শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৫ অপরাহ্ন
ভোলা প্রতিনিধি॥ ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. সাজু বয়াতি (৪৮)। ১০ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে মেঘনা নদীতে মাছ শিকার শুরু করেন। তখন থেকে আজও তিনি জেলে পেশায় রয়েছেন। বয়সের ভারে তার বাবা এখন আর নদীতে যেতে পারেন না।
একাই নদীতে মাছ শিকার করে বৃদ্ধ বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ছয়জনের সংসার চালাতে হয় সাজু বয়াতিকে। কয়েক বছর আগেও নদীতে মাছ ধরেই তাদের সংসার চলত। কিন্তু গত দুই বছর ধরে সেটি আর হয়ে উঠছে না। নদীতে মাছ না পেয়ে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ও ধার-দেনা করেই সংসার চলছে তাদের। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ধার-দেনা করেই। এক ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তার লেখাপড়ার খরচও জোগাতে হয়। সংসারের খরচ, ছেলের লেখাপড়াসহ অন্যান্য খরচ জোগাতে গিয়ে দিন দিন ঋণের বোঝা ভারী হচ্ছে সাজু বয়াতির।
তিনি জানান, অক্টোবর মাসে মা ইলিশ রক্ষা অভিযানের ২২ দিন পর অনেক আশা নিয়ে নদীতে মাছ শিকারে গেছেন। আশা ছিল, নদীতে মাছ শিকার করে এনজিওর ঋণের কিস্তি ও ধার-দেনা পরিশোধ করবেন। অভিযান শেষ হওয়ার পর এক সপ্তাহ মোটামুটি মাছ পাওয়া গেলেও গত ২০ দিন ধরে নদীতে তেমন কোনো মাছের দেখা নেই। এদিকে নদীতে মাছ না থাকায় তার ট্রলারের অন্য জেলেরা নদীতে যেতে চাইছেন না। তাই গতকাল স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে নিয়েই নদীতে মাছ শিকারে যান তিনি। কিন্তু সাত শ টাকার তেল খরচ করে মাছ পেয়েছেন মাত্র ৩৮০ টাকার। এনজিওর ঋণের কিস্তি, আড়ৎদারের দাদনের টাকা ও সংসারের খরচ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন জেলে সাজু বয়াতি।
সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের সাহামাদার গ্রামের রফিক মাঝি জানান, মা ইলিশ রক্ষা অভিযানের পর থেকে নদীতে বেশ কিছু পাঙ্গাশ মাছ পাওয়া যায়। মাঝে মধ্যে ইলিশ মাছও দেখা যেত। কিন্তু প্রায় ১৫-২০ দিন ধরে নদীতে মাছ নেই। গতকাল (বুধবার) সাতজন জেলে নিয়ে নদীতে মাছ শিকারে গিয়ে তেলসহ তাদের মোট খরচ হয় তিন হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু জালে শুধু একটি ছোট আকারের পাঙ্গাশ আর তিনটি জাটকা ইলিশ ধরা পড়ে। এ মাছ ঘাটে এনে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন।
তিনি আরো জানান, তার ট্রলারের সব জেলেকেই এনজিওর ঋণের কিস্তি দিতে হয়। তাই ঋণের কিস্তি পরিশোধে তারা অন্য পেশায় যাওয়ার চিন্তা করছেন।
শুধু সাজু বয়াতি আর জসিম উদ্দীন নয়, মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ না থাকায় ভোলা জেলার প্রায় দুই লক্ষাধিক জেলের অবস্থা একই। নদীতে মাছ ধরা না পড়ায় জেলেরা চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। অপরদিকে, মৎস্য ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন বিপাকে। নদীতে জেলেদেরকে লাখ লাখ টাকা দাদন দিয়ে এখন শূন্য হাতে বসে আছেন। ঘাটে তেমন বেচাবিক্রি নেই। তাই দাদনের টাকাও জেলেদের কাছে আটকে গেছে। একেকজন আড়ৎদার বিভিন্ন জেলেকে প্রায় ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা দাদন দিয়েছেন। এখন এই টাকা কিভাবে উঠবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না তাদের।
ভোলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম উপলক্ষে মা ইলিশ রক্ষায় নদীতে ২২ দিন সব ধরনের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। এক লাখ ৩২ হাজার জেলের জন্য নিষেধাজ্ঞাকালীন সরকারি ভিজিএফের ২৫ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। নিবন্ধিত এক লাখ ৫৮ হাজার জেলের বাইরে আরো অন্তত প্রায় ৫০ হাজার জেলে রয়েছেন। তাই সব জেলের ভাগ্যে জোটেনি বিজিএফের চাল। তারা আশায় ছিলেন, নিষেধাজ্ঞা শেষে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ পাবেন। তাদের সেই আশা প্রথমদিকে সত্যিও হয়। দীর্ঘদিন পর তারা প্রচুর পরিমাণ ইলিশ পাচ্ছিলেন। কিন্তু অভিযানের তিন দিন পর থেকে জেলেদের জালে ইলিশের পরিমাণ কমতে থাকে। এখন কিছু ডিমওয়ালা ইলিশ ও জাটকা ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। যে পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ছে, তা বিক্রি করে ট্রলারের ইঞ্জিনের তেলসহ অন্যান্য খরচের দামও উঠছে না বলে জানান জেলেরা।
ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্লাহ জানান, মা ইলিশ রক্ষার অভিযান শেষে কয়েক দিন প্রচুর পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ে। কিন্তু এখন সেটি কমে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ডিম ছেড়ে ইলিশ সাগরে চলে গেছে। তা ছাড়া এখন নদীতে পানি কম থাকায় ইলিশ নদীতে তেমন বিচরণ করছে না। সামনের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে নদীর পানি বাড়লে আবার ইলিশ ধরা পড়বে।
তিনি আরো জানান, এ বছর ইলিশের উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ৭৭ হাজার মেট্রিক টন। আগামী বছর ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন।
Leave a Reply