাদা জগৎ, আলাদা এক রাজ্য। সভ্য সমাজব্যবস্থার সাথে রয়েছে রক্তের বন্ধন, রয়েছে জীবন-জীবিকার সংযোগ। তবুও মান্তা জনগোষ্ঠীর জীবনে ছোঁয়া লাগেনি সভ্যতার, পায় না কোনো সরকারি সুবিধা। এ জনগোষ্ঠীর শিশুরা অধিকার বঞ্ছিত আর মানবতাবির্বজিত হয়ে বেড়ে উঠছে। তাদের ওই জীবন যেন আমাদের নাগরিক জীবনকে ব্যঙ্গ করে।

 

 

রশি বাঁধা ছেলেবেলা

 

মান্তা জনগোষ্ঠীর জীবনে ছোঁয়া লাগেনি সভ্যতার, পায় না কোনো সরকারি সুবিধা

পটুয়াখালী শহরে থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার সড়কপথ পেরিয়ে বাউফল উপজেলার বগি খাল। পাশেই তেঁতুলিয়া নদী। ওই খালটি বাউফল ও দশমিনা উপজেলার সীমানা নির্ধারণ করা। খালের মধ্যে শতাধিক নৌকা। ওই নৌকার মধ্যে শতাধিক পরিবারের বসতি। তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ শিকার করে মান্তা পরিবারের লোকজন জীবিকা চালায়।

 

 

ভুখানাঙ্গা এ মানুষগুলো নদীভাঙনের শিকার। ভিটেমাটি আর পূর্বপুরুষের ঠিকানা হারিয়ে এরা এখন যাযাবর। নদীর জলের ওপর বসতি তাদের। মাছ শিকারের ওপর নির্ভরশীল এই মানুষগুলো যেখানে মাছের সন্ধান পায় সেই জলাশয়ের আশপাশে নৌকা নোঙর করে। কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে সরকারি সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত নৌকার এই বাসিন্দারা। জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সবই হয় তাদের নৌকায়। তবে দাফন হয় মাটিতে। মান্তা পরিবারে শিশুরা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাদের বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে অভিভাবকরা কোমরে পরিয়ে দেয় রশি। ওই রশি কোমরে নিয়েই বড় হয় শিশুরা। গোসল করা, খাওয়া, ঘুম ছাড়া সারাক্ষণই শিশুরা নৌকায় রশি দিয়ে বাঁধা থাকে।

 

 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নৌকায় নৌকায় শিশুরা রশি দিয়ে বাঁধা। ওই শিশুদের নানা ধরনের আকুতি। কেউ কাঁদছে, কেউ ঝুলে আছে, কেউ বা আবার পানির মধ্যে হাত চুবিয়ে খেলা করার চেষ্টা। আবার কাউকে খালের পারে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া মা তাঁর সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন কিন্তু শিশুটির কোমরে ঝুলছে মোটা রশি। মায়ের কোলে থাকলেও কোমরে বাঁধা থাকে মোটা রশি। এভাবেই রশির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে মান্তা শিশুর জীবন।

 

 

অন্যদিকে শিশুর কোমরে রশি বাঁধতে ভুলে গেলেও বিপদ। সন্তানের কোমরে রশি বাঁধতে ভুলে যাওয়ায় গত এক বছরে পটুয়াখালীর চার মান্তা পল্লীতে ছয় শিশুর মৃত্যু হয়। এর মধ্যে বগি খালে মৃত্যু হয়েছে দুটি, গলাচিপার পানপট্টির খালে মৃত্যু হয়েছে দুটি, রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ বাজারের স্লুইস খালে মৃত্যু হয়েছে একটি এবং গলাচিপার রামনাবাদ খালে মৃত্যু হয়েছে একটি মান্তা শিশুর। প্রতিবছরই পানিতে ডুবে মান্তা শিশুর মৃত্যু হয় বলে জানালেন অভিভাবকরা। তবে যেভাবে রশি দিয়ে শিশু নৌকায় বাঁধা থাকে তাতেও মৃত্যুঝুঁকিতে থাকে শতভাগ। আর রশি বাঁধা না থাকলে মৃত্যুঝুঁকি আরো বেড়ে যায়, এমন বক্তব্য অভিভাবকদের।

 

 

মান্তা পরিবারের অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিশু জন্মের দুই থেকে তিন দিন পরই সন্তানদের কোমরে মোটা রশি পরিয়ে দেওয়া হয়। কারণ নৌকায়ই সার্বক্ষণিক তাদের বসবাস। তাই নদীতে অনেক সময় ঢেউ থাকে তাতে নৌকা দোলে তখন সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুটি পানিতে পড়ে যেতে পারে। এ কারণে জন্মের দু-এক দিনের মধ্যেই কোমরে রশি লাগানো হয়। ওই রশির অভিশাপ থেকে পাঁচ কিংবা ছয় বছরের আগে (সাঁতার শেখা পর্যন্ত) মুক্তি মেলে না মান্তা শিশুর। এ রশি শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অভিভাবকদের হাতিয়ার হলেও কখনো কখনো রশি নির্মম হয়ে ওঠে শিশুর প্রাণনাশে।

 

 

আমানত সরদার জানান, তিন বছর আগে তাঁর দুই বছরের শিশুসন্তান রুবেলকে রশি দিয়ে নৌকায় বেঁধে রাখেন স্ত্রী রাহিমা বেগম। তখন তিনি নৌকায় ছিলেন না। কাজে ব্যস্ত থাকা রাহিমা বেগমের অজান্তে রুবেল রশি বাঁধা অবস্থায় নৌকা থেকে নদীতে পড়ে মারা যায়। পরে রশি থাকার কারণে খুব সহজে রুবেলের মৃতদেহ পাওয়া যায়। সহজে মৃতদেহ পাওয়াটা তাদের একধরনের সান্ত্বনা। এ রকম ঘটনা মাঝেমধ্যে মান্তা পরিবারে ঘটে, এমন দাবি ওই অভিভাবকের।

 

 

মান্তা পরিবারগুলো শিশুদের রশির বন্দিদশা থেকে মুক্তি চায়। নৌকা থেকে ভূমিতে বসবাসের স্বপ্ন তাদের। কিন্তু কিনারা খুঁজে পায় না। বিভিন্ন মান্তা পরিবারের সদস্যরা জানায়, তাদের বেঁচে থাকার মতো নৌকা, বড়শি আর জাল ছাড়া কিছুই নেই। ভাসতে ভাসতে যেখানেই তারা নোঙর করে, ওই এলাকার প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধিরা তাদের নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করেন না। বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌকায় ভাসা ওই মানুষগুলোর আস্তানা হয় নদীকেন্দ্রিক। ফলে যে এলাকায় অবস্থান নেয় ওই এলাকার জনপ্রতিনিধিরা মনে করেন তারা তাঁদের ভোটার না, এ কারণে কোনো ধরনের সরকারি সুবিধা এরা পায় না। এ জন্য প্রশাসনের লোকজনও তাদের খোঁজখবর রাখে না। সারাক্ষণ জাল-নৌকা নিয়ে পেটের ধান্দা মেটানোর তাগিদে জন্ম নিবন্ধন, জন্ম সনদ কিংবা মৃত্যু সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথেও এরা অপরিচিত।

 

 

মো. নুরু সরদারের স্ত্রী সেতারা বেগম বলেন, ‘আমার ৯ডা গুরাগ্যারা অইছেলে। একটা দড়ি (রশি) ছুইট্টা পানিতে ডুইব্বা মরছে। একটা মরছে অসুখ অইয়া। সাতউগা (সাত) বাইচ্চা আছে। য্যারা বাইচ্চা রইছে সবাইরে দড়ি দিয়া বাইনগা (বেঁধে) বড় করছি।’

 

মো. আবুল হোসেন সরদার নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার দুইডা পোলা নদীতে পইড়া মরছে। পানিতে আর থাকতে মোল্লায় (ইচ্ছা) না। সরকার যদি আমাগোরে নদীর ধারে একটা জমি বা ঘর উডাইয়া দেয় চাষবাসের লইগ্যা খাসজমি দেয়। আমাগো পোলাপান বাইনগা (বেঁধে) বড় করণ লাগবে না। ছাড়াইগা (ছেড়ে বা মুক্ত) পালতে পারমু। নদীতে থাহি দেইক্যা আমাগোরে কেউ কিছু দেয় না।’

 

 

বগি এলাকার স্থানীয় এক বাসিন্দা মো. হেদায়েত মুন্সি আক্ষেপ করে বলেন, ‘গরু-ছাগলের বাচ্চাও বাঁধন খুলে লালন-পালন করা হয়। আর এরা মানুষের বাচ্চা হয়েও সব সময় বাঁধা থাকে। এদের জন্য সরকারের কিছু একটা ভালো কাজ করা উচিত। শিশুদের বেঁধে রেখে বড় করার এ ঘটনা আমাদের জীবনকে উপহাস করা ছাড়া আর কিছুই না।’

 

 

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক মো. অহিদুজ্জামান শামীম বলেন, ‘জন্মের পর শিশুরা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। হামাগুড়ি দিয়ে চলাচলে ক্রমশ তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ শুরু হয় এবং শিশুরা বোঝে এবং শেখে। কিন্তু ওই বয়সে শিশুরা বন্দিদশার মধ্যে থাকলে অবশ্যই মানসিক বিকাশ বাধার মুখে পড়ে। ওই শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা শিশুর চেয়ে অবশ্যই আলাদা স্বভাবের হবে। পানি বা ভাসমান জীবন থেকে ওই জনগোষ্ঠীকে বের করতে পারলে ওই শিশুরাই স্বাভাবিক এবং সুস্থভাবে বেড়ে উঠবে।’

 

 

পুতুল খেলার বয়সে বিয়ে

 

মান্তা জনগোষ্ঠীর জীবনে ছোঁয়া লাগেনি সভ্যতার, পায় না কোনো সরকারি সুবিধা

মাত্র ১৩ বছর বয়স পেরিয়ে ১৪-তে পড়েছে নূপুরের। এরই মধ্যে সে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শনিবার বেলা ১১টার সময় তাঁর সাথে দেখা হয় বগি খালে। নূপুর তার বড় বোন আছিয়ার সাথে নৌকা নিয়ে তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ শিকারে যাচ্ছে। সে বলে, ‘বাপ-মায় গত বছর বিয়া দেছে, আমি কী করমু?’ তার স্বামীর নাম শিপন। ওই জনগোষ্ঠীর সন্তান, বয়স ১৬ বছর। নূপুর আরো বলে, ‘আমরা গরিপ (গরিব), আমাগো মাছ ধইরগাই সংসার চলে। আমাগো নৌকার সবাইর বিয়া ১২-১৩ বচ্ছর বয়সে অয় (হয়)।’

 

 

নূপুরের সাথে কথা শেষ না হতেই দেখা মেলে আরেক শিশুবধূ মরিয়মের সাথে। মরিয়মের বয়স ১৪; কিন্তু সে এক সন্তানের জননী। সেও ওই নদীতে মাছ শিকার করে। এ সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক শিশুবধূ রাবেয়া। তার কোলজুড়ে রয়েছে এক বছরের শিশু সুজন। রাবেয়ার বয়স ১৪ বছর। তার চোখে-মুখে এখনো শিশু বয়সের ছাপ। তবুও জীবন খেলায় ব্যস্ত শিশু রাবেয়া। নিজের শিশু বয়স অথচ সন্তান জন্ম দিয়ে বইছে আরেক শিশুর বোঝা। কত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে তা স্পষ্ট করে বলতে পারেনি রাবেয়া। তবে কপাল কুঁচকে আর মাথা হেলিয়ে রাবেয়া বলে, ‘বিয়া অইছে তিন বচ্ছর তো অইবেই। আমার যহন বিয়া অইছে তহন আমি হাফপ্যান্ট পরি।’

 

 

পটুয়াখালীর বাউফল ও দশমিনা উপজেলার সীমানা নির্ধারণ করা বগি খালে রাবেয়ার নৌকা। স্বামী রুবেল সরদার। ওই বহরের অন্য নৌকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাবেয়ার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন তার (রাবেয়া) বয়স ১০ বছরের বেশি হয়নি। বিয়ের দুই দিন পরই স্বামীর সংসার সাজাতে দায়িত্ব শুরু। ইতিমধ্যে এক সন্তানের মা সে। শিশু বয়সেই ভেঙে পড়েছে রাবেয়ার শরীর।

 

 

 

এ প্রসঙ্গে রাবেয়া বেগম আরো বলে, ‘বিয়ার বয়স অইছে দেইক্যাই বাপ-মায় বিয়া দেছে। নৌকার সবাই ওই বয়সেই বিয়া অয়।’ অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় চরকাজল খালে মান্তা পরিবারের কুলসুম বিবির সাথে বিয়ে হয় রিপন সরদারের। খুবই দুর্বল শারীরিক কাঠামো নিয়ে স্বামীর সংসার শুরু করেছে কুলসুম। কুলসুম বলে, ‘বাপ-মায় বিয়া দেছে, আমি কী করমু? বিয়ার বয়স না অইলে কি বিয়া দেতে?’

 

মান্তা জনগোষ্ঠীর জীবনে ছোঁয়া লাগেনি সভ্যতার, পায় না কোনো সরকারি সুবিধা

 

 

বাল্যবিয়ে দিয়ে জীবন শুরু হওয়ার এ অবস্থা শুধু রাবেয়া, মরিয়ম, নূপুর আর কুলসুমের জীবনই আসেনি। মান্তা সম্প্রদায়ের প্রতিটি নৌকায় যে মেয়েদের বিয়ে হয় সবাই এ নিয়মে বাঁধা। পটুয়াখালীর বিভিন্ন নদীতীরবর্তী এলাকায় নৌকায় বসবাস করা মান্তা পরিবারের মেয়েরা শিশুবধূ হয়েই সংসার শুরু করে। এটি অভিশাপ হলেও অভিভাবকরা মনে করেন কন্যা বিদায়ের দায়মুক্তি। এ সংস্কৃতি এদের জীবনকে খামছে ধরেছে। কত বছর বয়সে কন্যাসন্তানের বিয়ে দেওয়া উচিত, তা জানেন না মান্তা পরিবারের অভিভাবকরা। এমনকি বিয়েতে কাজি দ্বারা রেজিস্ট্রি করার বিষয়টিও তাঁরা আমলে নেন না। ফলে প্রয়োজন হয় না বর বা কনের জন্ম সনদের। মূলত এসব বিষয়ে তাঁদের কোনো ধারণাই নেই।

 

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার বাউফল উপজেলার নারাইনপুর খাল, কালাইয়া খাল, হোগলা খাল, তালতলি খাল, গলাচিপা উপজেলার উলানিয়া খাল, পক্ষিয়া খাল, চরকাজল খাল, বোয়ালিয়া খাল, পানপট্টি খাল, বদনাতলী খাল, রামনাবাদ খাল, পাউট্টা খাল ও ডেবপুরা খাল, রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোট বাইশদিয়া খাল, চালিতাবুনিয়া খাল, বড় বাইশদিয়া খাল, কোড়ালিয়া খাল ও চরমোন্তাজ স্লুইস বাজার খালে ১০ হাজারের অধিক মান্তা পরিবারের নৌকায় জলে ভাসে। ওই সব পরিবারের বেশির ভাগ মেয়ের ১০ থেকে ১৩ বছর বয়স হলেই অন্য নৌকায় পাত্র খুঁজে বিয়ে দেওয়া হয়।

 

 

বগি খালের কদম আলীর স্ত্রী পিয়ারা বেগম (৩০) জানান, আট কিংবা ৯ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। বর্তমানে পাঁচ সন্তানের জননী তিনি। অভিভাবকরা শিশু বয়সে কন্যাসন্তানকে বিয়ে দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। বিয়েতে কাজি ডাকা হয় না। শুধু কলেমা পড়িয়ে বকুল বলতে পারা একজন হুজুর বা মৌলভি ডেকে কন্যাশিশুকে বিয়ে দেওয়া হয়।

 

 

পিয়ারা আরো বলেন, ‘বিয়া ছাড়া আমাগো নৌকার মাইসস্যের (মানুষের) কোনো আনন্দ অয় না। আনন্দ-ফুর্তির লইগ্যা কোম বয়সে মাইয়াগো বিয়া অয়। আর বোঝেন-ই তো স্যার, বিয়ার লইগ্যা এউক্কা (একটা) পোলা আর এউক্কা মাইয়া অইলেই অয়। আমাগো নৌকায় গুরাগ্যারার (ছেলে-মেয়ে) অভাব নাই। কোম বয়সে বিয়া অইলেও বয়স তো বাড়তেই থাহে। আমি সাবল্লক (সাবালিকা) অইছি স্বামীর নৌকায় যাইয়া। আমার বিয়ায় নৌকার মাইস্যে খুবই আনন্দ-ফুর্তি করছে।’

 

 

প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দেন কালু সরদারের স্ত্রী, তিন সন্তানের জননী রাহিমা বেগম (২৮), শুক্কুর সরদারের স্ত্রী সূর্য বেগম (১৫) (সূর্য বর্তমানে গর্ভবতী)। রিপন সরদারের স্ত্রী এক সন্তানের জননী মুক্তা বেগম (১৬)। এদের সবারই বিয়ে হয়েছে ১৩ বছর বয়সের মধ্যে। অভাব আর বিচ্ছিন্নতার কারণে মান্তা জনগোষ্ঠী জীবনে কোনো সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কিংবা ধর্মীয় উৎসবের ছোঁয়া লাগে না। এ কারণে শুধু বিয়েই তাদের একমাত্র উৎসব। তাই বিধি-বিধান না জানা এবং সচেতনতার অভাবে ছোট ছোট শিশুদের বিয়ে দিয়ে এরা আনন্দ-ফুর্তি করে নৌকায়।

 

 

এরা পরিকল্পিত পরিবার সম্পর্কেও অজ্ঞ। কারণ এদের নৌকাবহরে পা পড়ে না কোনো স্বাস্থ্যকর্মীর। সরকারের এদের জন্য নেই কোনো পরিকল্পনা। তাই জন্ম নিয়ন্ত্রণ কী তা তারা জানে না এবং শিশু স্বাস্থ্য সম্পর্কেও এরা অসচেতন। ফলে ফি বছর পোয়াতি হয় মায়েরা। এসব কারণে অধিকাংশ মা ১৮ বছরের মধ্যে একাধিক সন্তানের জন্ম দেয়। ত ছাড়া বয়স যত বাড়ে, মান্তা মায়েদের সন্তানও তত বাড়ে। আনছার সরদারের স্ত্রী মিনারা খাতুন (৪৫) ৯ সন্তানের জননী। পরিবার পরিকল্পনা বা জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ওই সব আমরা বুঝি না। আমাগোরে কেউ ওই সব কিছু কয় নাই।’

 

 

নদীভাঙনের কারণে ভিটেমাটি হারিয়ে এরা জলে নৌকা ভাসিয়ে মাছ শিকার করে জীবিকা চালালেও এরা ফিরতে চায় ডাঙায়। একখণ্ড জমির মালিক হতে চায়। কিন্তু ভাগ্যবিড়ম্বিত এ মানুষগুলোর ওই দাবি কখনো জোয়ারের মতো নিজেদের মধ্যে তীব্র হয় আবার অভাবের কারণে ভাটার মতো বেমালুম ভুলে যায়। পেটের তাগিদে সারাক্ষণ নদীতে জাল কিংবা বড়শি নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাই ওই দাবি নিয়ে তারা দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তির দরবারে যেতে পারে না। ফলে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর।

 

 

মান্তা জনগোষ্ঠীর জীবনে ছোঁয়া লাগেনি সভ্যতার, পায় না কোনো সরকারি সুবিধা
বাউফল ও রাঙ্গাবালী উপজেলার দায়িত্বে থাকা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. মাহাবুব হাসান ভূঁইয়া বলেন, ‘এদের স্থায়ী বসতির অভাবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীরা এদেরকে সেবা দিতে পারছে না। কারণ এদের কোনো হোল্ডিং নম্বর নাই। তবে এ জনগোষ্ঠীর লোকজন যদি আমাদের কোনো কর্মীর কাছে গিয়ে সেবা চায় তাহলে আমাদের কর্মীরা সেবা দিতে বাধ্য। কিন্তু অসচেতনতার কারণে এরা কোনো কর্মীর কাছে সাধারণত যায় না। নদীতীরবর্তী এলাকায় আবাসন বা আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করা হলে আমাদের কর্মীরা এদেরকে সব ধরনের সেবা দিতে পারবে।’

 

 

জেলা মহিলা বিষায়ক কর্মকর্তা শাহিদা বেগম বলেন, ‘এসব জনগোষ্ঠীর জন্য মন্ত্রণালয় থেকে লিখিত পরিকল্পনা চাওয়া হলে আমরা তা প্রস্তুত করে দেব। তবে মৌখিকভাবে এই সম্প্রদায় সম্পর্কে এবং এদের জীবনমান সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষে অবহিত করা হয়েছে।’

 

 

জীবিকার সংজ্ঞা পাঁচে

 

 

সাত বছরের শিশু রাজীব। গভীর তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ শিকাররত অবস্থায় মাথা নুয়ে বলেন, ‘মাছ না ধরলে আমরা খামু কী? নৌকার ছোড-বড় সবাই মাছ ধরে। আমাগো তো অন্য কোনো কাম নাই। মাছ পাইলে বেইচ্চা নগদ টাহায় চাউল কেনে বাবায়। মাছ না পাইলে টাহা ধার করে। আমাগোরে সরকার কোনো চাউল দেয় না। কেউই কিছু দেয় না। আমাগো কামাই আমাগোই করতে অয়।’ জীবনের বাস্তবতায় সাত বছর বয়স পার হওয়া শিশু রাজীবের এসব কথা ঠোঁটের আগায় খইয়ের মতো ফোটে।

 

 

রাজীবের সাথে কথা বলে আরো জানা যায়, শিশু বয়স থেকে মাছ শিকার করা মান্তা শিশুদের রেওয়াজ। এটাই তাদের একমাত্র জীবিকা। বেঁচে থাকা, বর্তমান অথবা ভবিষ্যৎ এসবই নদীর মাছ শিকারকে ঘিরে। তাই মাছ শিকারে বয়সের কোনো সীমারেখা নেই। নৌকায় বসবাস করা মান্তা জনগোষ্ঠীর অভিভাবকরা সন্তান জন্মের দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে শিশুসন্তানদের সাথে নিয়েই মাছ ধরতে নদীতে যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মান্তা শিশুরাও ওই কর্মকে আপন করে নেয়। নদীই হয় তাদের একমাত্র ভবিষ্যৎ। এক পর্যায়ে শিশুর বয়স পাঁচ থেকে ছয় বছর অতিক্রমের পর শিশুদের আলাদা নৌকা এবং জাল কিংবা বড়শি দিয়ে নদীতে পাঠানো হয়।

 

 

তেঁতুলিয়া নদীর বহরমপুর এলাকায় রাজীব, সবুজ, মনোয়ার ও সুজন একটি নৌকায় চারজন মিলে জাল দিয়ে মাছ শিকার করছে। ওরা চারজনই মান্তা শিশু। বয়স সাত থেকে ১০ বছরের মধ্যে। ওদের নৌকার বহর বগি খাল এলাকায়। প্রায় দুই বছর ধরে ওরা নদীতে কোনো অভিভাবক ছাড়াই মাছ শিকার শুরু করেছে। চার পরিবারের সন্তান ওরা চারজন প্রতিদিন যে পরিমাণ মাছ শিকার করে তা বিক্রি করে সমানভাবে টাকা ভাগ করে নেন পরিবারের অভিভাবকরা।

 

 

তেঁতুলিয়া নদীর চর মুয়াজ্জিনের দক্ষিণ পার্শ্বে দেখা গেছে অসংখ্য শিশু জীবিকার তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরছে। ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী ওই শিশুরা কিনারাহীন তেঁতুলিয়া নদীতে কেউ জাল, কেউ বা বড়শি দিয়ে মাছ ধরে। তাদেরই দুজন মঙ্গল আলী (৮) ও শুক্কুর আলী (১০)। মান্তা সম্প্রদায়ের এ দুই শিশু সম্পর্কে ভাই। বছরের সব মৌসুমেই ওরা নদীতে মাছ ধরে। নৌকা নিয়ে বড়শি দিয়ে নদীর গভীর পানিতে মাছ শিকার করা তাদের নিয়মিত কাজ। দৈনিক ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা পর্যন্ত দুই ভাই মাছ শিকার করে আয় করে। কখনো আবার খালি হাতে ফিরতে হয় তাদের। মঙ্গল ও শুক্কুরের বাড়ি বরিশাল সদর উপজেলার সাহেবেরহাট এলাকায়। নদীভাঙনের শিকার হয়ে এদের মা-বাবা নৌকায় বসবাসের জীবন শুরু করেছে। বর্তমানে তাদের নৌকা বহরের অবস্থান পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বগি খালে। সকাল-সন্ধ্যা তাদের কাজই শুধু মাছ শিকার।

 

 

শুক্কুর আলীর বক্তব্য, ‘এক বচ্ছর আগে বইন্যায় (ঝড়ে) আমাগো দুই ভাইর নৌকা তলাইয়া গ্যাছেলে, কাঠ ধইরগা বাঁচ্চি দুইজনে। পরে একটা ট্রলারের লোকজন আইয়া আমাগোরে নদীর তোন উডাইছে।’ বর্ষা মৌসুমে কিংবা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় এ রকম শিশু জেলেদের নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে প্রতিবছরই।

 

 

কারণ হিসেবে মান্তা পরিবারের একজন অভিভাবক আব্দুল আলী বলেন, ‘গুরাগ্যারায় ঝড়-বইন্যার সোময় নৌকা ঠিকমতো দইরগা রাখতে পারে না। হেইয়ার লইগ্যা ডুইব্বা যায়।’

 

 

আব্দুল হাই সরদার বলেন, ‘আমাগো তো উপায় নাই। মাছ তো সব সময় পাওন যায় না। এ লইগ্যা পরিবারের খরচ মিডাইতে ছোড-বড় সবাই মাছ ধরে নদীতে।’

 

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পটুয়াখালী জেলার বিভিন্ন নদী ও খালে নৌকায় ভাসমানভাবে বসবাস করা পাঁচ থেকে সাত বছরের শিশুর সংখ্যা প্রায় চার হাজার। মূল ভূখণ্ডের সাথে মান্তা পরিবারের স্থায়ী যোগসূত্র না থাকায় এসব প্রান্তিক আয়ের পরিবারগুলোর শিশুদের ভবিষ্যৎ মানে কালো অন্ধকার। অধিকারহারা এসব শিশু জীবনের তাগিদে জীবিকার সন্ধানে ঝুঁকছে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায়।

 

 

অবহেলিত হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্পিড ট্রাস্টের বিভাগীয় সমন্বয়কারী মো. হেমায়েত উদ্দিন বলেন, ‘মান্তা শিশুদের শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এসব বিষয়ের ওপর সরকারের সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। স্থায়ী বসতির মাধ্যমে মূল ভূখণ্ডে এদের পুনর্বাসন করা হলে এরা এই সমাজব্যবস্থার মূল স্রোতে ফিরবে। তা না হলে এখন যে ধারায় এরা রয়েছে তাতে মনে হয় সভ্য এবং আধুনিক সমাজব্যবস্থায় এ দেশের নাগরিক হয়েও ভিন গ্রহের মানুষই থেকে যাবে।’

 

 

বিষয়টি নিয়ে পটুয়াখালী সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক শিলা রানী দাস বলেন, ‘এসব জনগোষ্ঠীর শিশুরা যদি লেখাপড়া করে তাহলে সমাজসেবা দপ্তরের মাধ্যমে উপবৃত্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। আর এ সুবিধা পেতে হলে অবশ্যই ওই পরিবারকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। পরিচয়পত্র থাকতে হবে অভিভাবকদের। কিন্তু এরা ভাসমান হওয়ায় অনেকেরই পরিচয়পত্র নেই। পুনর্বাসনের মাধ্যমে এদের জীবন মান পরির্বতন করা সম্ভব।’

 

 

টিকার ছোঁয়া নেই কারো শরীরে

 

 

দুই সন্তানের জননী রাহিমা বগম। ১৬ বছর বয়স তার। সন্তান মস্তফা ও ইউনুচের বয়স যথাক্রমে একজনের দুই বছর, অপরজনের আট মাস। মা ও দুই সন্তান কারো শরীরে মাতৃত্বকালীন কিংবা শিশু বয়সের একটি টিকা স্পর্শ করেনি। মা রাহিমা বলেন, ‘আমাগো দারে কেউ আয় না, আমরা টিহাও (টিকা) দেই না। এই টিহার কতা আমরা কিছুই জানি না। টিহা না দেলেও বা কী অয়। আমরা তো ভালোই আছি!’

 

 

নিরাপদ মা হওয়ার জন্য টিকা পায়নি রাহিমা। আবার তার দুই শিশু মস্তফা ও ইউনুচও ঝুঁকিপূর্ণ রোগের প্রতিষেধক ইপিআইয়ের টিকা থেকে বঞ্চিত হয়ে বেড়ে উঠছে। অথচ কথা ছিল রাহিমা মা হওয়ার আগে ১৫ বছর বয়স থেকে পর্যায়ক্রমে পাঁচটি টিটেনাস টকসাইড (টিটি) টিকা পাবে। প্রথম টিকা নেওয়ার এক মাস পর দ্বিতীয়টি, এর ছয় মাস পর তৃতীয়টি, এর এক বছর পর চতুর্থ এবং আরেক বছর পর পঞ্চম টিকা পাওয়ার কথা। কিন্তু ওই টিকার ডোজ ছাড়াই মা হয়েছে রাহিমা। পক্ষান্তরে তার দুই সন্তান মস্তফা ও ইউনুচেরও একই অবস্থা। মস্তফার বয়স দুই বছর পেরিয়ে গেলেও একটি টিকা দেওয়া হয়নি। আবার ইউনুচের বয়স আট মাস অতিবাহিত হয়েছে, সেও পায়নি টিকা।

 

 

শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ রোগ থেকে মুক্তির জন্য সরকার বাধ্যতামূলক ছয়টি টিকা পর্যায়ক্রমে বিসিজি বা যক্ষ্মা (জন্মের পরপর), পেন্টা বা (জন্মের ৪২ দিন হলেই), ডিপিটি বা হেপাটাইটিস-বি, হিপ, ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার ডোজ, বিওপিভি বা পলিও ভ্যাকসিন (জন্মের ১৪ দিন মধ্যে প্রথম ডোজ), পিসিভি বা নিউমোকক্কালজনিত নিউমোনিয়া (শিশুর বয়স ছয় সপ্তাহ থেকে এর ডোজ শুরু হয় মোট তিনটি ডোজ) আইপিভি বা ইন অ্যাকটিভেট পোলিও ভ্যাকসিন এবং এমআর বা হাম ও রুবেলা (প্রথম ডোজ ৯ মাস পূর্ণ হলে এবং ১৫ মাস পূর্ণ হলে দ্বিতীয় ডোজ)।

 

 

রাহিমার স্বামী খোরশেদ সরদার বলেন, ‘আমরা সবাই নৌকায় থাহি, এহানে তো কেউ টিহা লইয়া আয় না। সরকার আমাগোরে তরে (স্থল বা মূল ভূখণ্ড) থাহার ব্যবস্থা কইরগা দেলে আমাগো গুরাগ্যারায় (সন্তান) টিহা পাইতে।’

 

 

শুধু রাহিমা-খোরশেদ দম্পতির সন্তানরাই টিকাবঞ্চিত হচ্ছে না, মান্তা পরিবারের সব শিশু এবং শিশু মায়েরা ঝুঁকিপূর্ণ রোগের টিকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ ওই সব টিকার সাথে এরা সম্পূর্ণ অপরিচিত। প্রতিবছর হাজার হাজার শিশু ওই সব টিকা ছাড়াই বেড়ে উঠছে।

 

 

একই বহরে থাকা পাঁচ সন্তানের জননী পিয়ারা বেগম (৩০) বলেন, ‘এইহানে (এখানে) যতগুলা নৌকা দ্যাহেন এই সব নৌকায় যতগুলা পোলাপান দ্যাহেন একটা পোলাপানও কোনো টিহা পায় নাই। আমাগোরে কেউ কিছু দেয় না, ভাই। আমরা নৌকার মানুষ, এই লইগ্যা সবাই আমাগোরে বাদ দিয়া কাম করে। মানুষ বইল্লা (হিসাবে) আমাগোরে সরকার, মেম্বার, চেয়ারম্যান কেউই মনে করে না। আমার পাঁচটা পোলাপান অইছে কেউ একটা টিহা পায় নাই।’ একই অভিযোগ করেন দুই সন্তানের জননী ময়না বেগম, তিন সন্তানের জননী আসমা বেগম, চার সন্তানের জননী সাহারা খাতুন।

 

 

বগি খালের মান্তা বহরে এমন অভিযোগের সাথে সহমত পোষণ করেন গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি ও রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ এলাকার স্লুইস বাজার খালের মান্তা বহরের লোকজন। পানপট্টি বহরের চার সন্তানের জননী নয়ন তারা, পাঁচ সন্তানের জননী সুরাইয়া বেগম, তিন সন্তানের জননী রেহেনা বেগম, বগি খালের পিয়ারা বেগমের মতোই একই সুরে কথা বলেন।

 

 

তাঁদের দাবি নৌকায় বসবাসের পরির্বতে স্থলে বসবাসের সুযোগ পেলে তাঁদের সন্তানরা ওই সব টিকার সুবিদা পেত। চরমোন্তাজ স্লুইস বাজার খালের আসমা বেগম দ্বিতীয় সন্তানের মা ১০ দিন আগে। ইপিআইএর টিকা সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকলেও আসমা বলেন, ‘স্যার আমাগোরে মাগনা (বিনা মূল্যে) টিহা (টিকা) দেয় না। অন্য কোনো কিছুই দেয় না মাগনা।’ আসমার কোনো সন্তান পায়নি একটি টিকাও।

 

 

এ ছাড়া ইপিআই কার্যক্রমের আওতায় বছরে দুইবার শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানো হয় বছরে দুইবার। গর্ভবতী মায়েদের এএনসি ও পিএনসি নামের দুটি সেবা প্রদান করা হয় মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে। অর্থাৎ গর্ভকালীন অবস্থায় একবার এবং সন্তান প্রসবের পর আরেকবার মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার কথা এবং সন্তান প্রসবের পর ৪২ দিনের মধ্যে মাকে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কথা থাকলেও এসব কোনো সুবিধা পায় না মান্তা জনগোষ্ঠীর শিশু ও মায়েরা।

 

 

এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনার টিকাও এরা পাচ্ছে না। কারণ তাদের অনেকেরই ভোটার আইডি কিংবা জন্ম সনদ নেই। মান্তা পরিবারের সদস্য নূপুর (১৪), মরিয়ম (১৪), শাবনুর (১৬) এরা সবাই বাল্যবিয়ের কারণে মা হয়েছে। এমনই ওই জনগোষ্ঠীর জন্ম সনদ কিংবা ভোটার আইডি না থাকার কারণে বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যরা করোনার ভ্যাকসিন থেকে বঞ্চিত।

 

 

মান্তা পরিবারের অভিভাবকরা জানান, তাঁদের একসময় জমি ছিল, ঘর-বাড়ি, ভিটেমাটি সবই ছিল। ছিল স্থায়ী ঠিকানাও। কিন্তু বিভিন্ন নদীর হিংস্র থাবায় সব হারিয়ে এখন পানির ওপর নৌকায় বসবাস করছেন। সরকার নদীতীরবর্তী এলাকায় ওই সব পরিবারকে আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে ঘর এবং চরাঞ্চলে জেগে ওঠা খাসজমি বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করলে পুনরায় আবার তাঁরা স্থায়ী ঠিকানার বাসিন্দা হবেন। তখন বঞ্চিত না হয়ে পাবেন সরকারি সব সেবা।

 

 

বাউফল উপজেলার বগি এলাকায় দায়িত্বরত ইপিআই অস্থায়ী টিকাদান কেন্দ্রের স্বাস্থ্য সহকারী করুণা রানী বলেন, ‘এদের নিয়মিত পাওয়া যায় না, এ কারণে এরা ইপিআই সেবা থেকে বঞ্চিত। ঘরবাড়ি যাদের আছে তারা সবাই টিকা পায়। এরা ভাসমান হওয়াটাই মূল সমস্যা।’

 

 

বাউফল উপজেলা মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট ইপিআই মো. মাসুদুজ্জামান বলেন, ‘ইউপিআইর ভিটামিনের ডোজ এবং টিটি ভাসমান মানুষরা পায়। তবে সব টিকা এরা পায় না। এর প্রধানতম কারণ স্থায়ী বসতি না থাকা।’

 

 

মহিলাবিষায়ক কর্মকর্তা শাহিদা বেগম বলেন, ‘ভাসমান হওয়ায় আমরা এই মান্তাদের সচেতনও করতে পারছি না। এদের জন্য একটি পরিকল্পনা করে স্থায়ী বসতির আওতায় নিয়ে আসা হলে বাল্যবিয়ে বন্ধসহ এদের জীবনে ছন্দ ফিরে আসবে।’

 

 

বাউফল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার সাহা বলেন, ‘টিকা খাওয়ানোর বিশেষ দিবসগুলোর টিকা এরা পায়। তবে সব টিকা পেতে হলে স্থায়ী বসবাস থাকা প্রয়োজন। এরা আজ এখানে তো কাল অন্য কোনো স্থানে, এটাই সমস্যা। তবে স্থায়ী বসতি হলে কিংবা ভোটার হলে জটিলতা থাকে না। বসতির অভাবে কেউ এভাবে টিকাবঞ্চিত হলে রোগ নির্মূল করা সম্ভব হবে না।’

 

 

স্কুলে যাওয়ার তৃষ্ণা

 

 

ওদের কারো নাম সুমন। কেউ রফিক। কারো নাম মৌসুমী। আবার কারো নাম সাথী। ওদের আসল পরিচয় ওরা মান্তা পরিবারের সন্তান। ওদের অতীত নেই, বর্তমান আছে, ভবিষ্যৎ মানে কালো অন্ধকার। তেঁতুলিয়াপারের বগি এলাকার এসব শিশু নদীতে মাছ শিকার করে। কখনো নদীর জলে দলবদ্ধ হয়ে ডুবসাঁতারে খেলে। কখনো আবার তীরে উঠে কানামাছি, চাড়া খেলা, দড়ি লাফ, দাঁড়িয়াবান্ধাসহ নানা খেলায় মেতে ওঠে। কিন্তু এরা কেউ স্কুলে যায় না।

 

 

নৌকায় বসবাস করা এসব মান্তা শিশুর জন্য নদীতে কোনো স্কুল নেই। আর অভাব মেটাতে এসব শিশু তীরে এসে স্কুলে যাওয়ার সময় পায় না, তাই ওরা লেখাপড়াবিমুখ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই চলছে। পটুয়াখালী জেলার কয়েক হাজার মান্তা পরিবারের শিশু স্কুল, বই, খাতা, কলম, শিক্ষার এসব উপকরণের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত।

 

 

সরেজমিনে মান্তা পল্লীর বগি, পানপট্টি, কোড়ালিয়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, শিশুরা বয়স্কদের মতো কেউ মাছ শিকারে নদীতে ব্যস্ত, কেউ আবার নদী থেকে ফিরে নানামুখী খেলাধুলায় ব্যস্ত। পানপট্টি এলাকায় অবস্থান করা শিশু শাকিল (৮) বলে, ‘স্যার, আমাগো তো ঘরবাড়ি নাই। এক বেলা মাছ না ধরলে আরেক বেলা ভাত খাইতে পারি না। আমনেই কন (বলেন), নৌকার তোন (নৌকা থেকে) তরে উইট্টা স্কুলে যামু না মাছ ধইরগা প্যাড বাঁচামু?’

 

 

দলবদ্ধ হয়ে শাকিলের কথার সাথে একমত হয়ে ইমন, নয়ন, আয়শা, ফাতেমা, শাবনুর, নুর আলম, বিলকিস প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলে, ‘স্যার আমনে কন (আপনি বলেন), প্যাড বাঁচামু, না স্কুলে যামু?’ বগি এলাকার ৯ বছরের মান্তা শিশু রফিক আক্ষেপ করে বলে, ‘তরের গুরাগ্যারা (শিশুরা) স্কুলে যায়, ল্যাহাপড়া করে, হেরা ল্যাহাপড়া কইরগা বড় অইয়া অফিসার অয়, শিক্ষিত অয়। স্যার আমাগোও লেহাপড়া করতে মোন চায়। হ্যাগো মোতন (তাদের মতো) অইতে ইচ্ছা করে। আমাগো হেই ব্যবস্থা নাই। আর আমাগো টাহা-পয়সাও নাই। মাছ ধরনে যে কত কষ্ট হ্যা (তা) আমরা বুঝি। স্কুলে যাইয়া ল্যাহাপড়া করতে পারলে মানুষ অইতাম।’

 

 

এ কথাগুলো বলার সময় রফিকের সাথে প্রায় ২০-এর অধিক শিশু উপস্থিত ছিল। তাদেরও স্বপ্ন বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার। বিদ্যার বর্ণ শিখে চোখের আলো ছড়িয়ে সব লিখতে চায় ওরা এবং বিশ্বকে জানতে সব কিছুই পড়তে চায়। কিন্তু স্কুলের ঘণ্টা বাজার শব্দ এসব মান্তা শিশুদের তাড়িত করলেও অবস্থান আর অভাবের কাছে এরা বারবার পরাজিত।

 

 

মান্তা পরিবারের বিভিন্ন অভিভাবকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরাও বর্তমান যুগের সাথে সমান তালে থাকতে চান। তাই তাঁদের নৌকায় এখন ব্যবহার করেন সৌরবিদ্যুৎ, রয়েছে টেলিভিশনও। মোবাইল আছে অধিকাংশ নৌকায়। নদীতে অবস্থান এবং অভাবের ফলে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারেন না।

 

 

আরশেদ সরদার (৬৫) বলেন, ‘আমরা ভাসান জীবন বাদ দিতে চাই। সরকার যদি আমাগোরে নদীর ধারে ঘরবাড়ি কইরগ্যা দেয় তাহেলে আমাগো পোলাপনও লেহাপড়া করতে পারবে। দ্যাহেনই তো আমনেগো আতে (হাতে) মোবাইল আছে, আমাগোও মোবাইল আছে। আমনেগো টিপি (টিভি) আমাগো টিপি আছে। আমাগো নাই ল্যাহাপড়া।’

 

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পটুয়াখালী জেলার ১৪টি স্থানে মান্তা পরিবারের নৌকার বহর রয়েছে। ওই সব বহরে দুই হাজারের অধিক শিশু প্রতিবছর স্কুলে ভর্তির বয়স হলেও (পাঁচ বছর) স্কুলে যায় না। বিভিন্ন মান্তা পল্লী ঘুরে দেখা গেছে স্কুলে যেতে সক্ষম প্রায় চার হাজারের অধিক শিশু স্কুলবিমুখ। যত দিন যাচ্ছে ততই মান্তা পরিবারের নিরক্ষরের সংখ্যা বাড়ছে। শিশু বয়স থেকেই ওই সব শিশু পেশায় জেলে। নদীতে মাছ শিকার করে লেখাপড়ার পরির্বতে সংসারে আয়ের জোগান দেয়।

 

 

এ ব্যাপারে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘মান্তাদের জীবন চলে, জীবিকাও চলে। কিন্তু শিক্ষা নেই মান্তা শিশুদের। স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার অভাবে এ জনগোষ্ঠীর শিশুরা বিদ্যার্জন করতে পারছে না। এই জনগোষ্ঠী ভাসমান থাকায় ভোটার হতে পারছে না। আমরা ইতিপূর্বে রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজের ভাসমান ২৯ পরিবারকে ঘর তৈরি করে দিয়েছি, বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে তাদের ঘরে। আর সরকারি সুবিধা পেতে সবাইকে ভোটার হতে হবে। আমরা তাদের ভোটার করারও ব্যবস্থা করেছি। ওখানে একটা স্কুল করে দেওয়া হবে। গলাচিপা উপজেলায় ১০ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। বাউফল-দশমিনা সীমানায় বগি খালে বসবাস করা অনেককে পুনর্বাসন করা হয়েছে। বাকি সবাইকে পুনর্বাসন করা হবে এ বছর। সবার ভোটার আইডি করে দেওয়া হবে। যাতে এই জনগোষ্ঠী সরকারের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে।’

 

 

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোল্লা বখতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমি ভাসমান জনগোষ্ঠী মান্তাদের নাম কখনো শুনিনি। খোঁজ নিয়ে এদের জরিপ করে স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে।’

 

 

পটুয়াখালীতে শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিটির সভাপতি শ ম দেলোয়ার হোসেন দিলিপ বলেন, ‘একটি শিশু তার মৌলিক অধিকার নিয়ে বড় হবে, রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবে। যেহেতু মান্তা শিশুরা তাদের সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত, তাই রাষ্ট্র এ প্রজন্মকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। এদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে, এটাই আমাদের দাবি। আর আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। মান্তাদের নদী তীরবর্তী এলাকায় আবাসান প্রকল্পের মাধ্যমে স্থায়ী বসবাস নিশ্চিত করতে পারলে এদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, ফিরে পাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বাসস্থানের অধিকার।’

সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করুন



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *










Facebook

© ভয়েস অব বরিশাল কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed BY: AMS IT BD