বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১০ পূর্বাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। পিতা আব্দুল জব্বার খান ছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার। ছাত্র অবস্থাতেই রাজনীতিতে যাত্রা শুরু তার। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সব অধ্যায়ে রেখেছেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। সম্প্রতি মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি খোলামেলা কথা বলেন নানা ইস্যুতে।
রাশেদ খান মেনন বলেন, স্বাধীনতা আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। বাংলাদেশ কেবলমাত্র একটি সম্ভাবনাময় দেশই না, এটি ক্রমাগত উন্নতির পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যখন শুরু করেছিল একেবারে বলা যায় যে নিঃস্ব অবস্থায় শুরু করেছিল। এমনকি আমাদের যে পাওনাগুলো ছিল তৎকালীন পাকিস্তান আমাদের তা দেয়নি। বরং যে ঋণগুলো ছিল সেগুলো আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল। স্বাধীনতার ওই সময়কালে রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে অবকাঠামোগুলো সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। আমাদের গায়ে-গতরে মাটি আর মানুষ ছাড়া বাস্তবিক অর্থে কিছু ছিল না। দেশের এই মানুষের ওপর নির্ভর করেই কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে আমরা দ্বিতীয় রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছি। এসবই নিশ্চিতভাবে মনে করি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সেটা হলো ‘আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণায় মূলত তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। ‘সামাজিক ন্যায় বিচার, মানবিক মর্যাদা এবং সমতা’। অথচ সমতা এবং সামাজিক ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে আমরা অনেক অনেক পিছিয়ে। বিভিন্ন সূচকে বলা হয়েছে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে। নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে আবার সামনের দিকে অর্থাৎ দারিদ্র্যসীমার নিচে আমরা ২১ শতাংশ চলে এসেছিলাম। কিন্তু যেটা হয়ে গেছে আজকে বাংলাদেশ কেবলমাত্র ধনীর দেশে পরিণত হয়েছে। এখানে অসমতাটা এতো বিরাট যেটা খুব বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বারবার উল্লেখ করার পরেও এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি আমরা দেখছি না।
তিনি বলেন, আমাদের যে অসমতা সেটা বিচারে একটি অর্থনৈতিক মানদণ্ড আছে। তাকে বলা হয় জিনি সহগ। মূলত এটি বৈষম্য মাপার একটি পদ্ধতি। এটা পয়েন্ট পাঁচ-এ চলে গেলে সেটা বিপজ্জনক পর্যায়। আমরা বলেছিলাম বাংলাদেশ হবে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত দেশ। ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। আমরা যদি সেই সময়কার বঙ্গবন্ধুর সংবিধান প্রণয়নের সময় এবং পরবর্তীকাল দেখি যেখানে তিনি বারবার এই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন। ধর্ম নিয়ে ব্যবসা বন্ধের কথা বলেছেন। ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে না আনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা ’৭৫ পরবর্তীকাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সেই ধর্মীয় রাজনীতি কেবল নয়, আমরা একইসঙ্গে মৌলবাদের উত্থান দেখেছি। জঙ্গিবাদের উত্থান দেখেছি। জঙ্গিবাদের ফলে মানুষের মৃত্যু দেখেছি। যদিও আপাতত সেটা প্রতিরোধ করা গেছে। সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব ব্যাপক হয়ে গেছে। বাংলাদেশে যেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ কেবল নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সেখানে আজকে বাংলাদেশের সংবিধানে এখনো এমন সাংঘর্ষিক বিধান রয়ে গেছে। একদিকে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম। অন্যদিকে ধর্ম নিরপেক্ষতা। দুটো একসঙ্গে যায় না। অথচ এটাই আমাদের বাস্তবতা।
গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা সম্পর্কে মেনন বলেন, আমাদের গণতন্ত্র প্রথম থেকেই একটি বাধার সম্মুখীন হয়েছে। যদিও সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে এখানে। আমার মনে হয় সেখানে যে গণতান্ত্রিক সংবিধান গ্রহণ করা হলো কিন্তু কিছুদিন পরেই সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীতে জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা এবং মৌলিক অধিকার হরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা প্রথম থেকেই যাত্রা শুরু করে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ’৭৫ পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি- একেবারেই সামরিক শাসন অথবা বেসামরিক শাসনের নামে সামরিক শাসন অব্যাহত রেখেছে। ৯০-এর অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে আমরা আবার ফিরে গেলাম আমাদের সেই ৭২-এর সংবিধানের ব্যবস্থাগুলোর পক্ষে। কিন্তু সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ যে রাষ্ট্রের উপরে সেটা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। বরং আরো অনেক চেপে বসে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে গণতান্ত্রিক বিধানগুলো খুব কার্যকর থাকছে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, সম্প্রতি উচ্চ আদালতও এ নিয়ে একটি রুল জারি করেছে। ‘উপজেলা প্রশাসনে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কর্তৃত্ব করে। সেখানে উপজেলা চেয়ারম্যানের কর্তৃত্ব থাকে না। বা নির্বাচিত প্রতিনিধির কর্তৃত্ব থাকে না। এটাই চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। যদিও আমাদের প্রথম সংবিধানে স্থানীয় সরকারের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে লেখা আছে। প্রতিটি সরকারই বলে থাকে স্থানীয় সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু দেখা যায় ক্ষমতাগুলো চলে গেছে আমলাতন্ত্রের হাতে। অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্র রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যখন রাষ্ট্র্রযন্ত্র রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে তখন গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা কার্যকর থাকে না।
গত দু’টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০১৪ সালের যে নির্বাচনটি হয় সেটি হয়েছিল এমন একটি পরিবেশে- লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বিএনপি সেখানে আগুন সন্ত্রাস, মানুষ হত্যার রাজনীতি করেছে। তার আগেই হেফাজতের অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছে। এবং জামায়াতের তরফ থেকে যুদ্ধাপরাধীর বিচার থামানোর প্রচেষ্টা এ ধরনের একটি পরিবেশের মধ্যে নির্বাচনটি হয়েছে। সেই নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল। এই বর্জন করার মধ্যে দিয়ে দেখা যায় একটি বিশাল সংখ্যক এমপি (সংসদ সদস্য) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এখন এ বিষয়ে কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, এটা কি গণতন্ত্রের জন্য সুখকর? ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়। এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে মানুষ ভোট দিয়েছে। এ সময় বিএনপি কার্যত ভোটে অংশ নিলেও তারা ভোটে ছিলেন না। ফলে অনেক কিছুর ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হয়েছে। সুতরাং আমাদের সবচেয়ে যেটা জরুরি প্রয়োজন এবং যার জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী লড়েছেন আমরাও লড়েছি, সেটা হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে জনগণের আস্থাশীল হতে হবে।
নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে কীভাবে দেখেন এবং মূল্যায়ন করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দীর্ঘ রাজনীতিতো বটেই। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। আমি কৃতজ্ঞ দেশের মানুষের কাছে। আজ এই পর্যন্ত আমার যে এগোনো, সাধারণ মানুষের ওপর নির্ভর করেই সেটা এগোতে পেরেছিলাম। এবং আমি এখনো মনে করি যে আমার জীবনের অনেক উত্থান-পতন আছে। কিন্তু সামগ্রিক অর্থে বলবো আমি কিন্তু তৃপ্ত। অতৃপ্ত নই।
আমাদের এখানে বাম রাজনীতি কেন সফল হয় না এবং সফল হতে ব্যর্থতা কোথায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাম রাজনীতি এদেশে এক সময় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ধরেছিল। অর্থাৎ সকল আন্দোলন পাকিস্তান আমলের, সংগ্রাম এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বামেরাই সামনে ছিল। কিন্তু বলা যায় যে, স্বাধীনতার মধ্যভাগ থেকে ভ্রান্তি আর ভুল পদক্ষেপ এবং তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বিদেশি রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতায় কেউ মধ্যপন্থি হয়ে তাদের ওপর নির্ভরশীলতায় পরিচালনা করা- এগুলো আমাদের বামদেরকে একেবারেই মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এবং এই যে মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা এটা একটি বড় বিষয়। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন একটি নয়া উদারনীতির অর্থনৈতিকে নীতি অনুসরণ করছে। যার ফলে দেশে এখন অসমতা এবং বঞ্চনা বাড়ছে। এক্ষেত্রে আন্দোলনকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হওয়ার কথা থাকলেও আমরা এগোতে পারছি না। এর ফলেই বাম রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রেই প্রান্তিক দলে পরিণত হয়ে গেছে। তারা কার্যকর ভূমিকায় থাকতে পারছে না। তার পরও যেটা বলবো- বাম যে কাজটি করেছে এদেশের বড় বড় জায়গাগুলো বিশেষ করে অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সমতার ভাবনা এ সবগুলোই কিন্তু বাম রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের সামনে এসেছে। বামপন্থিরা যে একেবারেই অকার্যকর হয়ে গেছে বিষয়টি এরকম নয়। এখনো মানুষ ভরসা করে যখন দেশে কোনো ক্রাইসিস আসে তখন মনে করেন বামেরাই তাদেরকে সহায়তা করবে। তবে বাম সংগঠনের এই কাজগুলো ভোটের মাঠে গিয়ে খুব একটা প্রতিফলিত হয় না। এই ব্যর্থতা তো রয়েছেই।
Leave a Reply