শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:৪৭ পূর্বাহ্ন
বাকেরগঞ্জ প্রতিনিধি॥ বরিশালের বাকেরগঞ্জে গাব গাছে ঝুলে থাকা মামুন খাঁ (২৩) আত্মহত্যা করেনি। তার সাবেক প্রেমিকা ও তার স্বামী বাড়িতে ডেকে নিয়ে মামুনকে হত্যা করে গাব গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল। পাঁচ বছর পর পিবিআই তদন্তে এমনই তথ্য জানা গেছে।
মঙ্গলবার (১ মার্চ) বিকালে বরিশাল জেলা পিবিআই’র ইউনিট প্রধান পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাকেরগঞ্জের বিহারীপুর এলাকার একটি বাগানের গাব গাছ থেকে মামুন খাঁ (২৩) নামে এক তরুণের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনায় মামুনের বাবা অজ্ঞাত আসামিদের নামে একটি হত্যা মামলা করেন। তবে এটি আত্মহত্যা বলে একটি মহল প্রচারণা চালায়। মামলাটি থানা পুলিশ তদন্ত করে কোনও অগ্রগতি না হওয়ায় বরিশাল জেলা পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পিবিআই’র পরিদর্শক আবু জাফর মামলাটি তদন্ত শুরু করেন। তিনি গোয়েন্দা তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় করিম মোল্লা (২৩) নামে এক তরুণকে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ধামরাইয়ের বরাত নগর এলাকা থেকে গ্রেফতার করেন। তার বাড়িও বাকেরগঞ্জে বিহারীপুর।
করিম মোল্লা আদালতে হত্যার কথা স্বীকার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।
কেন হত্যা?
আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিতে করিম মোল্লা বলেছেন, মামুনের সঙ্গে তারই এলাকার সাথী আক্তার ঝর্ণা নামের এক তরুণীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তবে ঝর্ণার পরিবার তাকে ওই এলাকার আরেক তরুণ নাজমুল ইসলাম রুবেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়। ঝর্ণার বিয়ের পরও মামুনের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। তাদের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি জেনে যায় ঝর্ণার স্বামী নাজমুল ইসলাম রুবেল। এরপর ঝর্ণাকে ভয়ভীতি দেখাতে থাকে তার স্বামী। মামুনকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ঝর্ণার সহযোগিতা চায়। তা না হলে ঝর্ণাকে সে ডিভোর্স দেওয়ার হুমকি দেয়। এমন হুমকির পর ঝর্ণা তার স্বামীর প্রস্তাবে রাজী হয়। স্ত্রীর আশ্বাস পেয়ে মামুনকে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করে নাজমুল ইসলাম রুবেল। তবে তখন মামুন ঢাকায়।
গাবগাছে ঝুলছিল মামুনের লাশ
২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে মামুন খা ঢাকা থেকে তার বাকেরগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে যায়। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম নেয়। এসময় তার মোবাইলে একাধিক ফোন আসে। ওই দিন বিকাল ৫ টার দিকে ঘুম থেকে জেগে সে স্থানীয় বাংলাবাজার নামক একটি গ্রাম্য বাজারে সেলুনে যায়। অনেক রাত হয়ে যাওয়ার পরও মামুন ঘরে না ফেরায় তার মোবাইল ফোনে ফোন দিয়ে মোবাইলটি বন্ধ পায়। মামুন খাঁ সেদিন রাতে আর বাড়িতে ফেরেনি।
পরের দিন অর্থাৎ ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে বিহারীপুর এলাকার আয়ুব আলীর বাগানের একটি গাবগাছ থেকে গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস লাগানো অবস্থায় মামুনের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হয়।
যেভাবে হত্যা করা হয়
ঝর্ণার স্বামী নাজমুল ইসলাম রুবেলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু করিম মোল্লা ও নাজমুল তালুকদার। স্ত্রী ঝর্ণার সঙ্গে মামুনের পরকীয়ার সম্পর্ক জেনে যাওয়ার পর রুবেল তার দুই বন্ধু করিম মোল্লা ও নাজমুল তালুকদারের সঙ্গে মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা করে। রুবেল ত্রিশ হাজার টাকায় নাজমুল তালুকদারের সঙ্গে চুক্তি করে।
নাজমুল তালুকদার ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাহফিলের কথা বলে মামুনকে ঢাকা থেকে বাকেরগঞ্জ নিয়ে আসে। ওইদিন নাজমুল তালুকদার নিজেই বেলা ১২টার দিকে করিম মোল্লাকে ফোন দেয়। করিম ও নাজমুল তালুকদার নিজেদের মধ্যে কথা বলে হত্যার পরিকল্পনা করে। এরপর তারা দুজন চলে যায়।
ওই দিন সন্ধ্যার দিকে নাজমুল তালুকদার গ্রেফতারকৃত করিম মোল্লাকে ফোন দিয়ে বাইরে আসতে বলে। করিম মোল্লা বাইরে এসে দেখে নাজমুল তালুকদার, রহিম ও সাদ্দাম (নাজমুল তালুকদারের ফুপাতো ভাই) একসঙ্গে আছে। তারা সবাই রাত ৮টা পর্যন্ত ঘোরাফেরা করে। রাত ৮টার দিকে নাজমুল তালুকদার সাদ্দামকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
করিম মোল্লা, নাজমুল তালুকদার, রহিম সাজ্জালসহ বাকেরগঞ্জের কাফিলার পাশে নাপিত বাড়ি গিয়ে কার্ড খেলে। তখন ঝর্ণা নাজমুল তালুকদারকে ফোন দিয়ে বলে, ‘মামুনকে তোরা (নাজমুল তালুকদাররা) ফোন দিয়ে তোদের সাথে নিয়ে আয়।’
করিম মোল্লা, মামুন, নাজমুল তালুকদার ও রহিম একসঙ্গে নাপিত বাড়িতে গভীর রাত পর্যন্ত কার্ড খেলতে থাকে। রাত আনুমানিক ৪টার দিকে ঝর্ণা মামুনের মোবাইলে ফোন করে তার বাড়িতে ডাকে। মামুন ফোন পেয়ে ঝর্ণার বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হয়। করিম মোল্লা, নাজমুল তালুকদার ও রহিম মামুনের পিছু নেয়। মামুন যখন ঝর্ণার ঘরের পাশে যায় তখন ঝর্ণা ও তার স্বামী নাজমুল ইসলাম রুবেল মামুনকে জাপটে ধরে। নাজমুল তালুকদার ও আব্দুর রহিমও মামুনকে চেপে ধরে। নাজমুল ইসলাম রুবেল মামুনকে গলা চেপে ধরে, ঝর্ণা মামুনের পা চেপে ধরে, রহিম মামুনের মুখ চেপে ধরে, নাজমুল তালুকদার মামুনের হাত চেপে ধরে। এক পর্যায়ে মামুন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মামুন মারা গেছে বুঝতে পেরে ঝর্ণার ওড়না দিয়ে নাজমুল ইসলাম রুবেল মামুনের ফাঁস দেওয়ার মত করে বাঁধে। তারপর সবাই মিলে ভিকটিম মামুনকে গাব গাছে ঝুলিয়ে রাখে। এরপর তারা যার যার মত সবাই বাড়িতে চলে যায়।
এই ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ঝর্ণা ও তার স্বামী নাজমুল ইসলাম রুবেলকে গ্রেফতার করে। তবে তারা মামলার কোনও কুল-কিনার করতে পারেনি। বর্তমানে তারা জামিনে রয়েছে।
পুলিশের বক্তব্য
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আবু জাফর জানান, করিম মোল্লা গ্রেফতারের পর আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে, তাতে পুরো হত্যার বিষয়টি উঠে এসেছি। এখন পর্যন্ত হত্যার সঙ্গে জড়িত যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলো- ঝর্ণা, তার স্বামী নাজমুল ইসলাম রুবেল, রুবেলের বন্ধু করিম মোল্লা, নাজমুল তালুকদার ও আব্দুর রহীম। এদের মধ্যে ঝর্ণা ও তার স্বামী জামিনে রয়েছে। বাকি আসামি রহিম ও নাজমুল তালুকদার পলাতক। তাদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে।’
Leave a Reply