সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৯ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ সাংবাদিক জাতির বিবেক। পত্রিকা সমাজের দর্পণ। জনমুখে প্রচলিত থাকা এ শব্দ দুইটি বরিশালের আঞ্চলিক গুটিকয়েক পত্রিকার কারনে মহান পেশাটি কলুষিত হওয়ার পাশাপাশি প্রকৃত সাংবাদিকদের মান-সম্মান ক্ষুন্ন হতে চলছে। এমন পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধানকালে বেড়িয়ে এসেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সমাজের বির্তকিত একাধিক ব্যক্তি পত্রিকার মালিক ও রহস্যজনকভাবে হয়েছে সম্মানিত পদগুলোর অধিকারী।
এরমধ্যে অনেকেই প্রতিদিন সন্ধ্যার পর মাদকের নেশায় টালমাটাল হয়ে উঠতো। রাতে তাদের মুখের কথা শুনলে বাতাসে ভেসে আসে মদের গন্ধ। অতীত জীবনে কেউ ছিলেন সিনেমা হলের টিকিট ক্রয়-বিক্রয়ের চিহ্নিত দালাল। আবার কারো সংবাদ লেখার যোগ্যতা কিংবা পেশা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলেও কূটকৌশলে কতিপয় সাংবাদিকের যোগসাজশে হয়েছে সাংবাদিক নেতা এবং ভাড়াটিয়া পত্রিকার মালিক। কেউবা নিজেকে সাংবাদিকদের অভিভাবক বলে মনে করে নীতিবাক্য বয়ান দিলেও বিতর্কিত কর্মকান্ডের মাধ্যমে বরিশালজুড়ে এ পেশাকে কলঙ্কিত করে তুলছে। সম্প্রতি ব্যাপক আকারে বেড়েছে অনলাইন পত্রিকা।
আর বাদ পড়েনি বরিশালও। ফলে বর্তমানে বরিশাল নগরীতে জমির দালাল, নারী ব্যবসায়ী, বির্তকিত কয়েক রাজনৈতিক ব্যক্তি, শ্রমিক, লঞ্চের দালাল ও কেবিনবয়, হোটেলবয়সহ বিভিন্ন মামলার আসামীরা গলায় সাংবাদিকের পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে নগরী দাবড়ে বেড়াচ্ছে। ভূয়া কথিত সাংবাদিকদের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে খোদ পুলিশেরও অনেকটা ভুমিকা রয়েছে। এসব কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠলেও সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকা এবং পেশাদার সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ না নেয়াকে দায়ী করছেন সচেতন মহল।
একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রস্তুতের নিমিত্তে গত কয়েকদিন বরিশাল শহরের থানা প্রাঙ্গনগুলোতে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সরেজমিনকালে এক হতাশাব্যঞ্জক চিত্রই বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন নামের হরেক আকৃতির পত্রিকা আর মানবাধিকার সংগঠনের ‘সাংবাদিক কার্ডধারীরা’ থানা-পুলিশের দালালি ও তদবির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেকে আইডি কার্ড ঝুলিয়ে প্রকাশ্যেই পুলিশ, র্যাব, ডিবি’র সোর্সের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। সংগঠনগুলো থেকে দেয়া আইডি কার্ডসমূহে ‘মানবাধিকার লংঘন সংক্রান্ত তদন্তকারী কর্মকর্তা’ ফিল্ড অফিসার, জোনাল অফিসার (ইনভেস্টিগেশন), থানা কমিটির সেক্রেটারী, মহানগর কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, কো-অর্ডিনেটর, পরিচালক ইত্যাদি পদবী লেখা থাকে। গতকাল বুধবার সাবেক এক সেনা সদস্য একটি মানবাধিকার সংগঠনের ভিজিটিং কার্ড নিয়ে এসে এ প্রতিবেদকের কাছে জানতে চান সংগঠনটি আসলে কতটা কার্যকর বা আসল না নকল।
তার সাথে আলাপের এক পর্যায়ে তিনি জানান, ওই মানবাধিকার সংগঠনে তিন হাজার টাকা দিলেই একটি পরিচয়পত্র পাওয়া যাবে। আরো জানা যায়, ১ থেকে ৫ হাজার টাকায় তাদের সদস্যপদ বিক্রি করছে সংগঠনটি। কোন থানা কমিটি করতে আগ্রহীদের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা এবং জেলা কমিটির জন্য ১০ হাজার টাকা ফি আদায় করে নেয়। শর্ত দেওয়া হয়, সালিশ বৈঠকের মাধ্যমে কোন টাকা আয় হলে তা আলোচনার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। আজীবন সদস্য হতে হলে দিতে হবে অন্তত ১০ হাজার টাকা। সংগঠনের কোন সদস্য সাংবাদিক হতে চাইলে ‘সাংবাদিক কার্ড’ বাবদ দিতে হবে আলাদা টাকা। এই হলো বরিশালের হালচাল। সরেজমিন নগরী ঘুরে দেখা যায় একাধিক মানবাধিকার সংগঠনের বিশালাকার সাইনবোর্ড। কখনো আবার দেয়ালের চিপায় ছোট সাইনবোর্ডও চোখে পড়ে।
যারা পেশাদার সাংবাদিক তাদের কারো না কারো সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে সাইনবোর্ড হিসেবেও ব্যবহার করেন তারা। সম্ভব হলে সাংবাদিকদের কোনো সংগঠনে নিজের নামটা লিখিয়ে নেয়, তা না হলে নিজেরাই ‘সাংবাদিক’ ‘রিপোর্টার’ ‘প্রেসক্লাব’ শব্দ যোগ করে ভূইফোঁড় কোনো সংগঠন খুলে বসে। প্রয়োজনে টাকা-পয়সা খরচ করে রেজিস্ট্রেশনও করিয়ে নেয়।
অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এসব অযোগ্য ও অপরাধীরা নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় জানান দিয়ে থানা, অফিস-আদালত, লঞ্চ-বাস টার্মিনালে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে দালালি কার্যক্রমে লিপ্ত রয়েছে। এমনকি সমাজের ওই সব বির্তকিতরা তাদের স্বার্থের অনুকূলে মনগড়া সিন্ধান্তানুযায়ী অপরাধী ও অশিক্ষিতদের সাংবাদিকদের ঐতিহ্যবাহী নানা সংগঠনের সদস্য করে নিচ্ছে। ওই বির্তকিতরা যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তখন সেই দলের লোক হয়ে যায়।
অদৃশ্য ক্ষমতার অধিকারী ওই বির্তকিতরা তথ্য সংগ্রহের জন্য নিজে সরেজমিনে না গিয়ে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে তাদের ছত্রছায়ায় থাকা ওই সব অপরাধী ও অশিক্ষিতদের। তাদের ছত্রছায়ায় থাকা সাংবাদিক নামধারীরা এ পেশায় যুক্ত হবার পরও কেউ ইয়াবা, ফেন্সিডিল ও নারীসহ আইন শৃংখলা বাহিনী সদস্যদের হাতে আটক হবার পাশাপাশি একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হয়েছে। এসব ঘটনার অনুকূলে একাধিক স্থানীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হয়। আবার কয়েকটি ঘটনা রহস্যজনকভাবে ধামাচাপা পরে যায়।
বিভিন্ন উপজেলা থেকে নগরীতে উঠে সাংবাদিক পেশার সাথে যুক্ত হওয়া অধিকাংশ ব্যক্তিদের স্থায়ী ঠিকানায় খোঁজ নিলেই বেড়িয়ে আসবে তারা একাধিক মামলার আসামীসহ অতীত জীবনে অপরাধমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণচিত্র। নিজের অস্থিত্ব বাঁচাতে ওই সব অপরাধীরা কূটকৌশলে সাংবাদিক সাইন বোর্ড ব্যবহার করে আইনি সুযোগে সুবিধা ভোগ করছে। এ পেশার সাইনবোর্ড লাগিয়ে তারা ও তাদের অভিভাবকরা মনের আশা-বাসনা পূরণ করছে। সরকারী নিয়ম না মেনে কেউ নানা ব্যবসার সাথে যুক্ত হয়ে অসৎ উপায়ে অর্থ কামাচ্ছে। কয়েকজন রাতারাতি কোটিপতি বনে গেলেও দুদক এর ভূমিকা নিশ্চুপ। আবার কারো ঘরে স্ত্রী-সন্তান থাকলেও কু-নজর অন্য নারীসহ অসামাজিক ব্যবসার দিকে। কেউ পত্রিকা বা অনলাইনের একটি পরিচয়পত্র গলায় ঝুলিয়ে মাদক ক্রয়-বিক্রয়সহ আবাসিক হোটেলে খদ্দের-পতিতার সেবায় নিয়োজিত রয়েছে। কেউ রাজনীতি ও অফিস-আদালতের দালালি কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত।
আশ্চর্য্যজনক মনে হলেও এ কথা সত্য, বিসিএস পাশ করে জনসেবায় নিয়োজিত থাকা অধিকাংশ কর্মকর্তাই বরিশালের বির্তকিত ওই সাংবাদিক ও তাদের অভিভাবকদের সাথে উঠবস করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে বলে বরিশালের প্রেক্ষাপটে দৃশ্যমান হয়ে উঠে এসেছে তা। বরিশালের অধিকাংশ সরকারী বেসরকারী অফিস কার্যালয়ে, শিল্প-কারখানায়, পথে-ঘাটে ও চায়ের দোকানে জনমুখে আলোচনার ঝড় বইছে স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকার বির্তকিত কর্তৃপক্ষ ও সাংবাদিকদের বর্তমান ও অতীতের কার্যক্রম নিয়েও।
এমন অবস্থা বিরাজ করলেও বরিশালের সাংবাদিকদের একটি মহল প্রশ্ন তুলেছে ‘বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম’ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও তাদের রচিত পাঠ্য বই সর্বস্তরে স্থান পেয়েছে। তাছাড়া অযোগ্যতার অনুকূলে দেশে ও আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন কর্মকান্ডে নানা লোক যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে এসেছে বা আসছে। যে যেভাবে পারছে, সে সেভাবে চলছে। তবে পেশাদার সাংবাদিকদের মাঝে এ নিয়ে হৈ-হুল¬া থাকলেও এসব অপরাধীদের যারা সুযোগ দিচ্ছে তাদের নিয়ে খোদ প্রশাসনের তেমন উদ্যোগ নেই।
এমন পরিস্থিতিতে অবশ্য তৎকালীন বিএমপি কমিশনার এসএম রুহল আমিন পুলিশের ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি মিডিয়া সেল গঠন করেছিলেন। এরমধ্যে কয়েক সদস্য বদলিও হয়েছে। এ কমিটি অপরাধমূলক কর্মকান্ডে যুক্ত থাকা সাংবাদিকদের নামের তালিকা করলেও অপরাধীরা কিভাবে এবং কি যোগ্যতায় এ পেশায় যুক্ত হয়েছে এবং অপরাধীদের কে নিয়োগ দিয়েছে। এসব বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে না বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশের এক সূত্র। সূত্রটি আরো জানিয়েছে, নানা অপরাধের সাথে যুক্ত থাকা নামধারী সাংবাদিকের কলুষিত অভিভাবকদের সাথে অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক নেতাদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যে কারনে হলুদ সাংবাদিক সৃষ্টি হওয়ার মূল উৎপত্তিস্থল দমনের বিষয়টি আলোচনায় নেই।
গতকাল এ বিষয়টি বেশ আলোচনায় উঠে আসার প্রেক্ষিতে বরিশালের একজন সিনিয়র সাংবাদিক মন্তব্য করেছেন, “আগে দেখা যেত পত্রিকা হাউজগুলোতে ৬ মাস প্রেস লিষ্ট কেটেও একজন সংবাদ কর্মী হওয়া যেত না। আর এখন একটা মটর সাইকেল আর একটা ক্যামেরা নিয়ে আসলে তাকে সরাসরি সম্পাদক সাবরা সাথে সাখে একখান কার্ড ধরাইয়া দেয়, সেই সাথে বলে দেয় “যাও পাখি উড়ে খাও”।
গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের এক সাংবাদিক একটি লেখা পোষ্ট করেছেন যাতে লেখা ছিল “বরিশালে ভূয়া সাংবাদিক ধরতে জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও র্যাবের পক্ষ থেকে একটি হেল্প লাইন বা অভিযোগ বক্স চালু করা যেতে পারে।”
এ ব্যাপারে বরিশাল জেলা প্রশাসক বলেন, সাংবাদিকদের বিষয়ে দেখভালের দায়িত্ব প্রেস কাউন্সিলের। তাদের পক্ষ থেকে হলুদ কিংবা ভূয়া সাংবাদিকতার বিষয়ে শুদ্ধি অভিযান চালালে হলুদ সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য কমবে বলে আশা করেন তিনি।
এ ব্যাপারে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান (বিপিএম-বার) বলেন, সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। সমাজের তাদের ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে কেউ সাংবাদিক না হয়েও যদি সাংবাদিক পরিচয় দেয় এবং মিথ্যা প্রতারণা করে সেটা অন্যায়, অপরাধ। এ ধরণের কথিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রকৃত এবং পেশাদার সাংবাদিকদেরই ভুমিকা নিতে হবে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বরিশালে বেশ কিছু কথিত সাংবাদিক প্রতারণা ও মাদকসহ আটক হয়েছে যা কাম্য নয়। অবশ্য পেশাদার সাংবাদিক ও পুলিশ একযোগে কাজ করলে হলুদ সাংবাদিকতা রোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
Leave a Reply