শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৮ পূর্বাহ্ন
আরিফ বিল্লাহ নাছিম, কলাপাড়া (কুয়াকাটা) প্রতিনিধি : পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটাসহ উপকূলীয় এলাকার অংলকার খ্যাত রাখাইন সম্প্রদায় নিজ ভুমিতে পরবাসী হয়ে পড়েছেন। জমি বেদখল, হামলা-মামলা, অন্যায়, অবিচার, বঞ্চনার ও প্রতারণার শিকার হয়ে পার্শবর্তী দেশ মায়ানমার ফিরে যাচ্ছে।
এ অঞ্চলে বসবাসরত রাখাইন সম্প্রদায় ৫০ হাজারের বেশী জনগোষ্ঠী থেকে দিন দিন কমে এখন ৪ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়ত এমন একদিন আসবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম শুধু কাগজপত্রেই এ অঞ্চলের রাখাইন সম্প্রদায় সম্পর্কে জানতে পারবে। তবে তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে এমন আশংকা রয়েছে।
এর পিছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে বলে কুয়াকাটায় বসবাসরত বৌদ্ধ ধর্মালম্বী রাখাইন সমাজপতিরা দাবী করেছেন। তাদের মতে, জন্মসুত্রে ও পরিচয়গতভাবে রাখাইনরা বাংলাদেশে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হলেও স্থানীয় রাজনীতিতে আজও তারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নিজ ভাষাসহ সাধারণ শিক্ষায় রাখাইনরা অনগ্রসর ও পশ্চাপদ। রাখাইন শিশুরা পিতা-মাতার নিকট থেকে নিজস্ব ভাষা আয়াত্ব করে কথা বলতে পারলেও তারা লিখতে-পড়তে পারে না। কারণ তাদের নিজস্ব ভাষা শিক্ষার জন্য কোন প্রতিষ্ঠানিক সুযোগ নেই।
প্রধান জনগোষ্ঠী বাঙ্গালি সমাজের একশ্রেনীর লোকদের ভূমিগ্রাসের হীন তৎপরতায় রাখাইনরা প্রতারিত ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে দিনের পর দিন। ফলে কৃষি জমি হারিয়ে বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দারিদ্র ক্রমশ ঘিরে ধরেছে তাদের। চলমান আইন শৃংখলা পরিস্থিতি কোনক্রমে বিপর্যস্ত হলেই এ সম্প্রদায় নিতান্তই নিরুপায় ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তারা গা ঝাড়া দিয়ে আর উঠতে পারে না। নিজেদের মধ্যে সংগঠনিক শক্তিকে সংহত করতে না পেরে এ অঞ্চলে বসবাসরত রাখাইনরা সকল ক্ষেত্রে সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে। জাতিগত ও শ্রেনীগতভাবে প্রশাসনের লোকদের সাথে রাখাইনদের অবস্থানগত পার্থক্য রয়েছে এবং সে কারণেও প্রশাসনের সহযোগিতা ও অনুকম্পা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন।
স্থানীয় ভূমিগ্রাসীদের আগ্রাসন মনোভাবের কারণে চাষের জমি হারিয়ে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাবে রাখাইনরা দেশান্তরিত হচ্ছে। গত ১০ বছরে শুধুমাত্র লতাচাপলী (কুয়াকাটা) ইউনিয়নের নয়াপাড়া বসবাসরত সেকালের জনপ্রতিনিধি সেচামং রাখাইন, সেঅংজান তালুকদার, গোড়াআমখোলাপাড়ার সমাজপতি মংনান্ট তালুকদার লতাচাপলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে দুই’শ কম ভোটের ব্যবধানে হেরেছিলেন। পরবর্তীতে জমিজমা বেহাত হওয়ায় ছেলেমেয়েদের মিয়ানমার পাঠিয়ে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে স্ব-স্ত্রীক জন্মভূমি ত্যাগ করেন।
একই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে গত বছর গোড়াআমখোলা পাড়া আশ্রায়ন প্রকল্পের বসাবাসকারী স্ব-পরিবারে মংনান্টচিন ও তেওয়ার দেশান্তরিত হয়েছে। দিয়ারআমখোলাপাড়া থেকে স্ব-পরিবারে থয়সাইচিন, লক্ষীপাড়ার লাক্রুসে জন্ম ভূমি ছেড়েছেন অনেক আগেই। এভাবে নাম না জানা কুয়াকাটাসহ উপকূলীয় এলাকা থেকে অসংখ্যক রাখাইন পরিবার বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার পাড়ি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন গোড়াআমখোলা পাড়ার চানসে রাখাইন ও তার পিতা লাচিমোর ৬ সদস্যের একটি যৌথ পরিবার। চলতি বছরের শেষদিকে অথবা আগামী বছরের প্রথমদিকে মিয়ানমার যাবেন বলে পরিবারটি জানিয়েছেন।
একই পাড়ার তেননান ও মংথুই পরিবার জমিজমা নিয়ে হামলা মামলার শিকার হয়ে এখন নিঃস্ব প্রায়। জমিজমা সংক্রান্ত ঝামেলা মিটাতে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এ থেকে দ্রুত নিস্পত্তি না হলে হয়ত এ পরিবারটিও পাড়ি দিবেন।
তেননান রাখাইন এর বাবা মংথুই রাখাইন জানান, স্থানীয় ভূমিদস্যুরা তাদের পরিবারকে দেশ ছাড়া করার অসৎ লক্ষ্যে তার মালিকানাধীন ১৩ একর জমি জাল-জালিয়াতিভাবে ভূঁয়া বায়না দলিল সৃষ্টি পূর্বক হয়রানী করছে। তাদের প্রায় ১০একর জমি প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসীরা গ্রাস করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
এছাড়াও দেশ ত্যাগ করে পাশ্ববর্তী দেশ মায়ানমার, বার্মায় ফিরে যাওয়ার পিছনে কাজ করছে একটি কুসংস্কার। রাখাইন সম্প্রদায় অনেকেই বিশ্বাস করে তাদের বসবাসের আশেপাশে যখনই বাঁধ বা ভেরী নির্মান ও নদীগুলো ভরাট হবে এবং আরাকান ভূখন্ড হতে এ অঞ্চলে আগমনের মেয়াদ দু’শত বছর (১৭৮৪-১৯৮৪) অতিবাহিত হবে তখন আর এ অঞ্চলে তাদের বসবাস করা উচিত নয়। এরপরও কেউ বসবাস করলে তাদের ওপর নেমে আসবে নানা রকম দূর্যোগ ও বিপদ এমন বিশ্বাস রাখাইনদের পূর্ব পুরুষ থেকে চলে আসছে। এ কুসংস্কার এ অঞ্চলে বসবাসরত রাখাইনরা আজও বিশ্বাস করছে।
কুসংস্কারের বিষয়ে প্রবীন রাখানইন সমাজপতি বাবু মংনান্ট তালুকদার এর একটি লেখা থেকে জানা যায়, এ অঞ্চলে বসবাসরত রাখাইনরা কুসংস্কার বিশ্বাস করে বিধায় কিছু সংখ্যক রাখাইন দেশ ত্যাগ করেছেন।
কখন কিভাবে এ অঞ্চলে রাখাইন উপজাতির আগমন ঘটে : আনুমানিক ২শ’ বছরেরও আগে ইংরেজী ১৭৮৪ খৃষ্টাব্দে, বাংলা ১১৯১ সালের শীতের হীম হাওয়ায় মগ্ন নিশিত রাতের অন্ধকারে আরকানের মেঘাবতী এলাকা থেকে ১শ’ ৫০টি রাখাইন পরিবার ৫০টি নৌকা নিয়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে পূর্ব থেকে সোজা পশ্চিম দিকে চলে আসে। ৩ দিন ৩ রাত পর বাংলার পটুয়াখালী (তৎকালীন বাকেরগঞ্জ) জেলার উপকূলীয় রাঙ্গাবালী দ্বীপে আশ্রয় নেয়। জন মানবহীন এক সমুদ্র দ্বীপে হিংস্র, জীবজন্তুুতে ভরা সেই অরণ্য ভূমি রাঙ্গাবালীতে আসার পেছনে রাখাইনদের ছিল এক করুন ইতিহাস। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রমান পাওয়া যায়, খ্রিঃ পূর্ব ২৬৬৬ থেকে ১৭৮৪ পর্যন্ত আরাকান ছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য। ম্রাউ রাজ বংশের শেষ সম্রাট থামাদা (১৭৮২-১৭৮৪) যখন আরাকানের সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন, তখন বর্মী শাসক বোধপায়া (১৭৮২-১৮১৯) এই ক্ষুদ্র রাজ্যটিকে প্রায় ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে আক্রমন করেন।
আরাকানের আদিবাসীরা বর্মী শত্রু বাহিনীকে প্রচন্ডভাবে বাঁধা দেয়। কিন্তু আরাকানীরা বর্মী সেনাবাহিনীর নিকট এক সময় পরাজিত হন। কেননা বর্মীদের সৈন্য সংখ্যা আরাকানীদের অপেক্ষায় অনেক বেশি ও রণকৌশলী এবং সুদক্ষ। সম্রাট থামাদা বর্মীদের হাতে বন্দী হয়ে প্রানদন্ডে দন্ডিত হলেন। এভাবে আরাকান ১৭৮৫ খ্রিঃ তার স্বাধীন সত্ত্বা হারিয়ে বার্মার একটি প্রদেশে পরিনত হয়। বর্মী সেনাবাহিনী পরাজিত আরাকানীদের ওপর নৃশংস অত্যাচার শুরু করে। বর্মীদের অত্যাচার ও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে আত্মরক্ষার জন্য ১শ’ ৫০টি পরিবার এভাবেই রাঙ্গাবালীর দ্বীপে সেসময় আশ্রায় নিয়েছিল।
এ অঞ্চলে রাখাইনদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম : তারা স্ব-দেশ হতে তাদের সঙ্গে আনা ধারালো অস্ত্র যেমন দাও, ছেনা, বল্লম, লেজা ইত্যাদি দিয়ে বনজঙ্গল পরিস্কার করে কৃষি ভূমিতে রূপান্তর করে। চলে আসার সময় স্বদেশ থেকে সাথে করে নিয়ে আসা ধান ও অন্যান্য ফলমূলের বীজ বপণ শুরু করে। তখনকার দিনে ওই সকল দ্বীপ ছিল বন জঙ্গলে ঘেরা জন মানবহীন বনভূমি। বন্য মহিষ, বন্য গরু, হিংস্র বাঘ অর্থাৎ পশুরাই ছিল সেখানকার আদিবাসী। নদী খালে ছিল অসংখ্য কুমীর। তারপরও গাছপালা কেটে ঝোপঝাড় পরিস্কার করে প্রথমে স্বপরিবারে থাকার টং ঘর তৈরি করে। দ্বিতীয়ত্ব আবাদ করা জমি তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে পত্তন নিয়েছিল তারা।
সাথে আনা হাতিয়ার দিয়ে হিংস্র জীবজন্তু দমন করতে পারলেও রাঙ্গাবালীতে বড় বড় ইদুরের উৎপাত ছিল অনেটা বেশী। এ কারনে তাদের আবাদকৃত অধিকাংশ ফসলই নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার বহু চেষ্টা করেও কোন প্রকার প্রতিকারের উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না তারা। আরও একটা বড় সমস্যা ছিল সুপেয় পানীয় জলের। লবনাক্ত পানি খেয়ে খেয়ে তাদের পেটের পীড়া দেখা দিতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে একজন ইউরোপিয়ান নেভাল অফিসার ভাগ্যক্রমে রাখাইনদের অবস্থান খুঁজে পান। ওই অফিসার মাঝে মাঝে তাদের নিকট আসা যাওয়া করতেন। একসময় রাখাইন সমাজপতিদের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্কের সৃষ্টি হয়।
রাখাইনদের সমস্যার কথা শুনে ওই অফিসার প্রথমে তাদের জরুরী ঔষধপত্র, প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড়, পানীয় জলের ব্যবস্থা করেন। এরপর অফিসারের সাহায্য সহযোগীতায় রাখাইনরা ওই দ্বীপ ছেড়ে একটু পশ্চিমে একই জেলার বড়বাইজদিয়া নামক এলাকায় এসে পুনরায় বসতি স্থাপন করেন। এসময় নেভাল অফিসার কিছু অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে এমন তথ্যও পাওয়া যায়। এখানে যারা এসে ছিলেন সবাই কৃষিজীবি। জঙ্গল আবাদ করা, জঙ্গলের জন্তু জানোয়ারের সঙ্গে লড়াই করা, মাছ ধরার নিয়ম-পদ্ধতি এ সবই তাদের আয়ত্বে ছিল। রাখাইন জনগোষ্ঠি পটুয়াখালী এলাকায় আসার প্রায় ৫০ বছর যেতে না যেতেই ১৮৩৪-১৮৮৪ খ্রিঃ পর হতে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা ও কলাপাড়া এবং বরগুনা জেলার আমতলী ও তালতলী অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বসতি ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়াও অন্য একটি সূত্রে পাওয়া যায়, রাখাইন সম্প্রদায় প্রথম আরকান থেকে রামু ও কক্সবাজার আসে। পরে স্থানান্তরিত হয়ে বৃহত্তর পটুয়াখালী জেলায় আসে (তখন বরগুনা জেলা ছিল না)।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-প্রান্তসীমার শেষ ভুখন্ড পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া ও গলাচিপা থানা এবং বরগুনা জেলার বরগুনা সদর ও আমতলী থানার মধ্য থেকে নতুন সৃষ্ট থানা তালতলী সমুদ্র উপকূল জুড়ে রাখাইন জনগোষ্ঠিরা একচেটিয়া বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হলে তারা বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করে।
বিশেষ করে সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটার আশপাশের গ্রামগুলির মধ্যে কালাচানপাড়া, গোড়াআমখোলাপাড়া, দিয়ারআমখোলাপাড়া, নয়াপাড়া, নাইউরী পাড়া, মংথয়পাড়া, থঞ্জুপাড়া, মিশ্রিপাড়া, লক্ষ্মীপাড়া, বৌলতলীপাড়া, পক্ষীয়াপাড়া, কেরানীপাড়ায় এখনও রাখাইনরা বসবাস করছেন। আমতলী উপজেলার তালতলী থানার আশপাশে তালতলীপাড়া, ছাতনপাড়া, গোড়াঠাকুরপাড়া, আগাঠাকুরপাড়া, মনুসেপাড়া, অংকোজানপাড়া, তাতেপাড়া, লাউপাড়া, নামেসেপাড়া, কবিরাজপাড়া, সওদাগাড়পাড়া ও তালুকদারপাড়ায় এখনও রাখাইনরা স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে।
চল্লিশ শতকের শেষভাগে এ অঞ্চলগুলোতে সর্বমোট ২৪২টি রাখাইন পাড়া বা পল্লী ছিল বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। তবে বাড়ি বা ঘরের সংখ্যা ও জনসংখ্যার পরিসংখ্যান সঠিকভাবে পাওয়া যায়নি। তখনকার সময়ের প্রবীন রাখাইনদের কাছ থেকে শোনা যায়, পটুয়াখালী জেলায় ৫০ হাজারের উপরে রাখাইনদের বসবাস ছিল। বর্তমানে রাখাইন জনসংখ্যা ৪ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। অপরদিকে বহু রাখাইন পাড়া আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং অবশিষ্টগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে।
বিলুপ্তি হওয়া রাখাইনদের নামকরণ : কুয়াকাটা ও এর আশেপাশে এবং তালতলীর বড় বগি এলাকার এরকম বহু পাড়া নামে থাকলেও সেখানে কোন রাখাইনদের বসবাস নেই। রাখাইনদের বসবাস না থাকায় তাদের দেয়া নাম ব্যবহৃত হয় না। রাখাইন পল্লীর প্রধান বা মাদবরের নামে গ্রামের নাম হলেও বর্তমানে তাও বিলুপ্তে পথে। দেশের প্রধান জনগোষ্ঠি মুসলামানদের নামে নতুন করে নামকরণ করেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, লতাচাপলী ইউনিয়নের পুনামাপাড়া থেকে ইসলামপুর, ডংকুপাড়া থেকে রসূলপুর, হুইচানপাড়া থেকে হোসেন পাড়া, কালাচানপাড়া থেকে আলীপুর, নাইউরীপাড়া থেকে খাজুরা নামকরণ করা হয়েছে।
রাখাইনদের পল্লীর বর্তমান অবস্থান : গলাচিপা উপজেলা বড়বাইজদায় ২৬টি পাড়া ও ৪২০টি ঘর থেকে এখন ৫টি পাড়া ২২টি ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। তেমনি বরগুনা সদর বালিয়াতলীতে ৯টি পাড়ায় ৩৯০টি ঘর ছিল এখন সেখানে পাড়ার সংখ্যা রয়েছে মাত্র ১টি এবং ঘরের সংখ্যা ৩টি। এভাবে কালক্রমে হারিয়ে যেতে থাকে দক্ষিনাঞ্চালে বেশী বসবাসরত রাখাইন সম্প্রদায়।
যেভাবে রাখাইনদের সংখ্যাগরিষ্ঠাতা হ্রাস পায় : পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে রাখাইনদের বসবাসের এলাকাগুলোতে বাঙ্গালী মুসলমানদের আগমন ঘটে। তারা রাখাইনদের আবাদী জমি বর্গা চাষ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করত। পরবর্তীতে জমির ওপর এক শ্রেনীর চক্রান্তকারী ও সুযোগ সন্ধানী বাঙ্গালীদের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে এ সম্প্রদায় তাদের জমি হারাতে থাকে। এছাড়াও ৫০ থেকে ৬০ দশক জুড়ে অত্র এলাকায় ঘন ঘন প্রাকৃতিক দূর্যোগ বিশেষ করে ঘূর্নিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবনাক্ততা, অনাবৃষ্টি, মহামারি ইত্যাদি কারণে রাখাইনরা অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী জীবনে ছেদ পড়ে। এক সময় রাখাইনরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রকৃতিক ঘূর্নিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে অসংখ্য মানুষ মারা যায় এবং জমির দলিলপত্র হারিয়ে গেলে এ সুযোগে বাঙালীরা ভূয়া জালজালিয়াতি দলিল সৃষ্টি করে জমি দখলে নেয়।
রাখাইনদের জমি হাতছাড়া হওয়ার ব্যাপারে গোড়াআমখোলাপাড়ার বাসিন্দা তেননান্ট রাখাইন বলেন, একটি স্বার্থনেশী প্রভাবশালী মহল ভূয়া কাগজপত্র তৈরী করে আমাদের জমি দখলে নেয়ার পায়তারায় সর্বদা লিপ্ত রয়েছে।
রাখাইনরা এক সময় জায়গা জমি ধন দৌলতে খুবই স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ ছিল। প্রত্যেক পরিবারে প্রচুর চাষের জমি ও ধন দৌলত থাকায় তাদের বাড়তি আয়ে তারা গড়ে তুলেছিলেন বড় বড় বৌদ্ধ বিহার (প্যাগোডা), শ্মশান (চে-শেই) ও শান বাধানো পুকুর। সাঁজ পোশাক, সোনা-গয়না পড়ে রাখাইন মেয়ে ও বৌ’রা সদা হাসি খুশিতে মেতে থাকত। ১৯৩০ হতে ১৯৬০ খ্রিঃ পর্যন্ত প্রতিটি রাখাইন পাড়ায় শত শত রাখাইন নারী-পুরষ ও শিশুরা নানা আমোদ ফূর্তিতে দিন কাটাত। প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং বৈশাখী পূর্নিমা, চৈত্র সংক্রান্তি বা সাংগ্রান, নববর্ষ উৎযাপনে জলকেলী উৎসবসহ সবকটি পূর্নিমার তিথিতে রাখাইনরা ব্যাপক আনন্দে করত। এছাড়া শ্রমন ও বিবাহ অনুষ্ঠান, মৃত্যুর পর শ্রদ্ধা নিবেদন, বিশেষ করে বৌদ্ধ বিহারাধ্যক্ষের মৃত্যু পরবর্তী শ্রদ্ধা নিবেদন ভাবগম্বীর পরিবেশে বৃহৎ উৎসব আকারে সম্পন্ন করা হত। রাখাইনরা আমোদ প্রমোদ অত্যন্ত পছন্দ করেন। কারো সঙ্গে দেখা হলে নারী পুরুষ নির্বিশেষে অভিবাদন জানান এবং মৃদু হেসে কুশল বিনিময় করেন। এটি রাখাইনদের ঐতিহ্যগত স্বভাবের অর্ন্তগত। সেই কল-কাকলিতে সদা মুখরিত রাখাইন জনপদ যেন বিরান ভূমে পতিত হচ্ছে। বর্তমানের এ সম্প্রদায়টি ভূলতে বসেছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। বছরে দু-একটি অনুষ্ঠান উৎযাপিত হলেও তা শুধুই নামে মাত্র।
সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাখাইন শিল্পগোষ্ঠি’র পৃষ্ঠপোষক গোড়া আমখোলাপাড়ার বাবু চোতেন বলেন, আর্থিক দৈন্যতায় দ’ুবেলা-দ’ুমুঠো খাবার সন্ধান করতেই যখন বেগ পোহাতে হচ্ছে তখন সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করা অস্বাভাবিকই বটে। তারপরও বিলুপ্ত হওয়া এ রাখাইন সংস্কৃতি ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধের কারণে আকঁড়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। সরকারী-বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ সংস্কৃতি পূনঃরূদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস।
কুয়াকাটা শ্রী মঙ্গল বৌদ্ধ বিহার সভাপতি বাবু মংচুমিন তালুকদার জানান, তাদের আবাদি জমি বেদখল, হামলা-মামলা, অন্যায়, অবিচার, বঞ্চনার ও প্রতারণার শিকার এ সম্প্রদায় পার্শ্ববর্তী দেশে পাড়ি দিচ্ছেন।
কলাপাড়া উপজেলা রাখাইন সমাজকল্যান সমিতির সভাপতি উসুয়ে বাবু বলেন, আমরা এ অঞ্চলের আদিবাসী হলেও আজও আমাদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ থেকে উত্তোরণের জন্যই রাখাইন সমাজকল্যান সমিতি কাজ করছে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার আর একটু আন্তরিক হলে আমরা আমাদের ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারব।
এ ব্যাপারে রাখাইন সমাজপতি ও রাখাইন বুড্ডিষ্ট ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশন সভাপতি বাবু উথাচিন মাতুব্বর জানান, ৫০ থেকে ৬০ দশক জুড়ে এ এলাকায় ঘন ঘন প্রাকৃতিক দূর্যোগ ঘূর্নিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে অসংখ্য মানুষ মারা যায় এবং বন্যা পরবর্তী সময়ে কিছু সংখ্যক লোক দেশ ত্যাগ করেছেন। তাছাড়া প্রাকৃতিক দূর্যোগে তাদের দখলীয় জমির দলিলপত্র হারিয়ে গেলে এই সুযোগে একটি স্বার্থনেশী মহল ভূয়া জালজালিয়াতি দলিল সৃষ্টি করে জমি দখলে নেয়। পরবর্তীতে আর্থিক অভাব অনটনের কারণে অনেকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। তিনি দাবী করেছেন সরকার এসব ভূমি দস্যুদের কঠোর হাতে দমন করলে রাখাইনরা হারানো অস্তিত্ব ফিরে পাবে।
রাখাইনদের অস্তিত্ব সংকটের ব্যাপারে বেসরকারী সংস্থা কুয়াকাটা ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’র নির্বাহী পরিচালক রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, এ অঞ্চলের বসবাসরত রাখাইনরা তাদের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি সংকটে ভুগছে সত্য। তাছাড়া এ এলাকার জমি মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় ভূমি দস্যুদের প্রতারণার কবলে পড়ে তাদের জমি বেহাত হচ্ছে বিধায় তারা এখানকার জমি বিক্রয় করে পার্শ্ববর্তী দেশ মায়নমারে কম দামে জমি কিনতে পারছে।
তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তারা ধীরে ধীরে দেশ ছাড়ছেন।
রাখাইন নারী আন্দোলনের নেত্রী ও বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস’র রাখাইন আইসিডিপি বরিশাল বিভাগীয় প্রকল্প ইনচার্জ মেইনথিন প্রমিলা বলেন, স্থানীয়ভাবে রাখাইনদের ভোগদখলীয় জমি বন্ধক রাখার কথা বলে বিভিন্ন চুক্তিতে কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে একটি গোষ্ঠির জমি দখলে নেয়ার প্রচলন চালু ছিল। এ থেকে প্রতিকার পাওয়ার জন্য তাদের পাশে কাউকে পায়নি। তবে গত পাঁচ বছরে এর প্রচলন কিছুটা হলেও কমেছে। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস ২০০৭ সাল থেকে রাখাইন সম্প্রদায়কে সংগঠিত করার জন্য তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছে।
Leave a Reply