রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪০ অপরাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট: ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১৮ মিনিটের ভাষণে সমবেত জনসমুদ্রে জাতির উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ভাষণ জাতিকে অনুপ্রাণিত করে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। বাঙালির অধিকার ও মুক্তির জন্য দিকনির্দেশনাপূর্ণ সেই ভাষণে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দেন : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ইউনেস্কো ২০১৭ সালে এই ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সেদিনের ঐতিহাসিক জনসভায় সাউন্ড সিস্টেমের দায়িত্বে ছিল ‘কল-রেডী’। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন ‘কল-রেডী’র মাইক্রোফোনে ভাষণটি দিয়েছিলেন। ফলে এই মাইক্রোফোন ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। ঐতিহাসিক বিচারে এর গুরুত্ব থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান স্বত্ত্বাধিকারী মনে করেন, সরকারিভাবে যথাযথ সম্মান বা গুরুত্ব পায়নি ‘কল-রেডী’। মাইক্রোফোনটি নিলামে বিক্রির জন্য বিদেশে পাঠিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
সর্বশেষ মঙ্গলবার (৫ মার্চ) ‘কল-রেডী’র স্বত্ত্বাধিকারীদের একজন বিশ্বনাথ ঘোষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে মূল্যায়িত না-হওয়ায় রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চ ব্যবহৃত সেই মাইক্রোফোন নিলামে তোলার জন্য তারা মুম্বাই পাঠিয়েছেন। জার্মানিতে এটি নিলামে তোলা হবে। নিলামের কাজটি দেখভাল করছে মুম্বাইয়ের এক প্রতিষ্ঠান। বিশ্বনাথ ঘোষ প্রতিষ্ঠানটির নাম বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
‘কল-রেডী’ দেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৫২ সালের ভাষা অন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশে এই প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোফোনে অগ্নিঝরা বক্তৃতা করেছেন দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদগণ। এই তালিকায় রয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিদেশীদের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, প্রণব মুখার্জি, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনসহ অনেকেই।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি দেখভাল করছেন সাগর ঘোষ, রানা ঘোষ, বিশ্বনাথ ঘোষ ও শিবনাথ ঘোষ। তারা চার ভাই। বিশ্বনাথ ঘোষের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এর আগে তারা মাইক্রোফোনটি প্রধানমন্ত্রীকে দিতে চেয়েছিলেন- সে বিষয়ে জানতে চাইলে অভিমানের সুরে বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, ‘এটার কোনো ফল হয়নি।’
‘এখন সব প্রোগ্রাম হচ্ছে ইভেন্টের মাধ্যমে। ইভেন্টওয়ালারা যদি আমাদের ডাকে, তাহলে আমরা ইভেন্টের মাধ্যমে যাই। কিন্তু সরাসরি আর সেইভাবে প্রোগ্রাম আমরা পাচ্ছি না। আগে যেভাবে সরাসরি আমাদের সাথে কানেকশন ছিল এখন সেভাবে আর নেই। মূল কথা কল-রেডী সঠিক মূল্যায়িত হচ্ছে না।’ বলেন বিশ্বনাথ ঘোষ।
তিনি আরো বলেন, ‘সবাই কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে। সবাই সব কিছু পাচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে সবাই। কিন্তু আমাদের স্টাফরা, আমরা যাই কিছু করেছি, স্বীকৃতি বাদ দেন, ১০ হাজার টাকা করেও আমাদের স্টাফদের যদি সম্মাননা দেওয়া হতো তাও ভাবতাম যে আমাদের দিকে একটা দৃষ্টি আছে।’
‘বাবার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ছিল। এই এলাকায় বঙ্গবন্ধু এসে সময় কাটাতেন। তোফায়েল আহমেদ বলেছেন আমাদের দোকানে তারা আড্ডা দিতেন। এসব শুনেছি বাবা-দাদাদের মুখে। নির্মলেন্দু গুণও লিখেছেন। আমাদের আর দেওয়ার মতো কিছু নেই। যে পার্টির সঙ্গে আমরা এত বছর ধরে যুক্ত; ১৯৪৭ সাল থেকে, সেই পার্টি আমাদের দেখছে না।’ ক্ষোভের সঙ্গে বলেন বিশ্বনাথ ঘোষ।
কাজ না-পাওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন? এ প্রসঙ্গে বিশ্বনাথ বলেন, ‘আসাদুজ্জামান নূরের এশিয়াটিক, উনি যদি একসঙ্গে সব কাজ প্যাকেজ নেয়, তাহলে আমাদের রইলো কী? আমার কাছে আসে শুধু ৬০টা মাইকের জন্য। এই কাজের জন্য আমি যাব না। প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেব।’
বঙ্গবন্ধু যে মাইক্রোফোনে ৭ই মার্চ ভাষণ দিয়েছিলেন সেটি এখন কী অবস্থায় রয়েছে? জানতে চাইলে বিশ্বনাথ ঘোষ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘এসব আর এখন নেই। আপনি নিউজ করেন একটা- বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক সরঞ্জাম বিলুপ্ত হয়ে গেল!’
মাইক্রোফোনটি সর্বশেষ কবে ব্যবহৃত হয়েছিল? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে যে সিনেমাটা হয়েছে তখন আমরা সেসব দিয়েছিলাম। আরিফিন শুভ সিনেমায় সত্যিকারের ওই মাইক্রোফোন দিয়েই ভাষণ দিয়েছে। আমি নিজে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সে সময় তারা আমাদের বলেছিল- সিনেমাতে কল-রেডীকে ১০ সেকেন্ডের জন্য প্রমোট করবে। বাংলাদেশে যে কো-অর্ডিনেটর ছিল তার সঙ্গে কথা হলো। সিনেমাতে ১০ সেকেন্ডের জন্য হলেও একটা প্রমো যাবে যে- ধন্যবাদান্তে কল-রেডী। আর আমাদের সম্পর্কে একটা কিছু লেখা হবে; সেটা মুভির শেষে হোক বা শুরুতে। ৫-১০ সেকেন্ডের ব্যাপার তাও দেয়নি। রিলিজ হবে সেটাও জানায়নি। সম্মাননা তো দূরের কথা আমাকে একটা টিকিট পর্যন্ত পাঠায় নাই সিনেমাটা দেখার জন্য।’
মাইক্রোফোনটি দেখার অনুরোধ করলে বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, ‘আপনি লিখতে পারবেন না। ভাই হিসেবে বলতে পারি- এটা অকশনের জন্য বিদেশ গিয়েছে। বোম্বের একটা কোম্পানি এটাকে নিলামে তুলবে। এখনো জার্মান যায়নি, বোম্বে আছে।’ (কথোপকথনের এক পর্যায়ে এই তথ্য প্রকাশের অনুমতি চাইলে বিশ্বনাথ ঘোষ অনুমতি দেন)
এ প্রসঙ্গে গবেষক, প্রাবন্ধিক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘তারা যদি মনে করে সেখানে অনেক টাকা পাবে তবে দিয়ে দেবে। আর যদি মনে করে তাদের সম্মান বৃদ্ধি পাবে, দেশের জিনিস দেশে রাখবে, তাহলে গণহত্যা জাদুঘরে দিতে পারে। তারা দিতে চাইলে আমরা সমাদরে রাখবো। তাদের নাম থাকবে। আর তারা যদি মনে করে, টাকা ছাড়া সম্মান হবে না, তাহলে তারা বিক্রি করে দেবে।’
কল-রেডী নামের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, মাইক যারা ভাড়া করবেন তারা কল করলে যাতে প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত (রেডি) থাকে এই ভাবনা থেকেই নামটি রাখা হয়। অর্থাৎ কল করলে মাইক পৌঁছে যাবে দ্রুত। উল্লেখ্য, হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ নামে দুই ভাই ১৯৪৮ সালে পুরনো ঢাকায় ‘আরজু লাইট হাউস’ নামে একটি দোকান চালু করেন। শুরুতে আলোকসজ্জার কাজ করলেও পরে ব্যবসায় তারা সাউন্ড সিস্টেম যুক্ত করেন।
জানা যায়, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির বাসভবনে হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষকে ডেকে নেন। তিনি রেসকোর্স ময়দানে মাইক লাগানোর নির্দেশ দেন। এরপর একশোর অধিক মাইক লাগানো হয় জনসমাবেশ স্থলে। সমাবেশের তিনদিন পূর্ব থেকেই রাতের আঁধারে মাইকগুলো প্রস্তুত রাখার কাজ শুরু করে কল-রেডী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু মাইক মজুদ রাখা হয়। সে সময় পাকিস্তানি শাসকের ভয় উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করেছিল।
সূত্র: রাইজিং বিডি
Leave a Reply