মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৯ পূর্বাহ্ন
তানজিল জামান জয়,কলাপাড়া(পটুয়াখালী) প্রতিনিধি।। আসন্ন ধর্মপ্রান মুসলমানদের ঈদুল আযহা আসছে আর মাত্র তিন দিন পরেই। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে আত্মোৎসর্গ করা শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তার নামে পশু জবেহ করাকেই কোরবানি বলে। ঈদ অর্থ আনন্দ, কোরবানি অর্থ নৈকট্য, আত্মত্যাগ। কোরবানি ঈদ অর্থ হলো ত্যাগের উৎসব। পরিভাষায় কোরবানি ঈদ হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পরম দয়ালুর নামে নির্দিষ্ট কিছু হালাল পশু কোরবানি করা হয়। ভেড়া, ছাগল, দুম্বা, গরু, মহিষ ও উট জবেহ করে আনন্দ উদ্যাপন করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সকল সম্প্রদায়ের জন্য আমি কোরবানির বিধান দিয়েছি, তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণস্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর নিকট ওদের গোশত রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া।
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোরবানি করেছেন আদমপুত্র হাবিল ও কাবিল। হাবিল ছিলেন মেষপালক, তিনি তাঁর মেষের পাল হতে সবচেয়ে উত্তম মেষটি আল্লাহর রাহে কোরবানি করলেন। কাবিল ছিলেন কৃষিজীবী, তিনি কিছু শস্যদানা কোরবানির জন্য উৎসর্গ করলেন। হাবিলের কোরবানি কবুল হলো, প্রমাণস্বরূপ আকাশ হতে অগ্নি এসে তার কোরবানিকে ভস্মীভূত করল। কাবিলের কোরবানি কবুল হলো না, আর তা অমনি পড়ে থাকল। ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর সময় থেকে প্রচলন হলো বর্তমান কোরবানি।
হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কোরবানির ইতিহাসও কোরআনে এসেছে, (তিনি বললেন) ‘হে আমার প্রতিপালক। আমাকে নেক সন্তান দান করুন। অতঃপর আমি তাকে এক সহিষ্ণু পুত্রের সুসংবাদ দিলাম’, অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার বয়সে উপনীত হলো তখন ইব্রাহিম (আ.) বললেন, ‘হে বত্স! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে তোমাকে আমি জবাই করছি, তোমার অভিমত কী?’ সে বলল, ‘হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা–ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহিম (আ.) তার পুত্রকে কাত করে শোয়াল, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, ‘হে ইব্রাহিম! আপনি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলেন।
১০ জিলহজ সকাল থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত যেকোনো সময় যাঁরা নিসাব পরিমাণ সম্পদ (সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এ উভয়ের যেকোনো একটির মূল্য সমপরিমাণ) ব্যবসাপণ্য বা নগদ অর্থের মালিক থাকবেন বা হবেন, তাঁদের কোরবানি করা ওয়াজিব। হাদিসে রয়েছে, কোরবানি হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ফা ছল্লি লিরব্বিকা ওয়ানহার’ অর্থাৎ হে নবী (সা.)। আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।
এই ঈদুল আযহাকে সামনে রেখেই এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন কলাপাড়া উপজেলার কামার শিল্পীরা। ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে তাদের ব্যস্ততা। কোরবানির পশু কাটাকুটিতে চাই ধারালো দা, বটি, চাপাতি ও ছুরি। তাই কয়লার চুলায় দগদগে আগুনে গরম লোহার পিটাপিটিতে টুং টাং শব্দে মুখর হয়ে উঠেছে উপজেলার কামারশালাগুলো।
আর সামনে আগুনের শিখায় তাপ দেয়া, হাতুড়ি পেটানোর টুং টাং শব্দে তৈরি হচ্ছে দা-বটি, চাপাতি ও ছুরি। পশু কোরবানিতে এ সব অতীব প্রয়োজনীয়। তাই যেন দম ফেলারও সময় নেই কামারদের। নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ করছেন কামাররা। কাক ডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছেন তারা। সারা বছর তেমন কাজ না থাকলেও কুরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে কয়েকগুণ ব্যস্ততা বেড়ে যায় কামারদের।
কামাররা জানান, পশুর চামড়া ছাড়ানো ছুরি ১০০ থেকে ২০০, দা ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা, বটি ২৫০ থেকে ৫০০, পশু জবাইয়ের ছুরি ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকা, চাপাতি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পশু জবাইয়ের সরঞ্জামাদি কিনতেও লোকজন ভিড় করছেন তাদের দোকানে। আগে যে সব দোকানে দুজন করে শ্রমিক কাজ করতো, এখন সে সব দোকানে ৫-৬ জন করে শ্রমিক কাজ করছেন। কামার দোকানদারদের অভিযোগ, কুরবানির ঈদ উপলক্ষে কয়লার দাম ও শ্রমিকের দাম বেড়ে গেছে। তবে ক্রেতাদের অভিযোগ ঈদ উপলক্ষে দা, চাপাতি ও ছুরির দাম বেশি নেয়া হচ্ছে।
ক্রেতা আব্দুল সোবহান বলেন, আমি একটি চাপাতি ৫০০ টাকা দিয়ে ক্রয় করেছি। এছাড়া আমাদের এলাকার ছুড়ি, দা, জবাই করা ছুরিসহ প্রায় ৭ টি জিনিস রিপেয়ারিং করার জন্য এসেছি। ঈদ উপলক্ষে কামাররা মজুরি অনেক বেশি নিচ্ছে। কামার শিল্পীদের কাছে বঁটি ক্রয় করতে আসা জয়নাল হোসেন জানান, কোরবানির ঈদের সময় (ঈদুল আযহার সময়) কসাই পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। তাই একটা নতুন বঁটি কিনেছি, আর পুরান চাপতি, দা শান দিয়ে নিচ্ছি নিজেরাই কাজে লেগে যাব। তিনি বলেন, গেল বছরের চেয়ে এবছর পুরনো জিনিস শান দিতে মানভেদে ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেশি। তিনি আরো জানান, কামাররা দোকানের সামনে বিক্রির জন্য নতুন দা, বঁটি, ছুরি সাজিয়ে রেখেছে। আর তা কিনতে গ্রাহকের আনা গোনাও বেড়েছে। ভিরের মাঝে বাছাই করে একটা নতুন চাপাতি কিনেছি ৫০০ টাকা দিয়ে।
অপর ক্রেতা শহিদুল ইসলাম বলেন, ঈদ ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে কামাররা তাদের মজুরি, ছুরি, দা, চাপাতির দামও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি একটি চাপাতি ৭০০ টাকা এবং একটি ছুরি ২০০ টাকা দিয়ে ক্রয় করেছি। যা দুই মাস আগেও ছিল ছুরির দাম ১৫০ টাকা ও চাপাতির দাম ৫০০ টাকা।
কলাপাড়া পৌরশহরের কামার দোকানি গৌতম কর্মকার জানান, সারা বছর কাজ কম থাকে। কুরবানির ঈদ এলে আমাদের কাজ বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ছুরি শান দেয়ার জন্য ৫০ টাকা থেকে শুরু করে কাজের গুণাগুণের উপর ভিত্তি করে ১৫০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। কুরবানির ঈদ উপলক্ষে আমাদের বেচা কেনা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। তবে ঈদের দুই দিন আগে থেকে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা বেচাকেনা হবে। তখন আমাদের খাওয়ার সময়ও থাকে না। কুরবানির ঈদ উপলক্ষে কয়লা ও শ্রমিকের মূল্য বেড়ে গিয়েছে। দুই মাস আগেও প্রতি বস্তা কয়লার দাম ছিলো ৫০০থেকে ৬০০ টাকা। সেই কয়লা এখন আমাদের ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তাই আমরা চাপাতি, ছুরি ও দায়ের দাম একটু বেশি নিচ্ছি। তা না হলে আমাদের লাভ হবে না।
উপজেলার বিভিন্ন বাজার ও কামার পাড়া ঘুরে দেখা যায় লাল আগুনের লোহায় পিটুনিতে সরগরম হয়ে উঠেছে কামার দোকানগুলো। টুংটাং শব্দের ছন্দে তালমিলিয়ে চলছে স্বহস্তের জাদুময়ী হাতুরি আর ছেনির কলা কৌশল। কোরবানির তিন চারদিন আগে। তবে এবছর লোহা আর কয়লার দাম বেশি হলেও তেমন বেশি মজুরি নিতে পারছি না। তাই এ বছর বেশি লাভের আশা করছেন না কামার পাড়ার দোকানিরা। উল্লেখ্য, বছরের এ সময়টাতে কয়লার দাম যাতে না বারে সে বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিগোচোরে নিতে জোর আবেদন জানিয়েছে স্থানীয় কামার শিল্পীরা।
Leave a Reply