সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৪ পূর্বাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট ॥ ঝালকাঠির রাজাপুর ও নলছিটি উপজেলা উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিষখালি নদীর জেলেরা প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ শিকারের নিষেধাজ্ঞা মানছেন না। স্বল্প সংখ্যক জনবল ও স্থানীয় ভাড়াটিয়া কম গতির ট্রলার দিয়ে ঢিমেতালে চলছে মৎস্য বিভাগ ও প্রশাসনের প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষাভিযান। গভীর রাতে ও দিনের বেলা নামমাত্র-লোকদেখানো অভিযান চালালেও প্রশাসনের অভিযান অনুসরন করে অসাদু জেলেরা দেদারছে ডিমওয়ালা মা ইলিশ শিকার করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের। সূত্রমতে, আশ্বিনের পূর্ণিমার আগের ৪ দিন ও পরের ১৮দিনসহ মোট ২২দিন বিষখালি নদীতে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ লক্ষে ৯ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ নিধনে সরকার নিষেধজ্ঞা জারি করে। আইনানুযায়ী ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাত, কেনাবেচা ও বিনিময় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষিত হচ্ছে বরিশালে। জেলার হিজলা ও মুলাদী উপজেলার আরিয়াল খাঁ নদীর আবুপুর, ছফিপুর, নোমরহাট, মৃধারহাট এর বিভিন্ন পয়েন্টে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইলিশ মাছ শিকার করছে কতিপয় অসাধু জেলেরা।বিভিন্ন খালের মধ্যে লুকিয়ে কৌশলে মা ইলিশ নিধন করছে বলে জানা গেছে। স্থানীয়সুত্রে জানা গেছে, শনিবার বিকাল থেকেই আরিয়াল খা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে সুকৌশলে ইলিশ মাছ শিকার করছে জেলেরা।
এ সকল মাছ মাত্র ৬০০ টাকা হালি দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর আগেও সেখানে মাছ ধরার অপরাধে কতিপয় জেলে আটক হলেও নিষেধাজ্ঞা মানছেন না সেখানকার জেলেরা। উপজেলা মৎস অধিদপ্তরের দায়ীত্বশীল কর্মকর্তা ও কোস্টগার্ডের সদস্যদের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও জেলেরা অবাধে মাছ শিকার করেছে বলে জানান একাধিক স্থানীয় গোপন সূত্র। এ ব্যাপারে হিজলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, আমরা মা ইলিশ রক্ষায় কাজ করছি। ঘটনাটি শুনেছি, জেলেরা নিষেধাজ্ঞা না মানলে কঠোরভাবে এ এসকল অপরাধীদের গ্রেফতার করা হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব আমিনুল ইসলাম জানান, আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। মা ইলিশ রক্ষায় অভিযান তৎপরতা আরো বৃদ্ধি করা হবে। এ ব্যাপারে মুলাদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃজাকির হোসেন জানান, মা ইলিশ রক্ষায় অভিযান অব্যাহত আছে। পুলিশের ঘাটতি থাকায় পুরো নদীতে অভিযানে ব্যাঘাত ঘটছে। এ ব্যাপারে জানতে উপজেলা মৎস কর্মকর্তা অনিল চন্দ্র দাস এর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি কলটি রিসিভ করেননি। এদিকে শনিবার সাড়ে ১০ টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সরেজমিনে বিষখালি নদী তীর ঘুরে জানা গেছে, শনিবার বেলা সাড়ে ১১ টা ও সোয়া ১২ টার দিকে গজালিয়া ও হদুয়া এলাকায় প্রায় ৩০টিরও বেশি নৌকায় কারেন্ট জাল দিয়ে মা ইলিশ শিকার করছে।
এসময় নিয়ামতির ফাড়ির নৌ একটি টহল ট্রলার গজালিয়া এলাকায় গিয়ে নোঙর করে চলে যেতে দেখলেও অন্যকোন অভিযানের ট্রলার চোখে পড়েনি। অভিযান শুরু থেকেই মৎস্য বিভাগ ও পুলিশ প্রশাসন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত এবং বিকেলে এবং রাতে অভিযান পরিচালিত হয়। কিন্তু অভিযান শুরু করে ট্রলার সেখান থেকে কিছুদূর চলে গেলেই জেলেরা নদীতে নৌকা নিয়ে নেমে কারেন্ট জাল ফেলে মাছ শিকার শুরু করে। সকালে ভোররাত থেকে সকাল ১০ পর্যন্ত অভিযান চলে না, এ সময় জেলেরা মাছ শিকার করে এবং দুপুরে বিকেলে ও রাতে অভিযানের ট্রলার পাহারা দিয়ে চলে ইলিশ শিকার। অভিযানের ট্রলারে দেখামাত্র পালিয়ে নদীর পাশের নালায় নৌকা ডুবিয়ে জেলেরা পালিয়ে যায়। পরে আবার প্রশাসনের লোকজন চলে গেলে পুনরায় মাছ শিকার শুরু করে। পালট গ্রামের জেলেদের অভিযোগ, পালট ও বড়ইয়া গ্রামের জেলেরা মাছ শিকার থেকে বিরত থাকলেও নলছিটির উপজেলার জেলেরা বিষখালির অপরপাড়ের বেরনবাড়িয়া, হদুয়া, নেয়ামতি, গজালিয়া চামটা গ্রামের জেলেরা প্রায় ৩০টিরও বেশি নৌকা দিয়ে কারেন্ট জাল ফেলে দেদারছে ইলিশ শিকার করে যাচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার এ ২২ দিন ইলিশ শিকারের জন্য ওইসব এলাকার মৌসুমি জেলেরা একাধিক কারেন্ট জাল ও নৌকা পূর্বেই মজুদ করে রেখেছে, যাতে প্রশাসনের হাতে জাল ও নৌকা ধরা পড়লেও পুনরায় আবার নদীতে মাছ শিকার করতে পারে। নলছিটি উপজেলা শহর থেকে সড়ক পথ বেহাল ও নদীপথের দূরত্ব বেশি হওয়ায় ওই উপজেলার প্রশাসন নদীর তীরে কোন অভিযান চালাচ্ছে না বলেও অভিযোগ পালট গ্রামের জেলেদের। সরকারি তালিকাভুক্ত জেলেরা নিষেধাজ্ঞা মানলেও মৌসুমি জেলেরা নদী থেকে ইলিশ ধরে গ্রামে গ্রামে গোপনে বিক্রি করে যাচ্ছে। ফলে তালিকাভুক্ত জেলে পরিবারগুলোর দিন কাটে খেয়ে না খেয়ে।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, অর্থের মাধ্যমে ম্যানেজ করে অভিযোগ পরিচালনায় যেসব কর্মচারিদের সাথে রাখা হয় তাদের অনেকেই মোবাইলের মাধ্যমে জেলেদের কাছে তথ্য জানিয়ে ম্যাসেজ, কল ও ফেসবুকে ছবি বা ম্যাসেজ দিয়ে গতিবিধি এবং অভিযান শুরু ও শেষের লোকেশন জানিয়ে দেয়। যাতে অভিযানকে ফাকি দিয়ে মাছ শিকার চালিয়ে যেতে পারে। জেলেরাও কৌশল ব্যবহার করে ওই ফাকে জাল ফেলে বিভিন্ন সংকেত ব্যবহার করে জালের স্থান চিহ্নিত করে রাখে এবং প্রশাসের লোকজন চলে গেলে দ্রুত জাল তুলে তীরে নিয়ে যায়। এসব পুরাতন কর্মচারিরা নতুনে যোগদান ও অপরিচিত এলাকা হওয়ায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্থান না চেনায় এসব কর্মচারিদের দেখানো ও চিনানো এলাকায়ই অভিযান পরিচালিত করায়। উপজেলার মানকি, সুন্দর, নাপিতেরহাট ও বাদুরতলা এলাকার জেলেদের কাছ থেকে উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মচারিকে প্রায় ৬০ জনের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা করে তুলে এজন্য দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অপরদিকে অবরোধকে লক্ষ করে জেলে পেশা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত জেলেরা বর্তমানে এলাকায় এসে অবস্থান নিয়েছে, সুযোগ পেলেই নদীতে নৌকা ও কারেন্ট জাল নিয়ে মাছ শিকার শুরু করে। উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, উপজেলা শহর থেকে বিষখালি নদীর দূরত্ব অনেক অভিযান শেষ ও শুরুর মধ্যের সময়ে মাছ শিকার করছে, জনবল কম, নিজস্ব বাহন না থাকা এবং নদীতে দ্রুত গতির বাহন ব্যবহার করার সুযোগ না থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির জেলেরা মাছ শিকার করছে।
বড়ইয়া ইউপি সদস্য শাহাদাৎ হোসেন কাজল মোল্লা জানান, নিষেধাজ্ঞার সময় যাতে এলাকার কোন মাছ ধরতে শিকার না করে এজন্য তাদের অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু নলছিটির জেলেরা সুযোগ বুঝে ঠিকই মাছ শিকার করছে, এবিষয়ে প্রশাসনের কঠোর নজর দেয়া জরুরি। নলছিটি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রমনি কান্ত মিন্ত্রী জানায়, দূরত্ব ও দূর্গম হওয়ায় ওইসব এলাকায় অভিযানে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে, এ সুযোগে কিছু মাছ করছে, তবে অভিযান চলমান রয়েছে। জেলে ও জাল আটক করাও হচ্ছে। রাজাপুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আবুল বাসার শনিবার ১১টা ৫০ মিনিটে জানান, অভিযানের একটি টিম পালটে নোঙক করা করেছে এবং ইউএনওর নেতৃত্বে একটি টিম নদীতে রয়েছে। তিনি জানান, নদীর তীরে ছোট ছোট ক্যানেল থাকার কারনে অভিযান দেখে ক্যানেলে ডুকে পড়ে। আর ক্যানেলে ডোকা যায় না, ক্যানেলে অভিযান চালাতে গেলে জেলে ও তাদের লোকজন দাও পড়ে এবং ইট পাটকেল মারে। তার পরেও অভিযান চলমান রয়েছে। রাজাপুরের ইউএনও সোহাগ হাওলাদার জানান, প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ নিধনরোধে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে এবং ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। ইলিশ রক্ষায় নদীতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে বানারীপাড়ায় সন্ধ্যা নদীতে মৎস্য অধিদপ্তরের ঢিলেডালা অভিযানে জাল-মাছসহ তিন জেলেকে আটকের পর জেল জড়িমান করেছে ভ্রাম্যমান আদালত। শুক্রবার রাত ৯টায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট শেখ আব্দুল্লাহ সাদীদ এ রায় প্রদান করেন।
এ বিষয়ে জানা গেছে, শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ আব্দুল্লাহ সাদীদ সন্ধ্যা নদীর চিরাপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫০০ মিটার কারেন্ট জাল ও প্রায় ১মন মাছ মহ জেলে রাজিব সরদার, ভাই রহিম সরদার ও রুম্মনকে আটক করেন। পরে তিনি আটক জেলে রাজিব সরদারকে ২৮ দিন ও রহিম সরদারকে ২০ দিন বিনাশ্রম সাজা ও রুম্মনকে ৪ হাজার টাকা জড়িমানা রায় দেন। এদিকে ইলিশ’র প্রজনন মৌসুমে উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরের ঢিলেডালা অভিযান পরিচালনা করার কারণে বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় জেলেরা মোবাইল নেটোয়ার্কের মাধ্যমে কারেন্ট জাল দিয়ে ইলিশ নিধন করছেন বলে এলাকায় অভিযোগ ওঠেছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় একাধিক ব্যাক্তি জানান, জেলেরা সোর্সের মাধ্যমে সন্ধ্যা নদীতে অভিযান পরিচালনাকারীদের অবস্থান জেনে জেলেদের জাল ফেলার স্থানে পৌছার দূরত্ব কমপক্ষে ২০-২৫ মিনিট সময় পেলেই তারা কারেন্ট দিয়ে ইলিশ নিধন করছেন। এবিষয়ে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো.জামাল হোসেন বলেন, বরাদ্ধ কম থাকায় একটি ট্রলার দিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে তার এক এলাকা থেকে আর এক এলাকায় যেতে কম পক্ষে দুই ঘন্টা সময় লাগে। তার এ সময়টা কাজে লাগিয়ে জেলেরা ইলিশ নিধন করছেন বলে জানা গেছে।
Leave a Reply