রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩১ অপরাহ্ন
এম. কে. রানা ॥ বরিশাল নগরী ও আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক গড়ে ওঠছে বহুতল ভবন। ইতোমধ্যে শুধু বরিশাল নগরীতে আবাসিক ও বানিজ্যিক ভবন মিলিয়ে অর্ধ শতাধিক বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলেও তার একটিরও নেই ‘চূড়ান্ত ছাড়পত্র’। বিশেষ করে অগ্নিকা- বা ভুমিকম্প থেকে নিরাপদ থাকার জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিভেন্সের চূড়ান্ত ছাড়পত্র নেই। ফলে ভবনগুলো কতটা ঝুঁকিমুক্ত সে বিষয়টি যেমন সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষের অজানা রয়ে গেছে, তেমনি সেগুলোর ব্যবহার উপযোগিতা নিয়ে কোনো ধারণা নেই ব্যবহারকারীদের। তাই এ সব ভবনগুলোতে ঝুঁকিতে রয়েছে হাজার হাজার মানুষ। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকায় বেশ কয়েকটি ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটার পর বহুতল ভবনগুলো নিয়ে কাজ করছে সরকারের বিভিন্ন দফতর।
সময়ের সাথে পাল¬া দিয়ে বরিশাল মহানগর ও এর আশপাশ এলাকায় গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। বিশেষ করে বরিশাল নগরীতে গত এক দশকে যেন বহুতল ভবন নির্মাণে অঘোষিত প্রতিযোগিতা চলছে। তবে বিভিন্ন নকশায় নির্মিত সুরম্য এসব ভবন নির্মাণকাল ও পরবর্তী সময়ে যথাযথা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। সংশি¬ষ্ট সূত্রে জানা যায়, বরিশাল নগরীতে গত এক দশকে প্রায় হাজারের মতো বহুতল ভবন নির্মাণে অনুমোদন দিয়েছে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন। যার মধ্যে ৯ থেকে ১৫ তলা ভবনের অনুমোদন রয়েছে অর্ধ শতাধিক। আর ৫-৬ তলা ভবনের অনুমোদন দিয়েছে সাড়ে ৮ শতাধিক। কোনো কোনো ভবনের আবার অনুমতি নেওয়া হয়েছে দ্বিতল পর্যন্ত।
কিন্তু সেগুলো নির্মাণকালে নকশা পর্যন্ত যথাযথভাবে মানা হয়নি। নির্মাণ করা হয়েছে ৫ তলা কিংবা আরো বেশি তলা বিশিষ্ট ভবন। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। পাশাপাশি দুটি ভবনের মধ্যে ফাঁকা জায়গা কম থাকে, যা ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ভবনে ভুমিকম্প কিংবা অগ্নি প্রতিরোধে নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। ফলে ভবনগুলোতে লোকজন বসবাসও করেন ঝুঁকি নিয়ে। ভূমিকম্প হলে কোনো কোনো ভবনে দেখা দেয় ফাটল কিংবা দেয়াল ধ্বস। এছাড়া অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলে বহু হতাহতের আশংকা থেকে যায়। কেননা বহুতল ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলে তা প্রতিরোধের কোন সক্ষমতা নেই বরিশাল ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের।
প্রকৌশলীদের মতে, বহুতল ভবনে আগুন থেকে বাঁচতে প্রথমেই একটি জরুরি নির্গমন পথ তৈরি রাখতে হবে। যাতে আগুন লাগলে দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে আসা যায়। জরুরি নির্গমন পথ পরিস্কার রাখা ছাড়াও জরুরি নির্গমন পথে ভালো মানের ফায়ার ডোর সংযোজন করতে হবে। যেটি প্রায় দুই ঘন্টা আগুন ও ধোঁয়া প্রতিরোধ করতে সক্ষম। সিঁড়িগুলো যাতে তালাবাদ্ধ ও ক্রুটিপূর্ণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শুধু জরুরি নির্গমন পথ তৈরি রাখলেই চলবে না, পরিবারের সদস্য ও সহকর্মীদের জরুরি নির্গমন পথ সর্ম্পকে অবগত করতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বরিশাল অফিস সূত্রে জানা যায়, দ্বিতল বা তার চেয়ে বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয়। দুর্যোগ দেখা দিলে নিরাপদে বের হওয়ার জন্য প্রতিটি ভবনে জরুরি বর্হিগমন রাস্তা, অগ্নিনির্বাপণের জন্য পানি, ড্রাই পাউডার ও ফায়ার এক্সটিনগুসারের ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক। তাছাড়া ৫ হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তনের একতলা ভবনের ক্ষেত্রেও ফায়ার সার্ভিসের এ নীতিমালা প্রযোজ্য। কিন্তু নগরীতে গড়ে ওঠা আকাশচুম্বী ভবনগুলোর নির্মাতা ও মালিকা তা যথাযথভাবে অনুসরণ করেননি। এছাড়া বাংলাদেশ বিল্ডি কোর্ড নিয়ম মেনে ভবন করবেন এমন শর্তে অনুমোদন দেয় বরিশাল ফায়ার সার্ভিস।
এব্যাপারে আলাপকালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বরিশাল অফিসের সহকারী পরিচালক (চঃদাঃ) মোঃ মতিয়ার রহমান বলেন, প্রতিটি বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিল্ডি কোর্ড নিয়ম মেনে চলতে হয়। সিটি করপোরেশন থেকে নকশা অনুমোদনের আগে ভবন মালিককে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নিতে হয়। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বরিশাল ফায়ার সার্ভিস অফিস থেকে ৩০/৩৫টি ভবনের মালিক ছাড়পত্র নিয়েছে। ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হলে বসবাস উপযোগী সনদ নিতে হয় ফায়ার সার্ভিস থেকে। কিন্তু অধিকাংশ ভবন মালিকই তা নেন না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস থেকে ছাড়পত্র নেয়ার পরও এখান থেকে তদারকি করা হয়। তবে যদি কেউ নিয়ম না মানে এ ধরণের অভিযোগ পেলে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।
সহকারী পরিচালক (চঃদাঃ) মোঃ মতিয়ার রহমান আরো বলেন, ঢাকা কিংবা খুলনায় ১৫ তলা ভবনে অগ্নি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদী থাকলেও বরিশালে তা নেই। বিশেষ করে ছয় তলার উপরে গেলে ট্রান টেবিল ল্যাডার (টিটিএল) গাড়ি প্রয়োজন, তা বরিশালে নেই। সর্বোচ্চ কত তলা ভবনে অগ্নিকা- ঘটনা ঘটলে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ বলতে কিছু বলা যাবেনা। কেননা সু-উচ্চ ভবনে অগ্নি প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদী আমাদের নেই বলেন তিনি।
সরেজমিন ঘুরে কিছু কিছু ভবনে অগ্নি নির্বাপণ সিলিন্ডার চোখে পড়লেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল বা এগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এছাড়া অগ্নিকা-ের সময় বর্হিগমনের কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি ভবনগুলোতে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবনগুলোতে সংস্কারের পাশাপাশি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া না হলে যেকোন সময় ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। এজন্য একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে তেমনি সমস্যা সমাধানে সরকারকে হাতে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদী কার্যকরী উদ্যোগ, এমনটাই মত নগরবাসীর।
Leave a Reply