সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০১ পূর্বাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট : ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মরণপণ যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে আনার ৫২ বছর পূর্তি হচ্ছে আজ ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের ৫২ বছরেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারেনি সরকার। পাঁচ দশকের বেশি সময়ে বিভিন্ন সরকারের মেয়াদে রাষ্ট্রীয়ভাবে অন্তত ছয়টি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়েছে বেশ কয়েকবার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবারই নতুন নতুন তালিকা প্রণয়নের সঙ্গে বেড়েছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা। আজও তালিকার বাইরে রয়ে গেছেন অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমান সরকারের উদ্যোগে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয় যাচাই-বাছাই।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) সূত্রে জানা গেছে, এখনো দেশের অন্তত ২৮টি উপজেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাসংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদনই আসেনি। তালিকা থেকে বাদ পড়াদের আপিল যাচাই বাকি অন্তত ২৭ হাজার ৮১৬টি। এ ছাড়া ভাতা বন্ধ ও গেজেট নিয়মিতকরণের আপিলও আছে সাত শর বেশি। প্রায় এক হাজার ৫০০টি রিট রয়েছে আদালতে।
নির্বাচনের কারণে গত নভেম্বর থেকে তালিকা তৈরির সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
জামুকাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নির্বাচনের পর আবার তালিকার কাজ শুরু হবে। তবে তা খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে বলেন, ‘এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এটা চলতে থাকবে।
এত দিনেও কেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভুল তালিকা করা গেল না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে গত জানুয়ারিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ব্যর্থতা স্বীকার করে গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘আরো আগেই পারা উচিত ছিল। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের ব্যর্থতা মনে করি। আমি এখন মনে করি, ২৬ মার্চের মধ্যে এটা হওয়া উচিত। না হলে এটা চরম ব্যর্থতা হবে।’
জামুকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে উপজেলাগুলোর প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি সেগুলো মামলাজনিত কারণে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া জামুকার লোকবল সংকট রয়েছে। মামলা মোকাবেলার জন্য জামুকার নিজস্ব কোনো আইন সেলও নেই।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালিকা তৈরির কাজ গবেষকদের, আমলাদের নয়। আমলাতান্ত্রিক হয়ে পড়াতে এই তালিকা তৈরিতে দেরি হচ্ছে। সেই সঙ্গে অর্থের যোগ থাকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাও তালিকায় ঢুকে পড়ছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক মুনতাসীর মামুন গণমাধ্যমে বলেন, ‘পুরো বিষয়টাকে হাস্যকর করে তোলা হয়েছে। এটা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অবমাননাকর বলে আমি মনে করি। মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধারা এখানে আসছেন টাকা পাওয়ার জন্য, সুবিধা পাওয়ার জন্য। নতুন প্রজন্ম, এটাতে বীতশ্রদ্ধ। আমার ধারণা, যদি ৪০ বছর পরেও কোনো সরকার আসে তারাও তখন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করবে। এটা অনন্তকাল থাকবে। পৃথিবীর কোথাও ছয়বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হয়নি।’
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমলা ডিসিদের যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার খুঁজে বের করার, তাহলে এমনই হবে। এটা কি জেলা প্রশাসকদের কাজ নাকি? আমরা সব সময় বলেছি, এগুলো গবেষকদের দেওয়ার জন্য। গ্রামে, উপজেলায় গেলে স্থানীয়রাই বলতে পারবে তাদের গ্রামে কে মুক্তিযোদ্ধা, কে রাজাকার ছিল। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই সমস্যা। সঠিকভাবে গবেষকদের দায়িত্বটা দেওয়া হলে, মোটামুটি ভালো একটা তালিকা এত দিনে আমরা পেয়ে যেতাম। এগুলো গবেষকদের দিয়ে করাতে হবে এবং দ্রুত হতে হবে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ১৫ বছর ধরে বর্তমান তালিকার কাজ চলছে।’
অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এখনো তালিকায় আছে এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই তালিকাতে নেই উল্লেখ করে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা জালালের নাম এখনো তালিকায় ওঠেনি। জালালের বিষয়ে আমি নিজে চিঠি দিয়েছি মন্ত্রণালয়কে। আমি নিজে দেখা করে বলেছি। উনার স্ত্রী-ছেলে কয়েকবার এসেছেন মন্ত্রণালয়ে। উপজেলা থেকেই উনার নাম পাঠায়নি। জালাল হচ্ছেন সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা, যাকে জামায়াতে ইসলামী প্রথম হত্যা করে আত্মপ্রকাশ করে।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সমন্বিত তালিকায় বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ৯২ হাজার ১৫৫ জন। সুবিধা বা ভাতাভোগী দুই লাখ ৩৮ হাজার ৮৪১ জন। তালিকার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত সংখ্যা প্রায় দুই লাখে গিয়ে থামতে পারে।
তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া
২০০২ সালের ৫ এপ্রিল ৮ নং আইনের আওতায় জামুকার যাত্রা শুরু হলেও মূল কার্যক্রম শুরু হয় ২০১০ সালের জানুয়ারির ২৭ তারিখে জামুকার প্রথম সভার মাধ্যমে। জামুকা সূত্রে জানা যায়, প্রথম সভা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির ব্যাপারে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা আসে। এরপর সে অনুযায়ী ২০১৩ সালের ৬ অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত নতুনভাবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য অনলাইনে আবেদন নেওয়া হয়। সেখানে এক লাখ ২৩ হাজার আবেদন জমা পড়ে। তার আগে সরাসরি আবেদন জমা পড়ে প্রায় ১১ হাজার। এই প্রায় এক লাখ ৩৪ হাজার আবেদন যাচাই বাছাইয়ের জন্য ২০১৬ সালে ‘মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নির্দেশিকা-২০১৬’ নামে একটি নীতিমালা করা হয়।
নীতিমালার আলোকে প্রাপ্ত আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ২০১৭ সালের শুরুতে সারা দেশে ৪৭০টি উপজেলা/জেলা/মহানগর যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। সাত সদস্যের কমিটি যাচাই-বাছাই করে তিন ধরনের প্রতিবেদন বা তালিকা তৈরি করে—‘ক’, ‘খ’ এবং ‘গ’। ‘ক’ তালিকা কমিটির সদস্য কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত তালিকা। ‘খ’ তালিকা দ্বিধাবিভক্ত; অর্থাৎ কমিটির সদস্যদের সবাই একমত হতে পারেননি। ‘গ’ তালিকা সর্বসম্মতিক্রমে নামঞ্জুরকৃত তালিকা। এভাবে মাঠ পর্যায় থেকে তিনটি তালিকা জামুকায় আসার পর জামুকা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু করে। যাচাই-বাছাই কমিটি কর্তৃক যেসব আবেদনকারীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুপারিশ করা হয় না, অর্থাৎ ‘খ’ এবং ‘গ’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় তারা সেই সুপারিশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হয়ে জামুকায় আপিল করার সুযোগ পান। আপিল আবেদনগুলো নিষ্পত্তির জন্য জামুকার বিভাগীয় সদস্যকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের আপিল কমিটি গঠন করা হয়।
জামুকা আইনের বাইরে গিয়ে ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জামুকার সুপারিশ ছাড়া প্রায় ৪০ হাজার ব্যক্তির নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘বেসামরিক গেজেটে’ অন্তর্ভুক্ত হয়। এই বেসামরিক গেজেট যাচাইয়ের জন্য ২০২০ সালে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বেসামরিক গেজেট যাচাই-বাছাই নির্দেশিকা-২০২০’ নামক নীতিমালা করা হয়। ২০১৬ সালের নীতিমালায় যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সাত সদস্যের কমিটি করা হলেও এ ক্ষেত্রে চার সদস্যের কমিটি করা হয়। এ ছাড়া যাচাই-বাছাইয়ের অন্য সব প্রক্রিয়া ২০১৬ সালের নীতিমালার মতোই।
Leave a Reply