শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০১ পূর্বাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক:
কেস স্টাডি-১
বরিশাল শহরের বাসিন্দা মিলি আক্তারের ২২ বছর বয়সী ছেলেকে এক সন্ধ্যায় বাড়ির কাছে একটি চা দোকান থেকে ধরে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ। ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে – এমন খবর শোনার পর নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেননি তিনি। দ্রুত ছুটে যান নিকটস্থ থানায়। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। একপর্যায়ে মিলি আক্তারের স্বামীর কাছে একটি ফোন আসে।
যেসব পুলিশ সদস্য তার ছেলেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়, তাদের একজন ফোন করে মিলি আক্তারের স্বামীকে দেখা করেতে বলে। মিলি আক্তার পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন, ছেলের মুক্তি বাবদ ৩৫ হাজার টাকা দাবি করে পুলিশ বলে, টাকা না দিলে মাদকের মামলা দেয়া হবে।
‘আমি তো সেদিন পুলিশের হাতে জিম্মি ছিলাম। আমার ছেলেটাকে যতক্ষণ না ছাড়ছে ততক্ষণ আমার চিন্তা ছিল’
অনেক অনুনয় করে শেষ পর্যন্ত পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনা হয়। দু:সহ সে অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে মিলি আক্তার বলেন, ৩৫ হাজার টাকা দেবার সামর্থ্য আমার নাই। সমস্ত টাকাটাই আমার হাজব্যান্ড ধার করে দিয়েছে। পরেরদিন আমার মেয়ের স্কুলে বেতনের টাকা দেয়ার কথা ছিল।
কেস স্টাডি-২
খাগড়াছড়ি জেলার মাটি-রাঙার বাসিন্দা নিতুস ত্রিপুরা। পেশায় তিনি একজন নাপিত। তার ভাই একজন বাস চালক। কয়েকমাস আগে নিতুস ত্রিপুরার ভাইকে খাগড়াছড়ি শহরের বাস টার্মিনালের পাশ থেকে ধরে নিয়ে পুলিশ। সেখানে একই সাথে আরো অনেককে আটক করা হয়েছিল।
এরপর পুলিশের তরফ থেকে নিতুস ত্রিপুরার পরিবারে সাথে যোগাযোগ করা হয় এবং তার মুক্তির বিনিময়ে দশ হাজার টাকা দাবি করা হয়। নিজেদের আর্থিক অসঙ্গতির কথা পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করে নিতুস ত্রিপুরার পরিবার। কিন্তু পুলিশ নাছোড়বান্দা। টাকা ছাড়া মুক্তি দেবে না বলে তারা সাফ জানিয়ে দেয়। পুলিশের কাছে রাতটুকু সময় চেয়েছিল আটককৃত ব্যক্তির পরিবার।
কিন্তু পুলিশ জানিয়ে দিয়েছে যে রাতের মধ্যে টাকা না দিলে সকালে মামলায় আদালতে চালান দেয়া হবে। শেষ পর্যন্ত পুলিশের সাথে চার হাজার টাকায় রফা করে ভাইকে মুক্তির ব্যবস্থা করে নিতুস ত্রিপুরা।
পুলিশ জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে?
মিলি আক্তার এবং নিতুস ত্রিপুরার মতো এ ধরণের অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। তবে ইদানীংকালে অনেকে ভয়ে পুলিশি দুর্নীতির শিকার হলেও নিজের নাম প্রকাশ করে সেসব অভিজ্ঞতা বলতে চান না।
দুর্নীতি বিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ তাদের এক গবেষণায় বলেছে, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। যেসব পরিবারের উপর এ জরিপ চালানো হয়েছে, তাদের মধ্যে ৭২.৫ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পর্কে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে।
দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পাসপোর্ট অফিস এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বিআরটিএ। টিআইবি বলছে দেশের ১৫ হাজার পরিবারের উপর তারা এ গবেষণা চালানো হয়েছে।
২০১৭ সালে তারা বিভিন্ন খাতে সেবা গ্রহণের সময় যেসব দুর্নীতির শিকার হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল গবেষণায়।
টিআইবির চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলছেন, বহুদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। তাদের জবাবদিহিতা নিম্নপর্যায়ে চলে গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সুলতানা কামাল বলেন, যতই আমাদের দেশে গণতন্ত্রের একটা ধ্স চলছে, যত আমাদের জনগণের ভূমিকা গণতন্ত্রে কমে আসছে, ততবেশি এদের আধিপত্য বাড়ছে। যে কারণে এরাই চিহ্নিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি-গ্রস্ত খাত হিসেবে।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারা গবেষণার জন্য ১৫টি সেবা খাত চিহ্নিত করেছিল এবং এসব খাতে ২০১৭ সালে ঘুষ লেনদেনকৃত প্রাক্কলিত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
তবে দুর্নীতির তালিকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষে উঠে আসার বিষয়টি নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা তাৎক্ষনিক কোন মন্তব্য করেনি।
সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টিআইবি’র রিপোর্ট পর্যালোচনা করে বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে একটি আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়া হবে। বিবিসি বাংলা
Leave a Reply