সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৫ পূর্বাহ্ন
আকতার ফারুক শাহিন:বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে (বিসিসি) এক হাজার ভুয়া কর্মচারীর নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ লোপাটের ঘটনা উদ্ঘাটন করা হয়েছে। প্রায় দেড় যুগ ধরেই এ কায়দায় শত শত কোটি টাকা লোপাট হয়েছে নগর ভবনে।এর মধ্য দিয়ে বিসিসি একটি লোকসানি সংস্থায় পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া বেতনের দাবিতে নাগরিক সেবা বন্ধ করে দফায় দফায় ধর্মঘটও পালন করতে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানটির স্টাফদের।সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, স্টাফদের বেতন দেয়ার পরও বিসিসির রাজস্ব আয় দিয়েই উন্নয়ন খাতে অর্থ ব্যয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে এখন। নতুন মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর দুর্নীতির এ বিরাট ফাঁক বন্ধ করা হয়েছে। ফলে গত ৩ মাসেই সব বকেয়া পরিশোধের পর বিসিসির কোষাগারে জমা হয়েছে প্রায় ৭ কোটি টাকা। নগর ভবনের হিসাব বিভাগ সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।নগর ভবনের বাজেট কাম-হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আক্তারউজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। নতুন মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পরই এ সাগর চুরির বিষয়টি ধরা পড়ে।এ ব্যাপারে তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে যারা দায়ী হবেন তাদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য সাবেক দুই মেয়র আহসান হাবিব কামাল ও মজিবর রহমান সরোয়ারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেও তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি।পূর্ববর্তী মেয়রগণ অতিরিক্ত লোকবলের কারণে বিসিসিকে লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে আসছিলেন। সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণের সময় ছাড়া বাকি সব মেয়রের আমলেই মাসের পর মাস বকেয়া বেতনের ঝক্কি পোহাতে হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।নতুন মেয়র হিসেবে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর দায়িত্ব গ্রহণের সময়ও ৪ মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া ছিল স্টাফদের। পূর্ববর্তী প্রায় সব মেয়রই শত শত কোটি টাকার দেনা নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং দায়িত্ব ছাড়ার সময় কয়েকশ’ কোটি টাকার দেনা রেখে যেতেন।সাদিক আবদুল্লাহও ৩শ’ কোটি টাকা দেনা নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিসিসির প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস জানান, আগে স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের চেক যেত ব্যাংক ম্যানেজারের নামে।অস্থায়ী কর্মচারীদের বেতনের চেক মেয়রের নামে ব্যাংক থেকে ক্যাশ করিয়ে নগদ দেয়া হতো। বর্তমান মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি আগের নিয়ম বন্ধ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে আলাদা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করে বেতন-ভাতা পরিশোধের নির্দেশ দেন।স্বপন কুমার বলেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেতন যাওয়ার পর প্রায় এক হাজার অস্থায়ী ভুয়া কর্মচারীর সন্ধান মেলে। অথচ প্রতি মাসে ওই ভুয়া এক হাজার কর্মচারীর নামে ৭০-৮০ লাখ টাকা পরিশোধ দেখানো হতো।বছরে এর পরিমাণ সাড়ে ৮ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত এই খাতে লোপাট অর্থের পরিমাণ কয়েকশ’ কোটি টাকা। হিসাব বিভাগের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার আগে হিসাব বিভাগ থেকে প্রায় ২৬শ’ অস্থায়ী কর্মচারীর নামে বেতন হলেও এখন ১ হাজার ৫২৩ জনে নেমে আসে। আগে এ খাতে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয় হলেও এখন তা কমে দেড় কোটির কিছু বেশিতে দাঁড়িয়েছে।যানবাহনের জ্বালানি খাতেও হয়েছে সাগর চুরি। গত বছর ২৩ অক্টোবর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই নগর ভবনের গাড়ি ব্যবহার করছেন না নতুন মেয়র। বেতন-ভাতাও নিচ্ছেন না তিনি।অথচ নতুন মেয়রের নামে জ্বালানি বরাদ্দের বিষয়টি কানে আসে তার। এর কিছুদিন পরই গাড়ির তেল চুরি করে বিক্রির সময় হাতে-নাতে ধরা পড়েন একজন চালক। পরে তাকে পুলিশে সোপর্দ করার পর এ খাতেও নজর দেন তিনি। দ্রুতই ফল পাওয়া যায়।গত দু’মাস ধরে জ্বালানি তেল খাতে নগর ভবনের ব্যয় হচ্ছে মাসে সাড়ে ৪ থেকে পৌনে ৫ লাখ টাকা। অথচ এ খাতে আগে মাসে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হতো। সূত্র বলছে, ট্রেড লাইসেন্স এবং হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়েও বিস্তর দুর্নীতি ধরা পড়ে।এ নিয়ে কথা হয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব নেয়ার পর হোল্ডিং ট্যাক্স বিভাগকে নগরীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য সংগ্রহ করতে বলেন মেয়র।একই সঙ্গে তিনি নিজেও অনুসন্ধান শুরু করেন। পরে দেখা যায়, ট্রেড লাইসেন্স না করেই দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবসা করছেন- এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬ হাজারের বেশি। মাসোয়ারার বিনিময়ে তাদের ব্যবসার সুযোগ দেয়া হচ্ছিল। স্বপন কুমার বলেন, এ খাতে বছরে লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি টাকা।হোল্ডিং ট্যাক্স বিভাগের অ্যাসেসর মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বর্তমানে বরিশাল নগরীতে ৫০ হাজার ৩৫০টি হোল্ডিং রয়েছে। সরকারি হোল্ডিংয়ের সংখ্যা ৬৬২। বছরে এসব হোল্ডিং থেকে গড়ে প্রায় ১৭ কোটি টাকা ট্যাক্স আদায়ের কথা। হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণেও দুর্নীতি ধরা পড়েছে। চুরি, ঘুষ, তদবির এবং সুপারিশের কারণে ট্যাক্স ফাঁকি ধরা পড়েছে। বছরে ট্যাক্স ফাঁকির পরিমাণ ৮-১০ কোটি টাকা।কথা হয় ৪ মাস আগে মেয়রের দায়িত্ব নেয়া সাদিক আবদুল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব নেয়ার পর কাজ করতে গিয়ে দেখেছি খোদ নগর ভবনই দুর্র্নীতিগ্রস্ত। ভেতরে ভেতরে ফোকলা হয়ে গেছে সব।তাছাড়া সেবা পেতে যারা নগর ভবনে আসেন তাদের ঘুষ বাবদ গুনতে হচ্ছিল মোটা অঙ্কের টাকা। প্রথমে ঘর থেকেই শুদ্ধি অভিযানে নামি। নগর ভবন এখন ৯০ ভাগ ঘুষমুক্ত। তাছাড়া বেতন, জ্বালানি খাতের দুর্নীতি দূর করা সম্ভব হয়েছে।আমি কারও নাম বলব না, প্রশ্ন একটাই আমার আগে যারা মেয়র ছিলেন তারা কি এসব দেখেননি? অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট হল কিন্তু সেগুলো কার্যকর নয়।১৯৮৫ সালের পর এই নগরীতে আর কোনো ওভার হেড ট্যাঙ্কি হয়নি। কাগজে কলমে বলা হয় পানি সরবরাহের পরিমাণ ২ কোটি ৫ লাখ লিটার। অথচ সরেজমিন আমি পেয়েছি মাত্র ১ কোটি ৬০ লাখ।বিগত ৫ বছরে নগরীতে ১ ইঞ্চি পানি সরবরাহের লাইন বাড়েনি। ৭টি ওভারহেড ট্যাঙ্কির প্রায় সবই ব্যবহার অনুপযোগী। নগরীর জোয়ার-ভাটার খালগুলো ভরাট করে ড্রেন করা হয়েছে। কোনো মাস্টারপ্লান নেই।প্রায় ১৬ বছরে নগর ভবনে নেই কোনো রেকর্ড রুম। সব মিলিয়ে যেন একটা ভজঘট অবস্থা। দুর্নীতি বন্ধ করায় রাজস্ব আয় থেকে আমাদের সারপ্লাস দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি টাকারও বেশি। বিসিসির আয় থেকে উন্নয়ন খাতেও খরচ করতে পারব। আমি কিছুটা সময়ও চাইছি নগরবাসীর কাছে।
Leave a Reply