শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ন
শাকিব বিপ্লব:
নবনির্বাচিত বরিশাল সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে নিয়ে প্রশংসা-বন্দনার শেষ নেই। বিজয় হওয়ার পর চারিদিকে তাকে নিয়ে অভাবনীয় উচ্ছ্বাস। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। জোয়ার যেদিকে বয় সেদিকেই সবাই নৌকা বায় তথা গা-ভাসাতে চায়। এটা বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অথচ এই সাদিক আবদুল্লাহ বরিশাল রাজনীতিতে একটি শক্ত পোক্ত অবস্থান তৈরিতে কতনা প্রাণন্তকর চেষ্টা করতে দেখা গেছে। রাজনীতির গোড়াপত্তনে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটিতে স্থান পাওয়া নিয়ে সাংসদ জেবুন্নেছা আফরোজ সমর্থিত এককথায় তার প্রয়াত স্বামী শওকত হোসেন হিরন অনুসারীদের সাথে শক্তির দৌঁড়ে এই যুব বয়সী নেতাকে এক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে।
তৎসময় দেখা গেছে, সাদিক সমর্থিতদের অল্পতেই চিহ্নিত করা যেত সংখ্যাগত কম থাকায়। প্রয়াত সাংসদ শওকত হোসেন হিরনের মৃত্যুর পর রেখে যাওয়া জনপ্রিয়তার জোয়ারে তার স্ত্রী বছর দুয়েক আগেও বরিশালে একচেটিয়া প্রভাব ধরে রেখেছিলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি কথা চালু ছিল- শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমু এমপি নেপথ্যে থেকে বরিশালের সাংসদ জেবুন্নেছাকে সমর্থন দেওয়ায় সাদিক আবদুল্লাহ অনেক ক্ষেত্রেই পেরে উঠছিলেন না। প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহল সাদিককে অসহযোগিতা করতেও শোনা গিয়েছিল, দেখাও যায়। এমনকি বরিশালের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ নিয়মানুসারে প্রধান অতিথি থাকার কথা থাকলেও সেখানে ছিলেন শিল্পমন্ত্রী। তখন লিখেছিলাম- “হাসানাতের রাজত্বে আমু’র ক্ষমতা”।
সময়ের পালা বদলে পাল্টে যায় সেই চিত্র। সাদিক ধীরে ধীরে মাঠ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। হিরন সমর্থিত বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মি সাদিকের গ্রহণযোগ্যতার কাছে নতি স্বীকার করে তার সমর্থনে কালিবাড়িমুখী হতে থাকে। এমন দৃশ্যও দেখা গেছে, যেখানে জেবুন্নেছার বাসায় কর্মি সমর্থকদের ভীড়ে ঠাসা ছিল, সেই বাসায় তার কুশীলবদের যাতায়াত সীমিত হয়ে পড়ে। ভীড় বাড়তে থাকে সাদিকের কালিবাড়ি বাসায়। কেউ বলে, সাদিকের কারিশমা। আবার কারো মন্তব্য জেবুন্নেছার ব্যবহার ও সাংগঠনিক অদূরদর্শিতার কারণে তরুন নেতা সাদিকের রাজনৈতিক পথ সুগম হয়ে যায়। দলের মধ্যে আওয়াজ ওঠে, জাপা নেতা এরশাদের মত জেবুন্নেছা সিদ্ধান্তহীনতা বা কখন কি করেন, বলেন, তা নিজেই জানেন না।
এ অবস্থায় আমীর হোসেন আমু নবাগত নেত্রী জেবুন্নেছার ওপর থেকে আশির্বাদের হাত সরিয়ে ফেলায় অনেকটা একাকী হয়ে পড়েন। রাজনীতির কি খেলা, যে জেবুন্নেছা নেতৃত্বের লড়াইয়ে সাদিক আবদুল্লাহ এবং তার পিতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ’র ছায়াও মাড়াতেন না, সেই জেবুন্নেছাই ঝালকাঠির পথ রেখে আগৈলঝাড়ায় যাতায়াত বাড়িয়ে দেন। রাজনৈতিক গুরুর মর্যাদায় ‘ভাই’ সম্বোধন করে মিলেমিশে যান অঘোষিতভাবে। সাদিককে দলীয় মেয়র প্রার্থী হিসেবে জেবুন্নেছাই প্রথম দেখার ঘোষণা দেন, আবার সাদিকের মনোনয়নপত্র তিনি নিজেই ক্রয় করেন। অন্যদিকে, জেবুন্নেছার সমর্থিতরা সাদিক অনুসারীদের তোপের মুখে ঠিকই দৌঁড়ের উপর থাকতে হয়। এখন এই বৈষম্য কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। নচেৎ জেবুন্নেছা অংশের নেতা সাবেক মহানগরের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. আফজালুল করিম ও মহানগর ছাত্রলীগ সভাপতি জসিম উদ্দীন এখন সাদিক আবদুল্লাহ’র কাছে ভীড়তে পারতেন না। তবুও কিছু কিছু নেতার কারণে ঘোর হিরনসমর্থিত অনেককে এখনও দূরত্বে রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে একসময় হিরনের চারপাশে থাকা বেশ কয়েকজন নেতা ভোল পাল্টে এতটাই সাদিক আবদুল্লাহর আস্থাভাজন হয়েছেন যে, তারাই অনেককে দূরত্বে রাখার পরামর্শ দেন বলে শোনা যায়। কালীবাড়ি সড়কে গিয়ে দেখা যায়, সাদিক আবদুল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভের জন্য দুয়ারে দাঁড়ালে হাসান মাহমুদ বাবু অনেককে নানা অজুহাতে তাড়িয়ে দেন উগ্রতার সাথে। গ্যাস্ট্রিক বাবু নামে পরিচিত এই যুব নেতা এক সময় প্রয়াত নেতা হিরনের পাশে থেকে হাসানাত পরিবারকে যে ভাষায় খিস্তিখেউর করেছিল তা আর বলতে চাই না। আফসোস লাগে, রাজনীতিতে অতটা দক্ষতা না থাকলেও এরাই এখন সাদিক আবদুল্লাহর উপদেষ্টা (!)
অথচ দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে দীর্ঘদিন ধরে চলা মাহমুদুল হক খান মামুনের ন্যায় নেতাকে এখন সংগঠন ত্যাগ করে ঘরে থাকতে হয়। দলের মধ্যে নীতি-আদর্শের লড়াই থাকাটাই স্বাভাবিক। দীর্ঘকাল রাজনীতি করলে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ার চাওয়াটাও অমূলক নয়। উচিত সাদিকের আগামীর রাজনৈতিক ভবিষ্যত কন্টকময় করতে মাহমুদুল হক খান মামুনদের মত নেতাকে কাছে ভেড়ানো। এমন নেতাইতো হওয়া উচিত যে ব্যবহারের গুনে দলের মধ্যেকার রাগ-অভিমান থাকা নেতারাও স্বাভাবিক হয়ে যান।
কিন্তু লক্ষণতো তা বলে না। কিভাবে তারা একত্রিত হবে? তাদের মতো নেতাদের দূরে রাখার পরামর্শদাতা কম আছে নাকি। মূলত অযোগ্যরাই যোগ্যদের ভয় পায়। অনেকের মন্তব্য- সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র হিসেবে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে সন্দেহ সংশয় দেখা দিলে তার চার পাশে থাকা অনেক দায়িত্বশীল নেতা সম্ভাবনাময় অপর এক প্রার্থীর সাথে তলছা যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছিল। এদের অনেকেই চায়নি সাদিক মেয়র হোক। যখন তার দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত হয়ে যায় তখনই এই বিরোধীরাই নির্বাচনী মাঠে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বিষয়টি এখন সাদিক আবদুল্লাহর অনুধাবনে আনা উচিত।
সবদিক মিলিয়ে রাজনীতির দৌঁড়ে সাদিক আবদুল্লাহকে সফলই বলা যায়। যুব বয়সী এই নেতা রাজনীতির পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে এতদূর এলেন, হলেন বরিশাল সিটি মেয়রও। আবার রেকর্ডও গড়লেন ভোট প্রাপ্তিতে। তার চেয়ে বড় কথা পিতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ’র বরিশাল শহর রাজনীতিতে যা পারেননি তা সাদিক করে দেখালেন। দলের মধ্যে বিভাজন পিছে ফেলে ঐক্য গড়ে তুললেন, যা দেখা গেল ভোটের মাঠে। নিন্দুকদের ভাষ্য ভিন্নতা। তারা বলছে, পিতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ’র জোরেই পুত্র সাদিকের এই উত্থান। পিছনে ফিরে তাকালে এই দাবি ধোপে টিকে না। যখন জেবুন্নেছা আফরোজ একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর সমর্থন পুষ্ট হয়ে বরিশাল নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছিলেন তখন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ তার পুত্রের রাজনৈতিক বিষয়ে ছিলেন নীরব।
সেই পুত্র সাদিকের বৃহস্পতি তুঙ্গে উঠার পরেই দেখা যায় পিতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে। পিতার সহায়তা নয়, সাদিকের সাংগঠনিক কারিশমা এবং আজকের এই সাফল্যকে যদি হিরনের রাজনীতি অনুকরণের ফল বলা হয় তবে তা অতিরিক্ত হবে না। কারণ হিরন যে আদর্শ ও উন্নয়ন এবং সর্বোপরি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নগরবাসীকে দেখিয়ে ছিলেন তা তরুন নেতা সাদিকের মাঝে দেখা যায়। সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বটে। কিন্তু সাদিক ভোটের প্রচারণায় এমন কিছু ভূমিকা দেখিয়ে বিশেষ একটি ইমেজ তৈরিতে সক্ষম হয়েছিলেন। হাঁটু পর্যন্ত পানিতে নেমে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখা, গাড়ি ফেলে রিকশায় চড়ে নগরীতে সাধারণ মানুষের বেশে ঘুরে ও সড়কপথে পাগলের সাথে আলাপ-চারিতার স্পর্শকাতর আরো অনেক দৃশ্য সাদিককে নিয়ে গেছে হিরনের গুণের কাছাকাছি। যা ভোটারদের মনে ইতিবাচক দাগ কেটে অনায়াসেই সহানুভূতি বেড়েছে। সে কারণে ভোট নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সাদিকের বিজয়ে এ বিতর্ক ঢাকা পড়ে এক ধরনের উচ্ছাস তৈরী হয়েছে।
বিপরীতে শংকাও জেগেছে সাদিকের এই জোয়ার কতদিন থাকবে। তার চারপাশে থাকা রাজনৈতিক অদক্ষ ও তোষামোদিরা এখন বেশিমাত্রায় সাদিককে ঘিরে ধরেছে। দিচ্ছে নানা কান-উপদেশ। প্রয়াত নেতা হিরনের জনপ্রিয়তার সময় এমনটি দেখা গিয়েছিল। নেতাকে এতটাই তোষামোদি করেছিলেন তাতে হিরন বেশ কিছু লোককে রাতারাতি অর্থ-বিত্তের মালিক বানিয়ে দেন। তাদের অনেকের একসময় তিনবেলা ভাত খাওয়া দুরূহ বিষয়। এই তোষামোদকারীদের কারণেই হিরনের অনেক ভুল সিদ্ধান্ত সিটি নির্বাচনে পরাজয়ে পিছনের কারণ ছিল। সাদিক সবেমাত্র মেয়র হয়েছেন। কিন্তু সেই হিরনের আমলের মতই অনেকে টাকা বানানোর নেশায় সাদিককে এখনই এমন বশ করে ফেলেছেন যে তাদের কথা ছাড়া কিছুই তিনি বোঝেন না। এদের একজনতো ইতিমধ্যে অর্থে-বিত্তে ফুলে উঠেছেন। আবার বিতর্ক সৃষ্টিতেও কম পারদর্শী নয়।
অতি উৎসাই এই নেতারাই এখন বিতর্ক সৃষ্টিতে বেশ ক্রিয়াশীল। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে বেশকিছু মিডিয়া। প্রতিদিন সাদিক আবদুল্লাহকে নিয়ে সংবাদের শিরোনাম তৈরি করছেন। কলমের কালি যতটুকু আছে তা দিয়ে নবনির্বাচিত এই মেয়রকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন। অথচ সাদিক সমর্থিত অনেক অনুঘটক নানা অপকর্ম করে ঠিকই থেকে যাচ্ছেন মিডিয়ার আড়ালে। লিখলে খবর আছে ভেবে, নতুবা নেতা নাখোশ হলে স্বার্থ ভঙ্গ হতে পারে এমন আশংকায় তা চেপে যাওয়াই শ্রেয় মনে করছে। যতদূর ধারনা মেলে- রাজনীতিতে সাদিক আবদুল্লাহ অতটা কূটকৌশলী নন। ফলে বুঝে উঠতে পারছেন না যে এই তোষামোদীরা ভোল পাল্টাতে সময় নেয়না।
জীবদ্দশায় শওকত হোসেন হিরন এই বরিশাল নগরীকে আধুনিকরণ করলেও দ্বিতীয় দফায় সিটি নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর তিনি অনুমান করেছিলেন এবং মন্তব্য করেন- আমার বাসার বারেন্দায় থাকা এতোদিনকার লোকগুলো কই গেলো? মিডিয়া নিয়েও তার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল দূঃসময়েই। সুতরাং সাদিক আবদুল্লাহ নিরাপদ ও উন্নয়নের বরিশাল তৈরীর পাশাপাশি কোন অন্যায় বরদাস্ত করবেন না বলে প্রতিনিয়ত যে প্রতিশ্রুতি এবং সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে সংশয় রয়েছে। নগরভবনে তার নাম ব্যবহার করে রুম দখল, কর্মকর্তাদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ, পেট্রোল পাম্প থেকে ছাত্রলীগ নেতার বিনামূল্যে তেল নেওয়া, পাশাপাশি এখন সাদিকের নির্বাচনী ওয়ার্ডভিত্তিক কার্যালয়গুলো স্থানীয় নেতাদের নিজস্ব কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হতে দেখা যাচ্ছে। তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে শুরু করেছে মোড়লপানা। ওয়ার্ড নেতাদের চারিপাশে থাকছে মাদক বিক্রেতা অথবা ক্যাডার হিসেবে চিহ্নিত যুবক দল।
এসব কিসের আলামত বহন করে? আবার ব্যক্তি ৎ-বিশেষকে বাদ-বিচার না করে আওয়ামী লীগে যোগদানের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এভাবেই বহুল বিতর্কিত সদ্য নির্বাচিত কাউন্সিলর নূর ইসলামকে দলে ভেড়াতে মুজিব কোর্ট পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সাদিকের পাশে থাকা এই অনুঘটকরাই এইসব উদ্যোগ নিয়ে বিতর্ক যেভাবে সৃষ্টি করছে তাতে নতুন এই মেয়রকে নিয়ে নগরবাসীর উচ্ছ্বাস যেন ফিকে হয়ে না যায়? বয়সে নবীন ও যার মধ্যে হিরনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া গেছে, সেই সাদিক আবদুল্লাহর কাছে প্রত্যাশা যে অনেক।
Leave a Reply