সূত্র জানায়, আ.লীগ সরকার পতনের পর গত ৩০ আগস্ট রাতে বরিশাল মহানগর বিএনপি সদস্য সচিবের নেতৃত্বে ‘জিয়ার সৈনিক এক হয়ে লড়াই কর’ প্রকাশ্যে এ স্লোগান দিয়ে নগরীর রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডে চালক- শ্রমিকসহ বিএনপি দলের সমর্থকদের এলোপাতাড়ি পিটিয়ে কুপিয়ে রক্ত নিয়ে হলি খেলায় মেতে উঠে। হামলায় আহত ১২ জনের মধ্যে ৭ জন বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়েছে। এরপর রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বরিশাল জেলা পরিষদের মার্কেট অবৈধভাবে দখল নিয়ে নগরীর ২৪ নং ওয়ার্ডে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এর ছবি দিয়ে ব্যানার টানিয়ে ‘বিএনপি পার্টি অফিস’ সাজিয়ে চাঁদা উত্তোলন শুরু করে। জিয়ার নেতৃত্বে ২৪ নং ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান মিজান ও ২৪ নং ওয়ার্ড যুবদলের আহ্বায়ক সাইদুর রহমান চুন্নু। বিষয়টি সম্পর্কে নগরীর ২৪ নং ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক নওশাদ আহমেদ নান্টু কিছুই জানেন না। তিনি বলেন, ওয়ার্ডে নতুন করে ‘বিএনপি পার্টি অফিস’ হলে অবশ্যই মহানগর বিএনপি নেতৃবৃন্দ জানবেন। খোঁজ নিয়ে শুনেছি মহানগর থেকে কোনো অনুমতি দেয়নি।
বরিশাল বহুমুখী সিটি মার্কেট (কাঁচা বাজার) এর ১৭ ও ১৮ নং স্টলের ভাড়াটিয়া আবু মিয়া বলেন, স্টল দুইটির মালিক হলেন তারেক বিন ইসলাম। তার কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করে আসছি। কিন্তু ৫ আগস্টের পর বরিশাল মহানগর বিএনপি সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার দখলে নিয়ে গেছে। বরিশাল সিটি করপোরেশনে গেলে কর্তারা বলেন- মেয়র বসার পর সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য ধরেন। এদিকে, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের একটি আবাসিক হোটেল, চারটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার দখলে নেয় জিয়া সমর্থিত ওয়ার্ড বিএনপির কয়েক নেতাকর্মী।
একাধিক নেতাকর্মী বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দলের সকল নেতা কর্মীদের প্রতি যখন দেশের মানুষের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েন সেই মুহূর্তে জিয়া ওই সব সহ নানা প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম চলমান রেখেছিলেন। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয়া কিছু শিক্ষার্থীকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড দখলে নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাড়া অর্ধেক করার ঘোষণা দেন।
নগরীর ২৪ নং ওয়ার্ড ধান গবেষণা সড়কের বাসিন্দা মো. মিলন হাওলাদার (৪২) বলেন, তারা বাবা রহম আলী হাওলাদার মৃত্যুর পর তাদের ১৫০.৭৫ শতাংশ সম্পত্তি জাল কাগজপত্র তৈরি করে অবৈধভাবে জোর পূর্বক ক্ষমতার জোড়ে ভোগ দখল করে আসছেন মো. রাইভিউল কবির স্বপন। এই স্বপন হলেন- বরিশাল মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মো. জিয়াউদ্দিন সিকদার জিয়ার আপন চাচা শ্বশুর। তাদের ফ্যামিলি দেশের বৃহত্তম দুই রাজনৈতিক দলের সাথে বিভক্ত। আ.লীগ শাসনামলে জিয়াউদ্দিন সিকদার তার আপন চাচা শ্বশুরদের ক্ষমতায় এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে। আর বিএনপি ক্ষমতায় আসলে জিয়া হয়ে উঠেন বরিশাল বিএনপির সেনাপতি। শ্বশুরদের সাথে জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকায় মো. জিয়াউদ্দিন সিকদার জিয়া বাদী হয়ে সম্প্রতি আমাকে বরিশালে শেখ হাসিনা সহ ৫৬০ জনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার মধ্যে আমাকে ৩৬৫ নং আসামি করেছে। অথচ জিয়া ভাইয়ের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক এবং বিষয়গুলো তিনি জানেন। তাছাড়া নানাভাবে একের পর এক মামলা মোকাবেলা করে আসছি। মামলা চালাতে চালাতে জীবন শেষ।
গত ৮-২-২০২১ইং তারিখে “বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতি-র মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ’র স্বাক্ষরিত” রুপাতলী বাসস্ট্যান্ড কমিটিতে দেখা যায়- সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মো. কাওছার হোসেন শিপন, সহ-সভাপতি মো. নাসির মৃধা ও এইচ.এম.এ. মান্নান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আল-আমিন হোসেন সহ ২১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি। নামধারী এই চারজনই হলেন- বরিশাল মহানগর বিএনপি সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদারের আপন চাচাতো শ্বশুর। আর আপন শ্বশুর ফিরোজ আহম্মেদ কে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার অভিযোগে ২০২৩ সালের ৩ জুন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রেজভী স্বাক্ষরিত দলীয় প্যাডে লিখিতভাবে ‘আজীবন বহিষ্কার’ এর ঘোষণা দিয়েছেন। তারপর থেকে বরিশালে আ.লীগ রাজনীতিতে চাঙ্গা হয়ে উঠেন ফিরোজ আহম্মেদ। এমনকি বিএনপি বিরোধী আ.লীগের আয়োজিত সকল প্রোগ্রামে অংশ নেন। এই বাসস্ট্যান্ড নিয়ে জিয়ার রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি। বাস মালিক সমিতির ১০১টি বাস থেকে দিনে ২০ থেকে ২২ হাজার চাঁদা উত্তোলিত হলেও ২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রূপাতলী অগ্রণী ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৬৩ টাকা। অনেক শ্রমিকই বলছে অর্থের লুটপাট করছে জিয়া। ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করছেন।
স্থানীয় কয়েকটি সূত্রটি নিশ্চিত করে বলেন- নগরীর ২৪ ও ২৫ নং ওয়ার্ডে বৃহত্তম দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে জামাই-শ্বশুরদের সিন্ডিকেটের রোষানলে এ দুই ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তাদের উদ্দেশ্য রাজনীতি নয় অর্থ আয় করার উৎস হিসেবে রাজনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা। হয়েছেন সকলে কোটি কোটি টাকার মালিক। আ.লীগ শাসনামলে বিএনপি নেতা জিয়া উদ্দিন সিকদারের সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন বরিশাল- ৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল জাহিদ ফারুক শামিমের কর্মী যুবলীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসী বাবলু। মামলা থেকে এবং শ্বশুরদের তদবির সুপারিশে ওই নেতাকে ফুলের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন জিয়া উদ্দিন সিকদার। যে ছবিটি ভাইরাল হয়। এছাড়া বরিশালে আ.লীগের দলীয় সকল কার্যক্রমে অংশ নেয়া জিয়ার শ্বশুরদের ছবিগুলোও নগরীর অধিকাংশ বিএনপি নেতাকর্মীদের মুঠোফোনে রয়েছে। আ.লীগের দেশজুড়ে আধিপত্য বিস্তারের সময় ২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট বরিশাল থেকে প্রকাশিত একটি জনপ্রিয় স্থানীয় পত্রিকায় মহানগর বিএনপি সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার ‘শোক বিজ্ঞাপন’ দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ছবির সাথে জিয়া তার ছবি দিয়ে ওই ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রচার করে নিজেকে বরিশালবাসীর কাছে বঙ্গবন্ধু সৈনিক বলে জানান দেয়। এ ঘটনায় সেই সময় জিয়া অনেককেই বলেছিলেন- বিএনপি আর আসবে বলে তার মনে হয় না। তার আত্মীয়-স্বজন সবই আ.লীগের রাজনীতি করে। তবে তিনি আ.লীগের বাহিরে নয় বলে জানান দিতেন।
সূত্রটি প্রমাণ উপস্থাপন করে বলেন- ২০১৯ সালের ৩ জুন বরিশাল মহানগর বিএনপি সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার কে ২০ লাখ টাকার চেক দিয়ে রুপাতলী মৌজার ৪৭ শতাংশ জমি বায়না দলিল করে অ্যাডভোকেট এ.কে.এম আরিফুর রহমান। বায়না চুক্তি করার পর আরিফুর রহমান ওই জমিতে ৭ লাখ টাকার বালু ভর্তি করেন। আ.লীগ শাসনামলে জিয়া উদ্দিন সিকদার প্রতারণা পূর্বক ওই টাকা নেয়ার পর ক্রেতা জানতে পারেন জমির মালিক বিক্রেতা নয়। পরে জিয়া সেই আমলেও ওই আইনজীবীকে দেখে নেয়ার হুমকি দেন। উপায়ন্ত না পেয়ে ২০২১ সালের ১০ মার্চ আইনজীবী আরিফুর রহমান বাদী হয়ে বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশাল অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্টেট আদালতের বিচারক মাসুম বিল্লাহ আসামি জিয়া ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। এ সময় জিয়া ও তার স্ত্রী বরিশাল থেকে পালিয়ে ঢাকা গিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতাকে বুঝিয়েছেন দল ক্ষমতায় না থাকায় বরিশালে পরিবার নিয়ে থাকতে পারছেন না তিনি।
রুপাতলী ‘এ ওয়াহেদ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ এর এডহক কমিটির প্রস্তাবনায় রয়েছে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নেতা মৃত. সালাম চেয়ারম্যান এর স্ত্রী রোকেয়া বেগম, মহানগর বিএনপি’র সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার ও স্থানীয় সমাজসেবক মো: মারুফ হোসাইন। জিয়াউদ্দিন সিকদার কে ২য় অবস্থানে রাখায় তার অর্ধশত অনুসারী বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ইউনুস আলী সিদ্দিকী কে আ. লীগের দোসর বলে হুমকি দিয়ে অসদাচরণ করেন। এমনকি মৃত. সালাম চেয়ারম্যান এর স্ত্রী রোকেয়া বেগমকে আ. লীগের দোসর বলে আখ্যায়িত করে। বাস্তবে ওই পরিবারের কেউই আ.লীগ করে না বলে জানান রোকেয়া বেগম। ঘটনাটি ভাইরাল হয়। জিয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটিতে আসতে চায়।
জিয়ার কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতৃবৃন্দদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে দলের তৃণমূল পর্যায়ের অনেকে। কারণ, জনগণকে দুর্ভোগে পড়তে হয় এমন কর্মসূচি বিশেষ করে কোনো প্রকার বিলবোর্ড টানানো এবং নেতাদের শোডাউন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত এক নির্দেশনা দলের তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু ২০২৫ সালের ১১ জানুয়ারি মোটরসাইকেল শোডাউন দিয়ে মোটরসাইকেল শোডাউন দিয়ে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়ক হয়ে নগরীর সদর রোড দলীয় কার্যালয়ের সামনে পর্যন্ত আসেন। যে ঘটনায় বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক ও সদস্যসচিব জিয়াউদ্দিন সিকদারকে শোকজ করেছে কেন্দ্র।
অথচ কেন্দ্রের ওই নির্দেশনা অমান্য করে মোটরসাইকেল শোডাউন দেয়ায় নাটোরের শিংড়া উপজেলার বিএনপি সদস্য সচিব দাউদার মাহমুদকে প্রাথমিকভাবে দলের সদস্য পদ সহ সব পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু বরিশালের বিষয়ে কেন্দ্রের তদারকি শুধু শোকজ করেই দায়সারা কাজ সম্পন্ন করেছেন বলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মনে নানা প্রশ্নে দানা বেঁধে উঠেছে।
বরিশাল মহানগর বিএনপি সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার বলেন, আ.লীগের দোসররা তার বিরুদ্ধে নানা কথা বলে। তার ভাষ্যমতে, সবকিছুতেই নির্দোষ তিনি। তবে সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করলে তিনি ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট দপ্তর/অফিস বিষয়টি দেখবেন বলে জানান।
বরিশাল মহানগর বিএনপি আহ্বায়ক মো. মনিরুজ্জামান খান বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে ভুক্তভোগী কেউ অভিযোগ করলে অভিযোগের বিষয়টি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির কেন্দীয় কমিটির কাছে প্রেরণ করবো। তারপর কেন্দ্র থেকেই ব্যবস্থা নিবে। একই মতামত ব্যক্ত করলেন মহানগর বিএনপি সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরীন।
Leave a Reply