বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৬:৫৩ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক:বাল্যবিয়ে মুক্ত বরিশাল জেলা ঘোষণা করা হলেও জেলার দশটি উপজেলায় বাল্যবিয়ের হিড়িক পরেছে। ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করেও ঠেকানো যাচ্ছেনা বাল্যবিয়ে। সরকারের নিয়ম উপেক্ষা করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের অভিভাবকরা জালজালিয়াতির মাধ্যমে বয়স বাড়িয়ে ভূয়া জন্ম নিবন্ধন দাখিল করে; আইনজীবীদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে বাল্যবিয়ে সম্পন্ন করছেন।
ফলে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ের নানা উদ্যোগ গ্রহণ করার পরেও বরিশালে ঠেকানো যাচ্ছে না বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনে বিবাহ রেজিষ্ট্রেশনের ক্ষেত্রে কোন রকমের নোটারি পাবলিক গ্রহণযোগ্য না থাকলেও প্রতিটি বাল্যবিয়ের ঘটনায় দেখা গেছে নোটারির মাধ্যমে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।
বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী এনজিও টার্গেট পিপলস্ ফর অর্গানাইজেশনের (টিপিডিও) প্রতিবেদনে জানা গেছে, ভূয়া নোটারির মাধ্যমে দুইদিনে গৌরনদী উপজেলায় চারটি বাল্যবিয়ের আয়োজন করা হয়। যদিও প্রতিটি বিয়ের অনুষ্ঠান পন্ড করে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
এরমধ্যে ১৪ মার্চ দুপুরে ইউএনও খালেদা নাছরিনের হস্তক্ষেপে বাল্যবিয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে গৌরনদী গালর্স স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেনির ছাত্রী পৌর সদরের চরগাধাতলী মহল্লার বাসিন্দা আবুল কালামের মেয়ে সাদিয়া আফরিন (১৬)। এছাড়া ১৩ মার্চ রাতে ইউএনও’র হস্তক্ষেপে নলচিড়া ইউনিয়নের শংকরপাশা গ্রামের মনরঞ্জন ঢালীর কন্যা প্রতিরানী ঢালী পুজা (১৫) ও ১২ মার্চ দুপুরে খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের বড়দুলালী গ্রামের অলিল খন্দকারের কিশোরী কন্যা সুমি আক্তার (১৬) বাল্যবিয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
১৪ মার্চ দুপুরে মাহিলাড়া ইউনিয়নের জঙ্গলপট্টি গ্রামের শহিদ বেপারীর কন্যা মরিয়ম আক্তার (১৬) স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলুর হস্তক্ষেপে বাল্যবিয়ে থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
প্রতিটি বিয়ের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের অভিভাবকরা জালিয়াতির মাধ্যমে বয়স বাড়িয়ে ভূয়া জন্ম নিবন্ধন দাখিল করে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে আগেভাগেই বিয়ে সম্পন্ন করেছেন।
টিপিডিও’র প্রতিবেদনে আরও জানা গেছে, বরিশালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে আগৈলঝাড়া ও গৌরনদী উপজেলায়। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ একমাত্র ভূয়া নোটারির মাধ্যমে বয়স বৃদ্ধির কারণে এখন ভেস্তে যাচ্ছে। ফলে এখনও ২৯ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়সের আগে। আর দুই ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ১৪ বছরের আগেই। আর এজন্য পরিবারের অসচেতনতা, দারিদ্রতা, লোভ ও প্রেমঘটিত বিষয় অন্যতম কারণ।
মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বয়স বাড়িয়ে জন্মনিবন্ধন না পেয়ে নাবালিকা মেয়েদের অভিভাবকরা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নোটারীর মাধ্যমে মেয়েদের বয়স বাড়িয়ে প্রকাশ্যেই ঢাকঢোল পিটিয়ে বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন। উল্টো ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভুয়া জন্মনিবন্ধন না পেয়ে নোটারীর মাধ্যমে মেয়েদের বয়স বাড়িয়ে এনে তাদের ওপর চ্যালেঞ্চ ছুঁড়ে দেয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাল্যবিয়ে ঠেকাতে হলে শুধুমাত্র বিয়ের ক্ষেত্রে নোটারি পাবলিকের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
এরপরেও যদি নোটারির মাধ্যমে বয়স বাড়ানো হয় তাহলে বাল্যবিয়ের অপরাধে বর-কনের অভিভাবক, রেজিস্টারদের বিরুদ্ধে যেমন দন্ডবিধির আইন রয়েছে, তেমনি নাবালিকা ছেলে-মেয়েদের বয়স বাড়ানো ভূয়া নোটারি ও বিয়ের সাথে যারা জড়িত তাদেরকেও আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। তবেই শতভাগ বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
নারী নেত্রী এ্যাডভোকেট সাহিদা আক্তার বলেন, এখনই বাল্যবিয়ে ঠেকানো না গেলে নারীর প্রতি সহিংসতা, মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি, অপরিণত গর্ভধারণ, প্রসবকালীন শিশু মৃত্যুঝুঁকি, প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি, নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ কমে যাওয়াসহ নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাল্যবিয়ে মুক্ত বরিশাল জেলার প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বলেন, অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণে প্রায়ই বাল্যবিয়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বাল্যবিয়ে ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জনপ্রতিনিদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে দেশের যেকোনো স্থান থেকে হেল্পলাইন ‘১০৯৮’ নম্বরে কল দিলেই সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাচ্ছে।
Leave a Reply