বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৬ অপরাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার নিয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। সংক্রমণ যাতে না ছড়াতে পারে সে জন্য দুই আসনে এক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলাচলের নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। এর ফলে রাজধানীতে যাতায়াতকারী নাগরিকরা পড়েছে নতুন ভোগান্তিতে। অফিস-আদালত এখনো সীমিত পরিসরে না যাওয়ায় চাকরিজীবীরা পড়েছেন সবচেয়ে বেশি বিপদে। প্রতিটি পথেই বাসের চেয়ে যাত্রী বেশি। ফলে সকালেই চলে বাসে ওঠার অসম প্রতিযোগিতা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও বাসে উঠতে না পেরে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর খিলক্ষেতে ক্ষুব্ধ যাত্রীরা সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
এদিকে ধারণক্ষমতার অর্ধেক নিয়ে চলার শর্তে লঞ্চের ভাড়াও ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তবে লঞ্চের কেবিনের ভাড়া অপরিবর্তিত থাকবে।
এদিকে গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই লক্ষ করা যাচ্ছে না। বাসে জীবাণুনাশক দেওয়া হলেও দূরপাল্লার পরিবহন ছেড়ে যাওয়ার টার্মিনালগুলো জীবাণুনাশক করার উদ্যোগ নেই। সরকার ৬০ শতাংশ বাসভাড়া বাড়ানোর নির্দেশনা দিলেও অনেক ক্ষেত্রে দ্বিগুণ ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ মিলছে। রেলের টিকিট নেওয়ার সময় স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাইছে না যাত্রীরা।
রাজধানীতে অফিসগামী যাত্রীদের ক্ষোভ : ‘সব কর্ম খোলা, স্বাস্থ্যবিধি শুধু বাসে, এর চেয়ে লকডাউন দেওয়া উচিত’—এ কথা বলে গতকাল সকালে বাসে উঠতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আবু শামা। রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে বাসে ওঠার চেষ্টা করছিলেন তিনি। বেশির ভাগ বাসের গেট বন্ধ, দু-একটি বাসের দরজা খোলা পেলেও হুড়াহুড়িতে অন্যদের সঙ্গে তিনি পেরে ওঠেননি। গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে যাতায়াতের এমন অবর্ণনীয় দুর্ভোগের চিত্র দেখা যায়। ভোগান্তির পাশাপাশি গতকালও বাসভাড়া বেশি নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ পাওয়া গেছে বাস পরিচালনাকারী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে।
মিরপুর চিড়িয়াখানা সড়ক থেকে জয়কালীমন্দিরগামী শেখর পরিবহনের যাত্রী শফিকুল ইসলাম জানান, বাসে উঠলে তাঁকে বলা হয়েছে, যেখানেই নামেন ৪০ টাকা।
রাজধানীর কাজলার বাসিন্দা শিমুল খান জানান, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে তিনি বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। দেড় ঘণ্টায় কোনো বাস না পেয়ে তিনি কাজলা থেকে হেঁটে পল্টনে এসেছেন। আজিমপুর এলাকায় গিয়েও দেখা যায়, প্রায় সারা দিনই বাসের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে যাত্রীদের। আজিমপুর থেকে রাইড শেয়ারে প্রতিদিন চট্টগ্রাম সড়কের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার একটি কারখানায় ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন আবুল হোসেন। তিনি জানান, হঠাৎ রাইড শেয়ার বন্ধ ঘোষণায় তিনি বিপাকে পড়েছেন, সকালে আজিমপুর থেকে ৪০০ টাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে অফিসে গেছেন। রাইড শেয়ার বন্ধ ঘোষণার পরই বেড়ে গেছে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়াও।
রাজধানী শহর ছেড়ে বাইরে যাওয়ার দূরপাল্লার পরিবহনেও ভোগান্তির চিত্র দেখা গেছে। টিকিটের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বাড়তি ভাড়ার সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে বাড়তি সময়ও। দূরপাল্লার পরিবহনের বাসগুলোতে জীবাণুনাশক ছিটানো হলেও বাস টার্মিনালগুলোতে যাত্রীদের বসার আসন ও টার্মিনাল এলাকায় গত দুই দিনে কোনো জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হয়নি।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতউল্লাহ বলেন, ‘আমরা পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাসে যাত্রী আনা-নেওয়া করছি।’ রাজধানীতে চলাচলকারী প্রজাপতি পরিবহনের ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা দুই আসনে এক যাত্রী বহন করছি, এখন বাসের চেয়ে যাত্রীর সংখ্যা বেশি হলে আমরা কী করতে পারি।’
ট্রেনে যাতায়াতে কড়াকড়ি : স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে রেলওয়ে নানামুখী প্রস্তুতি নিয়েছে। শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে টিকিট কাউন্টারের সামনে বর্গাকার সীমানা রেখা দেওয়া হয়েছে। মাস্ক ছাড়া কাউকে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। হাত ধোয়ার জন্য নতুন করে বেসিন বসানো হয়েছে। সব ট্রেনে আসনের অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের ঘোষণা আগেই দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। তবে যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে অনীহা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সবাই গাদাগাদি করেই কাউন্টারে টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে। পায়ের নিচে সীমানা রেখা কোথায় তা কারোই জানা নেই। প্ল্যাটফর্মে ঢোকা বেশির ভাগ যাত্রীর মুখে নেই মাস্ক। আন্ত নগর ছাড়া অন্য ট্রেনের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ।
অর্ধেক আসনে যাত্রী পরিবহন শুরুর পর থেকে বাসের ভাড়া বেড়েছে ৬০ শতাংশ, কিন্তু ট্রেনের ভাড়া না বাড়ায় নারায়ণগঞ্জ, গেণ্ডারিয়ার মতো এলাকার যাত্রীদের চাপ বেড়েছে ট্রেনে। কমলাপুর স্টেশন মাস্টার নৃপেন্দ্র সাহা বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত টহল দিচ্ছি। সবাই যেন স্বাস্থ্যবিধি মানে, সেদিকে খেয়াল রাখার চেষ্টা করছি।’
লঞ্চের ভাড়াও বাড়ল : বাস, ট্রেনসহ বিভিন্ন গণপরিবহনে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে এবার ধারণক্ষমতার অর্ধেক নিয়ে চলার শর্তে লঞ্চের ভাড়াও ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রে কেবিনের ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে না। এই বাড়তি ভাড়া শুধু ডেকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী লঞ্চের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা জানান। এর আগে গত বুধবার লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে আলোচনার পর ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাবের চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ)।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ-চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার সচিব সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ভাড়া বাড়িয়ে লঞ্চ চালানো শুরু করেছি। এখনো যাত্রী অসন্তোষের কোনো তথ্য আমরা পাইনি। যেভাবে নিদের্শনা আছে সেভাবেই যাত্রী ওঠানো হবে।’
গণপরিবহন না পেয়ে ক্ষুব্ধ যাত্রীদের সড়ক অবরোধ : ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও বাসে উঠতে না পেরে ক্ষুব্ধ যাত্রীরা সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর খিলক্ষেতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা। এতে পুরো বিমানবন্দর সড়কে যানবাহনের দীর্ঘ জটের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে অবরোধকারীরা সরে গেলেও সড়কে যানবাহনের চাপ দেখা দেয়।
খিলক্ষেত থানার ওসি মুন্সী ছাব্বীর আহম্মদ জানান, করোনা পরিস্থিতির কারণে বাসগুলো অর্ধেক যাত্রীর বেশি তুলছে না। এর ফলে অফিসগামী যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও বাসে উঠতে পারছিলেন না। এতে তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে খিলক্ষেত ওভারব্রিজের নিচে রাস্তা বন্ধ করে অবস্থান নেন।
রাজধানীর তিন স্থানে মোটরসাইকেলচালকদের অবরোধ : অন্যদিকে এ বিক্ষোভের রেশ না কাটতেই রাইড শেয়ারিং সেবা বন্ধের প্রতিবাদে রাজধানীর ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর, কারওয়ান বাজার, শাহবাগসহ কয়েকটি এলাকায় সড়ক আটকে বিক্ষোভ করেন মোটরসাইকেলের চালকরা। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে কারওয়ান বাজারে এ বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে প্রধান সড়ক বন্ধ করে অবস্থান নেন অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেলচালক। এ সময় ২৭ নম্বর প্রধান সড়কে মোটরসাইকেল আড়াআড়ি করে রেখে সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে সড়কের দুই পাশেই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ তাঁদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলে ফের যান চলাচল শুরু হয়
স্বাস্থ্যবিধি না মানায় জরিমানা : বগুড়া থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সরকারি নির্দেশ না মেনে গতকাল কোচিং সেন্টার চালু রাখার অপরাধে জলেশ্বরীতলা সানলিড আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কোচিংয়ের চার শিক্ষককে ১৫ হাজার টাকা করে মোট ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। জরিমানার পাশাপাশি কোচিং সেন্টারটিকে সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। এ সময় বন্ধ করে দেওয়া হয় সব ফটোকপির দোকান।
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, চুয়াডাঙ্গায় গণপরিবহনে মাস্ক ছাড়াই যাতায়াত করছে যাত্রীরা। হাট-বাজারগুলোতেও কাউকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যাচ্ছে না। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান গতকাল সদর উপজেলার ডিঙ্গেদহ বাজারে মাস্ক না পরার অপরাধে ১৪ জনকে তিন হাজার ৭৫০ টাকা জরিমানা করেন।
নাটোর প্রতিনিধি জানান, নাটোরে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে জেল-জরিমানার হুঁশিয়ারি দিয়েছে প্রশাসন। গতকাল তিনটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মাস্ক ব্যবহার না করায় চার হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা করা হয়।
শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকালে শ্যামনগরে মাস্ক ব্যবহার না করায় ১০ জনকে ছয় হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
বোয়ালমারী-আলফাডাঙ্গা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি জানান, জনসমাগম এড়াতে কালীনগর গ্রামের ফকির রুস্তম আলী শাহ্ চিশতীর ৫৪তম ওরস মোবারকের মেলাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া মাস্ক না পরায় চারজনকে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
কোটালীপাড়া (গোপালগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কোটালীপাড়ায় মাস্ক না পরার কারণে চারজন গুনেছে জরিমানা।
নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, নীলফামারী শহরে ইসলামিয়া একাডেমি নামের একটি কোচিং সেন্টারকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি না মেনে শহরে মাস্কবিহীন চলাফেরা করায় ৪৬ জনকে ৯ হাজার ৫০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
Leave a Reply