বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৫ অপরাহ্ন
আমজাদ হোসেন, বাউফল প্রতিনিধি॥ তেতুলিয়া নদীতে আমাগো পথের ভিখারি না বানাইয়া ছাড়বে না, বাপের বাড়ি খাইছে, এবার ধরছে স্বামীর বাড়ি। এই কথাগুলো বললেন তেঁতুলিয়ার অব্যাহত ভাঙ্গনের কবল থেকে বসতঘরের মালামাল সরিয়ে নেওয়ার মুহুর্তে পটুয়াখালীর বাউফলের ধুলিয়া গ্রামের হান্নান হাওলাদারের স্ত্রী মুকুল বেগম। প্রতিদিনই তেঁতুলিয়া গ্রাস করছে ভিটাবাড়িসহ ফসলি জমি। তেঁতুলিয়া নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে হারিয়ে যাচ্ছে ধুলিয়া ইউনিয়নের মূলভূখন্ড।
গত ৫-৬ মাসে তেঁতুলিয়া নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনের কারনে বিলিন হয়েছে ধুলিয়া গ্রামের আনছার আলী খা, বারু মিয়া, হালিম মিয়া, নুরু হাওলাদার, খালেক খা, মতি খলিফা, আব্দুল আলী মেম্বর, হুমায়ুন দেওয়ান, সুফিয়া বেগম, সবুজ হাওলাদার, রাজা মিয়াবাড়িসহ অর্ধশতাধিক বাড়ি, কয়েকশো পবিারের কয়েক হাজার একর কৃষি জমি।
ভাঙ্গনের কবলে ভূমিহীন হয়ে ২৩ নং ধুলিয়া এনকে সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয় মাঠে আশ্রয় নিয়েছে গনি হাওলাদার, মিন্টু দেওয়ান ও হারুন দেওয়ানের পরিবার। আরসিসি রাস্তার পাশে আশ্রয় হয়েছে মোশারফ গাজী, সিরাজ মিয়া, আলতাফ হাওলাদারসহ অনেকগুলো পরিবারের লোকজনের। ভিটা-বাড়ি আর সহায়-সম্ভল হারিয়ে পাশের এলাকায় নানা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন সবুজ হাওলাদার।
সবুজ হালাদারের মতো আত্মীয়-স্বজনের আশ্রয় কিংবা রাস্তার পাশেও বসতঘর নির্মাণের সামর্থ হারিয়ে অন্যের ঘরে ঘরে কামলা খেটে দিন পাড় করছেন মমতাজ বেগম, কালাম হাওলাদার, সুফিয়া বেগমের মতো কয়েকজন। অনেকেই করছেন মানবেতর জীবন-যাপন। কেউ কেউ আবার সাধ্য অনুযায়ী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছেন অন্য এলাকায়।
সরেজমিন ভূক্তভোগি গনি হাওলাদার বাড়ির রশিদ হাওলাদারের স্ত্রী জাহানার বেগমকে (৩৮) দেখা যায় ভাঙ্গনের কবল থেকে বসতঘর সরিয়ে নেওয়ার পরে অবশিষ্ট রান্না ঘরের মালামাল সরিয়ে সাময়িক আশ্রয় নেওয়া বাড়ির শেষ সীমানায় স্তুপ করতে। তিনি বলেন, ‘ঘর পোড়লে তবু বাড়ি-ভিটা থাহে, নদীতে ভাঙলে কিচ্ছু থাহে না।’ নদীপাড় থেকে সরিয়ে নেওয়া মসজিদের বারান্দার পাশে পরিত্যাক্ত এক টিউবয়েলের প্লাটফর্মে নদীমুখি বিষন্ন বসে থাকা স্থানীয় বালু ব্যাবসায়ী ইয়াকুব হাওলাদারের ছেলে হান্নান হাওলাদার জলবায়ু পরিবর্তণের ইঙ্গিত করে জানান, তেঁতুলিয়ার ভাঙনে এখন আর সময় অসময় লাগে না। বর্ষায় ভাঙে। ভাঙে শীতেও।
নদীর ভাঙনে ভিটা-বাড়ি, হাট-বাজার, স্কুল, মসজিদ, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানসহ হারিয়ে যাচ্ছে ফসলী জমি। সত্তর দশক থেকে তেতুঁলিয়ার অবাধ ভাঙ্গনে ভুমিহীন হয়েছেন অনেকে। পূর্ব-পুরুষের পেশা পাল্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছেন বিভিন্ন এলাকায়। কেউ বা করছেন মানবেতর জীবনযাপন।
মমতাজ বেগম নামে একজন বলেন, ‘গাঙে আগেও ভাঙতে দেখছি, বাইস্যায় (বর্ষায়) একটু বেশি ভাঙে। তবে এরহম ভাঙ্গতে আর দেহি নাই।’ মমতাজ, জাহানারা ও হান্নান হাওলাদারের মতো আরো অনেকে জানান, তেঁতুলিয়ার ভাঙ্গন কবলিত এলাকার লোকজনের মধ্যে সবসময় আতঙ্ক বিরাজ করছে।
র্দূদশার সীমা-পরিসীমা নেই অনেকেরই। জিও ব্যাগ (বালুর বস্তা) ফেলেও তেঁতুলিয়ার অব্যাহত ভাঙন রোধ যাচ্ছে না। গত ১৮ মে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব:) জাহিদ ফারুক শামিমের পদির্শণের পর ধুলিয়ার খাল থেকে বাজার এলাকায় তিন হাজার ব্যাগ (জিও ব্যাগ) বালুর বস্তা ফেলা হলেও ¯্রােতে তা টেকেনি। ক্ষতিগ্রস্তদের জীবনমান উন্নয়নে মন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করে পরিবেশ ও মানব বিপর্যয় ঠেকাতে ভাঙন রোধে টেকসই প্রকল্প গ্রহনের দাবি জানান স্থানীয় এসব লোকজন।
এদিকে ধানদী গ্রামের মজিরন, ভানু বিবি, মজিরন ও আমেনা বেগম নদী ভাঙনে সব হারিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ধানদী গ্রামের সালেহা বেগম বলেন, ‘জমিজমা ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলো খাজনা পরিশোধ না করায় নদীর অপর পাড়ে চর জাগলেও তাতে ক্ষতিগ্রস্থদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। জেগে ওঠা চরে ভূমিহীন লোকদের বন্দোবস্ত পাওয়ার কথা থাকলেও প্রকৃত ভূমিহীনরা বঞ্চিত হচ্ছেন। অপর দিকে প্রভাবশালীরা কর্তপক্ষের হাতে মোটা উসূল ধরিয়ে ভূমিহীন কার্ডহোল্ডার হয়েছেন। জোর করে কেউ নিজ দখলে রেখেছে জেগে ওঠা চরের জমি।’
তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙন থেকে বিচ্ছিন্ন চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়ন ও নাজিরপুর ইউনিয়নের নিমদী, ধানদী, ডালিমা, কচুয়া ও তাঁতেরকাঠী এলাকা রক্ষায় টেকসই প্রকল্প গ্রহনের দাবিতে নদীপাড়ে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালন করেছেন স্থানীয়রা। ইতিমধ্যে নিমদী সরকারি প্রাইমারি স্কুল রক্ষায় মাত্র ২০০ মিটারে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হলেও অরক্ষিত পড়ে আছে ভাঙন কবলিত বিশাল এলাকা। স্থানীয় মাহবুবুর রহমান চৌধুরির অভিযোগ স্কুল রক্ষায় জিওব্যাগ ফেলা হলেও একই এলাকায় লঞ্চঘাট থাকায় পন্টুনের বাহিরে অনেক সময় ডবল ডেকার লঞ্চ ঘাট দেওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ওই জিও বাগের বাঁধ।
‘সেভ দি বার্ড এ্যান্ড বি’ নামে প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশ বিষয়ক স্থানীয় সংগঠনের পরিচালনা পরিষদের একজন মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘বৈশ্বয়িক আবহাওয়ার পরিবর্তণ, প্রভাবশালীদের স্লুইজগেট দখল এবং ঘনফাসের অবৈধ বাঁধা জালের কারণে নদীর স্রোতের গতিপথ পরিবর্তণ হয়ে ভাঙছে ধুলিয়া, মঠবাড়িয়া, নিমদী, ধানদী, বড়ডালিমা, চরব্যারেট, চর রায়সাহেব ও চরওয়াডেলের মতো এলাকা।
বিরুপ আবহাওয়া আর মানবসৃষ্ঠ এসব কারণে নদীর দু’কুল যেমন ভাঙছে তেমনি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তেঁতুলিয়ার মৎস্য সম্পদও। এভাবে চলতে থাকলে বাউফলের মানচিত্র থেকে অচিরেই নিশ্চিহ্ন হয়ে নদী পাড়ের বিশাল এলাকা।’ নদী ভাঙ্গন রোধে টেকসই প্রকল্প গ্রহনেরও দাবী জানান তিনি।
Leave a Reply