রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:০৫ পূর্বাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক: ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার মেধাবী ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে নির্মমভাবে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচনার বিষয়। গত ৬ এপ্রিল নুসরাত জাহান রাফির গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এবং দীর্ঘ চারদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে গত ১০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান তিনি।
দেশের সর্বত্র এ নিয়ে প্রতিবাদ চলমান, এমনকি দেশের বাইরেও অনেকে রাস্তায় নেমেছেন এ ঘটনার প্রতিবাদে। আজ ১০ এপ্রিল এ আলোচিত হত্যার এক মাস পূর্ণ হলো। এ এক মাসে মামলার আসামিদের অনেকেই ধরা পড়েছেন (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন) পিবিআইয়ের জালে। তাদের অপেক্ষা মামলার চার্জশীট দাখিলের।
পিবিআই বলছে মামলার অগ্রগতি সন্তোষজনক। নুসরাতের পরিবার বলছে দ্রুত সময়ে চার্জশীট দিতে গিয়ে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীদের কেউ যেন বাদ পড়ে না যায় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
অপরদিকে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবীতে প্রতিবাদরত, নুসরাতের স্বজন ও সুহৃদদের মধ্যে সুবিচার পাওয়া নিয়ে তৈরী হয়েছে শঙ্কা।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর পরিদর্শক মো. শাহ আলম জানান, ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩এর ৪(১)/৩০ এর আলোকে মামলা দায়ের করা করা হয়। পুলিশ হেডকোয়ার্টার এর নির্দেশক্রমে পিবিআই মামলার তদন্ত গ্রহণ করে ১০ এপ্রিল।
মামলার তদন্ত গ্রহণের সাথে সাথে পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমারের নির্দেশে ফেনী ইউনিটসহ পিবিআই হেড কোয়াটার্স, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম মেট্রো ও পিবিআই নোয়াখালী ইউনিট দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে দ্রুত সময়ে ঘটনার নির্দেশদাতা, পরিকল্পনাকারী, অর্থদাতা, মদদদাতাসহ ঘটনার সাথে জড়িত আসামিদের গ্রেফতার করে।
তিনি বলেন, মামলায় এজহার নামীয় ৮ জনসহ মোট ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবিন্দ দিয়েছে ১২ জন। মামলার আলামত হিসেবে কিলিং মিশনে অংশ গ্রহণকারী শাহাদাত হোসেন শামীম, জোবায়ের হোসেন ও উম্মে সুলতানা পপির পরিহিত তিনটি বোরকা, ঘটনায় কেরোসিন ঢালার কাজে ব্যবহৃত একটি গ্লাস সংশ্লিষ্ট আলামত হিসেবে নেয়া সংগ্রহ করা হয়েছে। মামলার সুরতহাল প্রতিবেদন, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, নুসরাতের মৃত্যুকালীন জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও কিছু আলামত বিশেষজ্ঞদের মতামতের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। মামলার ডকেটিং সহ আনুষাঙ্গিক কিছু কাজ শেষে শিগগির বিজ্ঞ আদালতে চার্জশীট দাখিল করা হবে।
মামলার এ তদন্ত কর্মকর্তা আরো বলেন, আলোচিত এ মামলায় এখন পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলা, কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম, শিক্ষক আবছার উদ্দিন, নুসরাতের সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, কেফায়াত উল্যাহ জনি, মোহাম্মদ আলা উদ্দিন, শাহিদুল ইসলাম, অধ্যক্ষের ভাগনি উম্মে সুলতানা পপি, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহমেদ, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, মো. শামীম, কামরুন নাহার মনি, আবদুর রহিম ওরফে শরিফ, ইফতেখার হোসেন রানা, এমরান হোসেন মামুন, মহিউদ্দিন শাকিল, হাফেজ আবদুল কাদের ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ওই মাদরাসার সহ-সভাপতি রুহুল আমিন।
এ মামলায় ১২ জন আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। এরা হলো সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলা, নুসরাতের সহপাঠী অধ্যক্ষের ভাগনি উম্মে সুলতানা পপি, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহমেদ, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, কামরুন নাহার মনি, আবদুর রহিম ওরফে শরিফ, ইফতেখার হোসেন রানা, এমরান হোসেন মামুন, মহিউদ্দিন শাকিল, ও হাফেজ আবদুল কাদের।
এদিকে এ হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে আরো কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এর মধ্যে রয়েছে সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ইতোমধ্যে তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে থানা থেকে। নুসরাতের ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার দায়ে তার বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা হয়েছে। ওসিকে গ্রেফতারের দাবী জানিয়ে আসছে বিভিন্ন মহল।
এদিকে নুসরাতের পরিবারের বিপক্ষে ও ওসি মোয়াজ্জেমের পক্ষে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দেয়ায় আলোচনায় উঠে আসছে ফেনীর পুলিশ সুপার এস.এম জাহাঙ্গীর আলম সরকারের নাম। ঘটনায় অবহেলা করার দায়ে নুসরাতের পরিবারের অভিযোগের তীর ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পিকেএম এনামুল করিমের দিকে। এসব অভিযুক্তর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত’র দাবী করে আসছে বিভিন্ন প্রতিবাদি মহল।
যৌন নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থীজোট এর আহ্বায়ক শিবলী হাসান বলেন, শ্লীলতাহানরি মামলা করার পর পাশে না দাঁড়িয়ে স্থানীয় প্রশাসন উল্টো মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান ও তাঁর পরিবারকে ভয় দেখিয়েছিলো। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, দায়ী সকলকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
মামলার বাদী নুসরাত জাহান রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, আমরা এ পর্যন্ত মামলার অগ্রগতি নিয়ে আশাবাদী। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে চার্জশটি দিতে গিয়ে যাতে কোন আসামির নাম বাদ পড়ে না যায় সে জন্য পিবিআইকে সচেতন থাকার অনুরোধও করেছেন নোমান। নোমান আরো বলেন, চার্জশীট থেকে যদি কোন আসামি কিংবা পরিকল্পনাকারীর নাম বাদ পড়ে যায় তাহলে আদালতে চার্জশীটের বিরুদ্ধে না রাজি দিবো।
উল্লেখ্য, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়ের দায়ে ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে আটক করে পুলিশ। পরে ৬ এপ্রিল ওই মাদরাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত জাহান রাফি।
Leave a Reply