শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১৩ পূর্বাহ্ন
আলম রায়হান
বরিশাল সিটি নির্বাচন দেখতে দুই দফায় ১৪ দিন ছিলাম বহু স্মৃতিঘেরা প্রিয় শহরে। দ্বিতীয় দফায় ছিলাম ২৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত। এরপর প্রিয় নৌ-পথে অপ্রিয় ঢাকা যাত্রা। প্রায় নয় দিনের টানা ক্লান্তি এবং নানান আশংকার ধকল কাটিয়ে রোদ-বৃষ্টির পরন্ত দুপুরে নৌ-ভ্রমণ; সে এক অন্যরকম ভালোলাগার বিষয়। এই আনন্দ অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয় কলেজ জীবনের হাসিখুশি বন্ধু কামালের সঙ্গে দেখা হওয়ায়। তবে এটি হয়েছে অনেকটাই শেষের দিকে। আমরা মোটে ঘণ্টাখানেক একত্রে ছিলাম, ঢাকা সদরঘাটে তরী ভেরার আগ পর্যন্ত। আর ঘাটে নামার ঠিক আগ মুহূর্তে দেখা হয় ইকবাল হোসেন তাপশের সঙ্গে। অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। তিনি জাতীয় পার্টির ঘোষিত মেয়রপদ প্রার্থী এবং বহিষ্কৃত নেতা। খুবই শান্তভাবে বললেন, কেমন দেখলেন নির্বাচন? আমি বললাম, এতোটা না হলেও হতো! তিনি আমার শব্দ প্রয়োগ খুব পছন্দ করলেন; অথবা তাই করলেন যা অতিশয় ভদ্র মানুষেরা সাধারণত করে থাকেন। এরপর ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে ইকবাল হোসেন তাপস বললেন, আমরা ত্রিশ বছর আগের পরিস্থিতিকেও ছাড়িয়ে গেছি!
ইকবাল হোসেন তাপসের এ বক্তব্যের বিপরীতে বলার তেমন কিছু থাকে না। কারণ, যে দৃশ্যপট দেখা গেছে তাতে তিনি বেশ কমই বলেছেন। এর চেয়ে অনেক বেশি বলছে বরিশালবাসী। এটি নিঃসন্দেহে এমন এক দৃশ্যপট যা চোখে পড়বে যে কারো। যা দেখার জন্য গভীরে যাবার প্রয়োজন হয় না। তবে গভীরে গেলে দেখা যাবে, ৩০ জুলাইর নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বরিশালে আসলে পঁচাত্তরের থিংক ট্যাঙ্ক পরাজিত হয়েছে, নিদেন পক্ষে হোঁচট খেয়েছে বড়ধরনের। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পঁচাত্তর এবং একাত্তরের মধ্যে সরাসরি লড়াই হয়েছে। জিতেছে একাত্তর। আর এই বিজয় প্রক্রিয়া একেবারে ক্লেদমুক্ত- তা বললে সত্যের খুবই অপলাপ হবে। অনেকেই মনে করেন, ৩০ জুলাই বিজয় অনিবার্য থাকলেও তা বিতর্কের গ্রহণযোগ্য মাত্রার মধ্যে থাকেনি। এ ব্যাপারে বরিশালের আমার এক ফেসবুক বন্ধু মনে করেন, এ ক্ষেত্রেও হয়তো পঁচাত্তরের থিংক ট্যাংকের কারসাজি ছিল; ভোটের অস্বাভাবিক ব্যবধানই হচ্ছে এর প্রমাণ। এ অভিমত মেনে নিলেও এর বিপরীতে অন্যরকম বাস্তবতাও রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের সূচনা পৌরসভা হিসেবে। আর শুরুর কর্ণধার ছিলেন জে. সি প্রাইজ। তিনি ব্রিটিশ। প্রথম ভারতীয় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্যারিলাল রায়, ১৮৮৫ থেকে ১৮৮৮ পর্যন্ত। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৩ সালে প্রাচীন এ সংস্থার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর বাংলাদেশের চাকা উল্টোদিকে ঘোরে। বরিশাল পৌরসভার কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পান ডা. মো. আবদুল আজিজ। এরপর এ পৌরসভার চেয়ারম্যান হন আবদুর রহমান বিশ্বাস। পরে তিনি জেনারেল জিয়া সরকারের পাটমন্ত্রী হয়েছেন। খালেদা সরকারের সময় জাতীয় সংসদের স্পিকার ছিলেন, হয়েছেন রাষ্ট্রপতিও। ছোটখাট দেখতে এ মানুষটি রাষ্ট্রপতি থাকাকালে সামরিক বাহিনীর একটি অংশের ক্ষমতা দখলের দুর্বিনীত অপচেষ্টাকে হিমালয়ের দৃঢ়তায় রুখে দিয়েছেন। আর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত এই আবদুর রহমান বিশ্বাসের মাধ্যমেই শুরু হয় বরিশাল পৌরসভা আওয়ামী লীগের হাত ছাড়া হওয়ার দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া।
এরপরও ১৯৮৪ সালের পৌর নির্বাচনে অংশ নেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। কিন্তু জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম মাওলার কাছে নিদারুণভাবে ‘পরাজিত’ হন তিনি। অবশ্য ভোট গ্রহণের দিন সকাল ১১টার মধ্যেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী মাঠ ছাড়া করা হয়েছে বলে সম্প্রতি শুনেছি বর্তমানে ‘কিঞ্চিত সাংবাদিক’ ও ফুলটাইম উকিল ইসমাইল হোসেন নেগাবানের কাছে। আরও শোনা কথা, সেদিন আওয়ামী লীগকে মাঠছাড়া করার নেতৃত্বে ছিলেন আজকের বরিশাল বিএনপি নেতা ওবায়দুল হক চাঁন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর ২০১৮ সালের ৩০ জুলাইর নির্বাচনী ফলাফলে প্রায় ৪৩ বছর পর প্রথমবারের মতো বরিশালের নগরপিতার আসনে বসতে যাচ্ছেন ‘খাঁটি’ আওয়ামী লীগের সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। এর আগে কেতাবি হিসেবে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে বরিশালের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন শওকত হোসের হিরণ। তবে তিনি নওমুসলিমের মতো নব্য আওয়ামী লীগার ছিলেন। যৌবনে তিনি সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের যুবদল করেছেন, আরেক সামরিক শাসক এরশাদের সময় করেছেন জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবেই তিনি বরিশাল সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে বরিশালের মেয়র হয়েছেন। পরের মেয়াদে তিন একই পদে হেরেছেনও। ভোটের হিসেবে পরাজিত হলেও অন্যরকম বিজয় আছে তার; বরিশাল নগরীর উন্নয়নের জন্য মডেল হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তিনি। এজন্য শওকত হোসেন হিরণ আজও আলোচিত, সমাদৃত।
একইভাবে আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন মেয়র নির্বাচিত হবার পর আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে রুচি বহির্ভূতভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কারণে। যে বিষয়টি অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। এ ব্যাপারে কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে অস্বীকার করে যেমন আওয়ামী লীগ হয় না, তেমনই বরিশালে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর নগ্ন বিরোধিতাকারী এবং প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে অকথ্য ভাষা প্রয়োগের ব্যক্তিটিও আওয়ামী লীগার হতে পারেন না। ফলে ১৯৭৫ সালের পর ২০১৮ সালে, মানে ৪৩ বছর পর বরিশালের নগর পিতার আসনটি লাভ করলো প্রকৃত আওয়ামী লীগ। যে আসনে পিতা ছিলেন, সেই আসনে ফিরলেন পুত্র।
তবে একাজে কোনো শক্তি প্রয়োগ হয়নি, তা বলা নৈতিকতার মানদণ্ডে সাধারণভাবে হয়তো গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু বিকল্প কী ছিল? অপকৌশলে বাড়ির ভেতর কেউ ঢুকে অনবরত বাচ্চাকাচ্চা ফুটাতে থাকলে আপদ বিদায় করতে শক্তি প্রয়োগ ছাড়া আর কি কিছু করা থাকে! তবে রাজনৈতিকভাবে এই শক্তি প্রয়োগে বেশ বাড়াবাড়ি হয়েছে, তা মানতেই হবে। যদিও এই বাড়াবাড়ি না করলেও এবার বরিশালে পঁচাত্তরের থিংক ট্যাংক পরাজিত হতো বলে ধারণা পর্যবেক্ষক মহলের।
অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বিজয়ের জন্য দৃশ্যমান বাড়াবাড়ি করার কোনোই প্রয়োজন ছিল না। কারণ পুরো পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের পক্ষেই ছিল। কারণ একাধিক। এক. আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার পরিবর্তে বরিশালের রাজনীতি নিয়েই পড়ে আছেন; যার প্রাপ্তির কোটা কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে অনেক বছর আগেই। দুই. কেবল দল ও পিতার ওপর ভরসা করে বসে থাকেননি সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। তিনি সাংগঠনিক তৎপরতায় ছিলেন নিবেদিত প্রাণ; নির্বাচনী প্রচারণায়ও ছাড়িয়ে গেছেন সবাইকে। তিন. বিএনপির দোদুল্যমান অবস্থায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীকেই উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করেছে নগরবাসী। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী মুজিবুর রহমান সরোয়ার ছিলেন বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে। যেমন এক. সদ্যবিদায়ী মেয়র কামালের সব ব্যর্থতার দায় নিতে হয়েছে জনাব সরোয়ারকে। দুই. জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ, চারবারের সংসদ সদস্য এবং সাবেক সফল মেয়র মুজিবুর রহমান সরোয়ারের জন্য মেয়র পদটি তেমন রসালো বলে বিবেচনা করার সঙ্গত কারণ নেই। এরপরও তিনি প্রার্থী হয়েছেন একেবারে দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে। উল্লেখ্য, দলের সিদ্ধান্তে অন্তোষ থাকলেও তা অমান্য করার রেকর্ড তার নেই। আবদুর রহমান বিশ্বাসসহ বরিশাল বিএনপির প্রায় সব নেতা বিভিন্ন সময় দল ত্যাগ করেছেন; কিন্তু কখনো বিএনপি ত্যাগ করেননি অধ্যক্ষ ইউনুস খান ও মুজিবুর রহমান সরোয়ার। দলের প্রতি এই আনুগত্যের কারণেই জেনেশুনে বিষ পান করার মতো এবার মেয়র প্রার্থী হতে হয়েছে মুজিবুর রহমান সরোয়ারকে। কিন্তু শক্তভাবে দাঁড়াতে পারেননি। ফলে নির্বাচনী ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে! এব্যাপারে ১ আগস্ট প্রথম আলোর রিপোর্টের শিরোনাম হচ্ছে, ‘শক্তিতে না পেরে মাঠ ছেড়ে দেয় বিএনপি।’ প্রথম আলোর এই রিপোর্টে লেখা হয়েছে, ‘মুজিবুর রহমান সরোয়ার কেন্দ্রীয় নেতা ও বরিশালের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে কেন হাল ছেড়ে দিলেন, এই প্রশ্ন স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে। কেউ কেউ বলছেন, বরিশালে বিএনপি প্রার্থীর চিন্তা ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এজন্য তিনি সংঘাতে যাননি। অথবা তার সাংগঠনিক শক্তি ততটা ছিল না। আবার কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের কৌশলের সঙ্গে পেরে ওঠেননি।’
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, বরিশাল সিটি নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক যে দৃশ্যমান বাড়াবাড়ি হয়েছে তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এরপরও এই অপ্রয়োজনীয় কম্মটি করা হয়েছে। আবার ভোট গ্রহণের দিন বাড়াবাড়ি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী দুটি বাহিনীর কতিপয় সদস্যও। তবে তা পরিস্থিতি তেমন ঘোলাটে করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ। অনেকেরই নজরে পড়েছে, আসন্ন সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বরিশাল সিটি নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সামাল দিতে কাঁদানে গ্যাস অথবা গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেনি; এমনকি পুলিশকে মামুলি লাঠিচার্জও করতে হয়নি। অথচ নগরজুড়ে আতঙ্ক ছিল, ভোটের দিন শহরে রায়টের মতো অবস্থা সৃষ্টি হবে! হয়তো এ আশংকাকে আমলে নিয়েই নির্বাচনের দিন পর্যন্ত বিএমপির তিন মাসের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে তার টিমকে কাজে লাগিয়েছেন। অথচ তাকে বেকায়দায় ফেলার কতই না অপচেষ্টা হয়েছে ভিতরে-বাহিরে!
আলম রায়হান: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
Leave a Reply