শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৫ অপরাহ্ন
সংশোধিত গঠনতন্ত্র
৭ নম্বর ধারা বিলোপ নিয়ে চাপে বিএনপি
এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক
নিবন্ধন বাতিলের ঝুঁকি রয়েছে
এখনো গঠনতন্ত্র প্রকাশ করা হয়নি
নিজস্ব প্রতিবেদক
দলীয় গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা বিলুপ্তি নিয়ে চাপে পড়েছে বিএনপি। একটি অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে গিয়ে পুরো ধারাই বাতিল করেছে দলটি। এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ নিয়ে যে কোনো সময় দলটিকে তলব করতে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নিবন্ধন বাতিলের হুমকিও রয়েছে দলটির। এদিকে কাউন্সিলের প্রায় দুই বছর পর নির্বাচন কমিশনে দলীয় ‘গঠনতন্ত্র’ জমা দিলেও এখনো তা প্রকাশ করেনি বিএনপি। এ নিয়ে দলের দায়িত্বশীল নেতারা কোনো মন্তব্যই করছেন না। ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ ব্যক্তি দলের নেতৃত্ব দেওয়ার অযোগ্য হবেন’—গঠনতন্ত্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ ৭ নম্বর ধারা বাদ দেয় বিএনপি। ৭ নম্বর ধারার ‘কমিটির সদস্যপদের অযোগ্যতা’ শিরোনামে বলা ছিল, “নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যে কোনো পর্যায়ের যে কোনো নির্বাহী কমিটির সদস্যপদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী হিসেবে ‘অযোগ্য’ বলে বিবেচিত হবেন। তাঁরা হলেন : (ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮-এর বলে দণ্ডিত ব্যক্তি; (খ) দেউলিয়া; (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি; (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা দলীয় কাউন্সিলে অনুমোদন করাতে হবে। কিন্তু বিএনপি তা করেনি। বিএনপির চেয়ারপারসনের একক সিদ্ধান্তে দলীয় ফোরামে আলোচনা ছাড়াই এই সংশোধনী আনা হয়েছে। এ ছাড়া এটা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এ কারণে বিএনপির নিবন্ধনও বাতিল হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান কথা বলতে রাজি হননি। দলের অপর দুই স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ফোন রিসিভ করেননি। তবে বিএনপির সাবেক এক সংসদ সদস্য বলেছেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৪২ থেকে ৭৮ ধারায় ক্রিমিনাল অফেন্স অংশে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি দুই বা ততোধিক বছর দণ্ডিত হলে তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। বিএনপি যেটা করেছে তা মোটেও ঠিক হয়নি। তারা ৭(ক) অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে বাকিগুলো রাখতে পারত। কিন্তু তা করেনি। তাহলে কি বিএনপিতে উন্মাদ, দেউলিয়া, কুখ্যাত বা সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা সদস্য হতে পারবে? আরপিওর সঙ্গে সাংঘর্ষিক—এই অজুহাত ধরে নির্বাচন কমিশন চাইলে বিএনপির নিবন্ধনও বাতিল করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার আগে আনা এই সংশোধনী কেবল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে রাখার ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরও বিএনপির নেতৃত্বে থাকার পথ সুগম করা হয়েছে। কার্যত শীর্ষ নেতাদের পদে রাখতেই ৭ ধারা বিলোপ করা হয়েছে। এই বিতর্কের মধ্যেই বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে। ২৮ জানুয়ারি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার সঙ্গে দেখা করে সংশোধিত গঠনতন্ত্র জমা দেন। এর পর থেকে সংশোধিত গঠনতন্ত্র থেকে ৭ নম্বর ধারা বাতিল করা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। মূলত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে বহাল রাখার জন্য ওই ৭ নম্বর ধারাটি বাতিল করা হয়েছে বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। কেননা ইতিমধ্যে আদালতের রায়ে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দণ্ডপ্রাপ্ত।
ওই সময় নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মূলত বিএনপির গঠনতন্ত্রসহ সাংগঠনিক বিষয়ক কিছু নথি জমা দিতে তারা নির্বাচন কমিশনে এসেছিলেন। বিএনপির যে কাউন্সিল হয়েছে সেখানে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং গঠনতন্ত্র সংশোধন ছাড়াও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত আছে। সেই জিনিসগুলোর কপি নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছেন তারা।
বিএনপি নেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে এসব সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়। দলীয় চেয়ারপারসন ও কাউন্সিল অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে খালেদা জিয়া ইসিতে পাঠানো চিঠিতে লিখেছিলেন, সংশোধনীগুলো কাউন্সিলের অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হলে সর্বসম্মতিক্রমে তা অনুমোদিত হয়।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, ইসিতে নিবন্ধিত হওয়ার সময় দলীয় গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়। পরবর্তী সময়ে তা সংশোধন করা হলে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির কাউন্সিল হলেও সেখানে আনা সংশোধনী দীর্ঘদিন ইসিতে জমা দেয়নি দলটি। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে বিএনপিকে চিঠিও দেওয়া হয়। অবশেষে কাউন্সিলের ১ বছর ১০ মাস পরে চলতি বছর ২৮ জানুয়ারি তা ইসিতে জমা দেয় বিএনপি। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির এই সংশোনীর বিষয়ে নির্বাচন কমিশন দলটির কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারে। একই সঙ্গে ষষ্ঠ কাউন্সিল অধিবেশনে সংশোধনীর মূল তালিকাও তলব করতে পারে ইসি। এ ছাড়া ৭ নম্বর ধারা বিলুপ্তি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সঙ্গে সাংঘর্ষিক এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করা হতে পারে। এ বিষয়ে একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘বিষয়টি দেখভালের জন্য কমিশনের আইন-বিধি সংস্কার কমিটি আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এখনো পর্যন্ত বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র হাতে পাইনি। কমিশনে বিষয়টি উপস্থাপিত হলে বিস্তারিত বলা যাবে।’
Leave a Reply