মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৭ অপরাহ্ন
শাকিব বিপ্লব॥ অবধারিত এই সত্যকে সবাই একবাক্যে স¦ীকার করলেও এই ধরাধাম ত্যাগের আকস্মিকতা অন্তত স্বজন-শুভাকাঙ্খীরা মেনে নিতে পারেনা। আমৃত্যু তাদের হৃদয়ে রেখে যাওয়া স্মৃতি যেমন কাঁদায়, সমরূপে অসময়ে চলে যাওয়ায় আফসোস থেকেই যায়। তাই যুবক মেহেদী হাসান মুরাদের মৃত্যুতে স্বজনদের মধ্যে চলছে অঝোর ধারায় রোদন।
ব্যথিত শুভাকাঙ্খীরাও অশ্রু সংবরণ করতে পারছে না গত বুধবার বিকেলে মুরাদের আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনায়। আওয়ামীলীগ ঘরনার সন্তান ও ঘোরতর সমর্থক হলেও রাজনীতির সিড়ি না পেরোলেও সর্ব মহলে ছিলো পরিচিত মুখ। বেশ কিছুদিন ধরে তার দুটি কিডনীতে সমস্যা দেখা দিলেও তার টগবগে চলাফেরায় কেউতো নয়, হয়তোবা নিজেও অনুমান করতে পারেনি এমন রোগে আক্রান্ত যে, তার সময়ের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। স্ত্রী ও এক পুত্রসহ ছোট্ট কণ্যাকে আর ¯েœহের বন্ধনে আগলে রাখার সময় নেই, যেতে হবে পরপারে। আর ফেরা হবেনা না ফেরার সেই দেশ থেকে।
গতকাল দুপুরে হাটখোলার নিজ বাসায় অসুস্থ বোধ করার সাথে সাথে শেবাচিমে নিয়ে আসার কিছু পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে নগরীর নাজিরপুল এলাকার মোঃ নুরুল আমিন মোল্লার এই জ্যোষ্ঠ পুত্র। সঙ্গত কারনে তার মৃত্যুর আকস্মিকতায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছে, থমকে দাড়িয়েছে শোকের সাগরে। সেই শোক ছায়া ফেলে গোটা নাজিরপুলসহ তৎসংলগ্ন কাউনিয়া এলাকায়। মুরাদের মৃতদেহ পৈত্রিক নিবাস নাজিরপুলের বাসায় নিয়ে আসা হলে একনজর দেখতে ঢল নামে দুরত্বে থাকা স্বজনসহ পরিচিতজনদের। মুরাদের নিথর দেহের সামনে সৃষ্টি হয় শোকের ভিন্ন এক পরিবেশে স্ত্রীর বারবার মূর্ছা যাওয়া ও দুই ভাই তিন বোন এবং মা-বাবার গগন বিদারিত চিৎকারে।
কান্না কি থামে? রাত বাড়ার গভীরতায় পরিবেশ কিছুটা নিরবতা ভর করে। রাত পোহাবার অপেক্ষায় লাশের চারিপাশে শুভাকাঙ্খীরা যেন ঘিরে রেখেছিলো মুরাদ যেনো এখনও জীবিত, যেনো অরক্ষিত থাকে। তাকে বাসায় পরথেকেই নির্দলীয় ও সর্বস্তরের মানুষ একনজর দেখে গেলেও নিজ দল আওয়ামীলীগের বরিশাল জেলা ও নগর সংগঠনের কোনো নেতৃবৃন্দ এক পা বাড়ালো না তার মৃত মুখটি একবার দেখা অথবা শোকাহত পরিবারকে সমবেদনা জ্ঞাপনে।
এমনকি নিজ এলাকার কাউন্সিলর এ্যাড. রফিকুল ইসলাম মামা খোকনসহ তার অনুসারীরাও ছিলো দূরত্বে। অথচ মুরাদের বাসা সংলগ্ন মহানগর আ,লীগের প্রভাবশালী নেতা এই ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বাসভবন। কি বিস্ময় এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব যে, মুরাদের বাসায় যখন রোদন চলছিলো তখন এই রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব নবজাগরণ ক্লাবে স্বভাব-জাত ভঙ্গিমায় আড্ডা দিচ্ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আফসোসের সুরে এমন তথ্য দিয়ে জানালো, মুরাদ পরিবারের সাথে রফিকুল ইসলাম খোকনের স্থানীয় আধিপত্য নিয়ে দীর্ঘ বিরোধ ছিলো। বিশেষ করে মুরাদের মেজো ভাই প্রয়াত সুহাদ তার জীবদ্দশায় এই নেতার সাথে ঐদ্ধত্ব্যপূর্ণ আচরণ নিয়েই তাদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়।
ছাত্রনেতা থাকা অবস্থায় রফিকুল ইসলাম খোকন অপেক্ষা সুহাদ ক্যাডারভিক্তিক রাজনীতিতে নিজের নামডাক বিস্তৃতি ঘটায়, সেই থেকে একটি রাগ-অভিমান এই নেতার হৃদয়কে আর সহানুভূতি নাড়া দিতে পারেনি। ২০০৬ সালে বিসিকে র্যাবের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সুহাদসহ এক সঙ্গী নিহত হলেও তৎসময়ে রফিকুল ইসলাম খোকন ছিলেন নিরব।
প্রশ্ন উঠেছে , মৃত্যুর পরেও কী শত্রুতা থাকে? আবার জনপ্রতিনিধি হলে তার কাছে দল এবং জাত-পাত থাকে নাকি? এ উত্তর কেউ না দিতে পারলেও ঠিকই লজ্জা দিয়েছে বিএনপি ঘরনার স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। একসময়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বর্তমান নগর বিএনপির প্রভাবশালী নেতা আকবর হোসেনসহ তার অনুসারীরা মুরাদের বাসায় ছুটে আসেন, জানাজার নামাজে অংশও নেন।
রাজনৈতিক বোদ্ধাদের অভিমত, সত্যিকার অর্থে যে বোঝে রাজনীতি সেতো নিজ উদ্যোগেই শত্রুর বিপদে তার চেয়েও পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার প্রক্কালে সবকিছুর উর্দ্ধে রেখে এগিয়ে আসে আগে। এমনও তো হতে পারতো, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে মুরাদের মৃত্যু পরবর্তী সার্বিক অনুষ্ঠানিকতা পালনে উদারতা বা সহানুভূতির নজির স্থাপন করতে পারতেন।
কিন্তু থাকলেন নিজের জায়গায় অনঢ়-অহমিকার মঞ্চে! ভাবতে হবে , একদিন নিজেকেও এই একই পথের যাত্রী হতে হবে, অবধারিত। ক্ষমতা-অহংকার যেমন চিরস্থায়ী নয় তদ্রুপ জীবনও। তারা এগিয়ে আসেনি তাই বলে কী ঠেকে থাকে কারও মৃত্যু পরবর্তী দাফন কার্যাদি? আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ব্রাঞ্চ রোড জামে মসজিদ সম্মুখে মুরাদের জানাজার নামাজে অংশ নিয়েছিলো সর্বস্তরের মানুষ। এসেছিলেন আ.লীগ ঘরনার অঙ্গসংগঠনের একমাত্র নেতা মুক্তিযোদ্ধা যুবকমান্ডের সভাপতি মেহেদী হাসানসহ তার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। পরে সকাল ১০টার কিছু আগে মুসলিম গোরস্তানে শায়িত করা হয় মুরাদকে না ফেরার দেশে যাওয়ার শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায়। সেই সাথে বিধাতার জ¤œ-মৃত্যুর খেলায় সমাপ্তি ঘটলো ৪৫ বছরের মুরাদের জীবনকাল। থাকতে পারে মুরাদের কিছু কর্ম নিয়ে সমালোচনা। আবার কোনো না কোনো উদাহরনে মুরাদ জায়গা করে নিয়েছে কারও বা মহল বিশেষের মনে।
স্মৃতির আয়নায় তাদের কাছে মুরাদের মুখবয় ভেসে উঠবে সময়ভেদে। কিন্তু তার পরিবার আমৃত্যু পর্যন্ত যন্ত্রনায় ভুগবে মুরাদকে নিয়ে স্মৃতিচারনে। তার রেখে যাওয়া এক ছেলে ও এক কন্যাসন্তান এখনও কাঁদছে আগামীতেও কাঁদবে, অপেক্ষায় থাকবে বাবার ফিরে আসার তাগিদ অনুভবে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় হয়তো মুরাদকে নিয়ে সমালোচকরা সবসময় সরবই থাকবে। ধীক্কার তাদেরই প্রাপ্তি। ভালো থাকো বন্ধুবর মুরাদ, একদিন তোমার সাথে আমারও একদিন দেখা হবে। তবে হিংসাত্মক রাজত্বের এপাড় নয়, শান্তির পরপারে।
Leave a Reply