সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ পূর্বাহ্ন
বরগুনা প্রতিনিধি॥ বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালী গ্রামের বাসিন্দা বাদল মিয়া। পেশায় একজন কৃষক। কৃষি কাজ করেই পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকছিলেন তিনি। ৫৭ বছরের জীবনে কখনো তিনি ঢাকায় যাননি। কিন্তু সেই ঢাকারই এক শিশু ধর্ষণ মামলায় পরোয়ানা বলে তাকে গ্রেফতার করে বরগুনা থানা পুলিশ।
অথচ যে পরোয়ানায় বাদলকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেই পরোয়ানাই ছিল ভুয়া। গ্রেফতারের আগে কোনোরকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই ভুয়া পরোয়ানায় গ্রেফতারের ফলে ৩৫ দিনের কারাগারে থেকেছেন বাদল।
মঙ্গলবার রাতে বরগুনা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বাদল মিয়া। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ছেলে-স্বজন ও স্থানীয়রা।
বাদল মিয়া বলেন, স্থানীয় দালাল সাইফুল ও ইলিয়াস ষড়যন্ত্র করে আমাকে ফাঁসিয়েছেন। প্রথমে আমাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এরপর ২৫ হাজার টাকা দিয়ে স্বজনরা আমাকে ছাড়িয়ে আনেন। আমার ক্ষতি করতেই পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশ করে ভুয়া পরোয়ানায় গ্রেফতার করান সাইফুল ও ইলিয়াস।
তিনি বলেন, আমি জীবনে কখনো ঢাকা যাইনি। অথচ সেই ঢাকারই একটি শিশু ধর্ষণ মামলায় আমাকে ৩৫ দিন জেল খাটতে হয়েছে। যারা আমার সঙ্গে এমন করেছেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। আর কোনো নিরপরাধী মানুষ এভাবে ভুয়া পরোয়ানায় যেন জেল না খাটে সেই জন্য পুলিশ প্রশাসনকে আরো তৎপর হতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর বরগুনা সদর থানা পুলিশের এএসআই সাইফুল ইসলাম ঢাকার শিশু আদালতের ৯(১) ধারা শিশু ধর্ষণ মামলায় একটি পরোয়ানায় বাদল মিয়াকে গ্রেফতার করেন। স্থানীয় পুলিশের সোর্স ইলিয়াস ও সাইফুলের মাধ্যমে ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেন বাদলের স্বজনরা। এর অল্প কিছুদিন পর ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর পুনরায় একই মামলার পরোয়ানায় বাদল মিয়াকে ফের গ্রেফতার করেন সদর থানার এএসআই নাঈমুর। তবে এবার তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
এরপর বাবাকে মুক্ত করার জন্য ঢাকা গিয়ে বিভিন্ন আদালতে মামলা সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া শুরু করেন বাদল মিয়ার ছেলে রাকিবুল ইসলাম রাকিব। খোঁজ খবর নিয়ে তিনি জানতে পারেন, ঢাকা জজ কোর্টে শিশু আদালত বলতে কোনো আদালত নেই। সেখানে নয়টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এর কোনো আদালতেই ওই মামলার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পরে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয় বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতের বিচারকের কাছে। বিচারক বিষয়টি আমলে নিয়ে বাদল মিয়াকে মুক্তি দেন।
পরোয়ানাটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পরোয়ানা মামলা নম্বর হিসেবে লেখা হয়েছে জি.আর ৪২৫/১৭ ও শিশু-৮৯০/১৮। এছাড়া অপরাধ হিসেবে লেখা হয়েছে শুধু ৯(১) ধারা। পাশাপাশি মামলা নম্বরে ২০১৭ সাল উল্লেখ থাকলেও বিচারকের স্বাক্ষরের স্থলে তারিখ দেয়া হয়েছে ০৪/০৪/১৪। মামলা ২০১৭ সালের হলেও ওয়ারেন্টে ২০১৪ সালের বিচারকের স্বাক্ষর বিশ্বাসযোগ্য নয়। এছাড়া পরোয়ানায় আদালতের সিল থাকার কথা থাকলেও রয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিল। এসব বিষয় বিবেচনায় দাখিল করা পরোয়ানাটি ভুয়া বলে ধারণা করা হয়।
ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী মনোয়ার হোসেন জুয়েল বলেন, পরোয়ানায় যে মামলার নম্বর উল্লেখ রয়েছে আমরা সেই নম্বর অনুযায়ী ঢাকার ৯টি নারী ও শিশু আদালতে তল্লাশি চালিয়েছি। কিন্তু এমন কোনো মামলার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। মামলায় যে বিচারকের স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে সেই স্বাক্ষরটিও জাল।
বাদল মিয়ার ছেলে রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, আমার বাবাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ভুয়া পরোয়ানায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। পুলিশ ও স্থানীয় দালাল যৌথভাবে আমার বাবাকে হেয় ও আমাদের ছোট করার জন্যই এ কাজ করেছিল।
এ বিষয়ে প্রথমে গ্রেফতার করা এএসআই সাইফুল ইসলামের মুঠোফোনে কল দিলে বন্ধ পাওয়া যায়। এছাড়া পুলিশের সোর্স সাইফুল ও ইলিয়াসকে কল করেও পাওয়া যায়নি।
বরগুনা থানার এএসআই নাঈমুর রহমান বলেন, ২০১৮ সালে বাদল মিয়ার গ্রেফতারি পরোয়ানা বরগুনা সদর থানায় এসেছে। তখন আমি পিরোজপুরে কর্মরত ছিলাম। আমি বরগুনা থানায় যোগদান করেছি গত বছরের ৬ নভেম্বর।
তিনি আরো বলেন, বাদল মিয়া গ্রামের একজন মানুষ। তিনি বা তার পরিবারের কারো সঙ্গেই আমার কোনোরকম পরিচয় কিংবা যোগাযোগ ছিল না। শুধু গ্রেফতারের জন্যই তাকে খুঁজেছি। এখানে আমার কোনো দোষ নেই। তিনি শুধু শুধুই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছেন।
বরগুনা সদর থানার ওসি কেএম তারিকুল ইসলাম বলেন, অন্য সব গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত আসামির মতোই বাদল মিয়াকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে পুলিশ। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। এখানে পুলিশের কোনো দোষ নেই। কেননা সব ক্ষেত্রে গ্রেফতারি পরোয়ানার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয় না।
Leave a Reply