মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৪ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক॥ অপহরণ ও হত্যা মামলায় আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদাণ ও মামলার চার্জশিট দাখিলের পর যাকে অপহরণ ও হত্যা করা হয়েছে তাকেই আটক করেছে পুলিশ। এ যেন আরেক ‘জজ মিয়া নাটক’।২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সাথে জড়িত না থাকার পরও নিরাপরাধ জজ মিয়াকে দিয়ে স্বীকারোক্তির নাটক সাজিয়ে মামলাটি ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পরবর্তি সময়ে সারাদেশের মানুষের কাছে ‘জজ মিয়া নাটক’ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। যা আজও প্রাসঙ্গিক নানা ঘটনার উদাহরণ হয়ে রয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর হাজারীবাগ থানায় প্রায় একই ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটেছে। একটি অপহরণ ও হত্যা মামলার তদন্তকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে জানা গেছে অপহরণ ও হত্যার কোন ঘটনাই ঘটেনি। অথচ আসামিদের জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে ডিবি পুলিশ।
মামলার আসামিদের অভিযোগ, তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়।
মিথ্যা অভিযোগের ওই মামলায় কেউ ৬ মাস, কেউ ২ বছর, কেউ ৩ বছরও কারাভোগ করে বর্তমানে জামিনে আছেন। মামলাটি বর্তমানে রায়ের পূর্বের ধাপ যুক্তিতর্কের পর্যায়ে আছে। আর এমন সময়ই যাকে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে তাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। পাওয়া যায় মিথ্যা অপহরণ ও হত্যার আরেকটি নাটকের গল্প।
জানা যায়, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে রাজধানীর হাজারীবাগ থানাধীন বটতলা মাজার রোডে বসবাস শুরু করেন মো. আজম। ২০১৪ সালে তার ছেলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আবু সাঈদ(১০) হারিয়ে যায়। এ বিষয়ে ওই বছরের ১৭ এপ্রিল হাজারীবাগ থানায় তিনি একটি জিডি করেন। ওই জিডির পর তিনি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবির মামলা করেন।
মামলাটিতে বিভিন্ন সময় আসগর আলী, মিলন, মো. সাইফুল ইসলাম হাওলাদার, সোনিয়া আক্তার, তার ভাই আফজাল হোসেন ও মো. শাহীনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর সাইফুল ও আফজাল ঢাকা সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। স্বীকারোক্তিতে তারা বলেন, ভিকটিম আবু সাঈদকে তারা অপহরণ করে হত্যার পর লাশ বরিশালগামী লঞ্চ থেকে নদীতে ফেলে দেন।
ঢাকা সিএমএম আদালতের তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মাদ ইউনুস খান ও শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান স্বীকারোক্তি রেকর্ড করেন।
ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ডিবির ধানমন্ডি জোনাল টিমের এসআই মো. রুহুল আমিন। বর্তমানে রাজধানীর ডেমরা থানায় কর্মরত রয়েছেন রুহুল আমিন। মামলাটি তদন্তের পর ২০১৫ সালের ১৫ জুন তিনি আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। আসগর আলী ও মিলনকে বাদ দিয়ে অপর ৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। মামলার চার্জশিট হওয়ার পর ঢাকার ৫ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে (মামলা নং-১০৮৪/২০১৮) বিচারাধীন আছে।
বরিশাল জেলার হিজলা থানার পশ্চিম তেড়ালিয়া গ্রামের মো. শাহজাহান আলী মোল্লার মেয়ে সোনিয়া আক্তার (২৫) এ মামলায় ৬ মাস কারাভোগ করেছেন। তিনি জানান, আবু সাঈদকে তারা চেনেন না। তবুও ওই মামলায় তাকে ও তার ভাই আফজাল, তার পিতা এবং প্রতিবেশীকে গ্রামের বাড়ী থেকে ধরে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. রুহুল আমিন। আদালতে ওঠানোর আগে প্রায় ৮ দিন তাদের ডিবি কার্যালয়ে আটক রেখে বাবার সামনে মিথ্যা স্বীকারোক্তির জন্য নির্যাতন করা হয়। তাদের মতো করে স্বীকারোক্তি না করলে বাবাকেও ওই মামলায় জড়ানোর ভয় দেখানো হয়। নির্যাতনে বাধ্য হয়ে তার ভাই ও সাইফুল আদালতে তাদের শিখানো মতে স্বীকারোক্তি প্রদান করেন।
সোনিয়া আক্তার বলেন, আমার স্বীকারোক্তি না থাকায় ৬ মাস পর আমি জামিন পেয়ে যাই। পরে ২০১৫ সালে লোক মুখে শুনতে পাই আবু সাঈদ বেঁচে আছে। তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু হদিস করতে পারছিলাম না। তাই বাধ্য হয়ে বাদীর সঙ্গে আপোষ করতে চেষ্টা করি। মামলায় তাদের খালাস করানোর জন্য আসামিরা মিলে বাদীকে ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন। বিহঙ্গ পরবহনের এমডি নাসির উদ্দিনের মাধ্যমে আরও দুই লাখ টাকা দেয়ার কথা বলে পল্লবী থানাধীন একটি বাসায় আবু সাঈদকে নিয়ে আসতে বলা হয়। টাকার লোভে গত ২৯ আগস্ট রাতে আবু সাঈদসহ তার বাবা মো. আজম, মা মাহিনুর বেগম ও ফুফা আব্দুল জব্বার আসেন। এরপর তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে প্রতারণার সময় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
মিথ্যা অভিযোগের মামলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ২০১৪ সালে জনৈক মিরাজ হোসেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর জানতে পারেন মিরাজ আগেই বিবাহিত। এ নিয়ে বিরোধে জেরে বিয়ে ভেঙ্গে দিলে সে ক্ষুব্ধ হয়ে এ মামলার নাটক সাজায়। প্রতারণার মামলায় মিরাজকেও আসামি।
ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে আরেক ভুক্তভোগী সাইফুল বলেন, তারা ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। আদালতে ওঠানোর আগে প্রায় ৮ দিন তাদের আটক রেখে সোনিয়া ও আফজালের সঙ্গে একইভাবে নির্যাতন করা হয়। স্বীকারোক্তি করানোর জন্য মেঝেতে ফেলে তাকে পাড়ানো হয়। পরে জানের ভয়ে শিখানো মতো আদালতে দোষ স্বীকার করি। পরে দুই বছর কারাভোগের পর জামিন পাই।
এদিকে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. রুহুল আমিন। এ সম্পর্কে তিনি মুঠোফোনে বলেন, জোর করে বা নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়নি। আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা দোষ স্বীকার করেন এবং আদালতেও একইভাবে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
এ মামলায় সোনিয়া ও আফজালদের পক্ষের আইনজীবী ওয়াহিদুজ্জামান লিটন বলেন, যেহেতু ভিকটিম উদ্ধার হয়ে বর্তমানে প্রতারণার মামলায় রিমান্ডে রয়েছেন। তাই রোববার তারা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে একটি আবেদন দিয়ে বলেছেন আগামী ৫ সেপ্টেম্বর ধার্য তারিখে ভিকটিমকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে। ভিকটিমকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে মিথ্যা মামলা থেকে তার আসামিরা অব্যাহতি পাবেন। এছাড়া তারা মিথ্যা মামলার ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালকে ব্যবস্থা নিতে বলবেন।
এদিকে আবু সাঈদ ফিরে আসার পর অপহরণ ও খুনের নাটক সাজানোর সঙ্গে জড়িত সাত জনের বিরুদ্ধে শুক্রবার সোনিয়া আক্তার বাদী হয়ে মিথ্যা মামলা, প্রতারণা ও অর্থ আত্মাসাতের অভিযোগে রাজধানীর হাজারীবাগ থানায় একটি মামলা করেন। তবে এ মামলায় তদন্ত সংস্থা ডিবি পুলিশের কাউকেই আসামি করা হয়নি। এ মামলায় চার জন গ্রেপ্তার হলেও মূলহোতা সোনিয়া আক্তারের সাবেক স্বামী মিরাজসহ এখনও তিনজন পলাতক রয়েছেন।
Leave a Reply