বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৪ অপরাহ্ন
হৃদয় আলম॥ ঘড়ির কাটায় তখন বিকেল ৪টা। অফিস শেষ বাসে করে বাসায় ফিরছিলেন নিজামুল হক। হঠাৎ মহাখালী সিগন্যালের জ্যাম বাঁধলেই লাল রঙের লিপস্টিক, কপালে কালো টিপ, কড়া মেকআপ করা দু’জন হিজড়া বাসে উঠেন। উঠেই দু’জন বাসের দুই সারিতে বসা সাধারণ যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা তোলা শুরু করলেন।
একপর্যায়ে পেছনের সারিতে থাকা নিজামুল হকের কাছে গিয়ে টাকা দাবি করেন হিজড়াদের একজন। বলেন, ‘দেও, ভাইয়া দেও। ২০ টাকা দেও।’ প্রতিত্তুরে নিজামুল বলেন, ‘টাকা নেই’। এরপর তাদের (হিজরা) একজন; যিনি টাকা তুলতে এসেছিলেন তিনি বললেন, ‘টাকা দিবি, না হয় ‘চুমু’ দেব। দে, টাকা দে।’
অন্যদিকে বরিশাল থেকে ঢাকা এসেছেন করিম মিয়া। যাবেন মেয়ের বাসা মহাখালীতে। বাস ছাড়লো। তিনি আর অন্যদের মতো বাসে বসেছিলেন। ক্লান্ত শরীরে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন টের পাননি। এরপর যখন ঘুম ভাঙলো তখনকার পরিবেশটি ছিল রীতিমতো অস্বস্তিকর। তিনি যখন চোখ খুললেন তখন তার পুরো গালে কারো ঠোঁটের দাগ লেগে ছিল। দু’জন হিজড়া যখন বাসে সবার থেকে টাকা তুলছিলেন, তখন ক্লান্ত শরীরে সিটের সঙ্গে হেলান দিয়ে ঘুমিয়েছিলেন করিম। এরপর টাকা তুলতে তুলতে তার কাছে এসে হিজরা যখন দু’বার ডাকেও সাড়া পাননি তখন করিমের গালে চুমু দিতে শুরু করেন ওই হিজড়া। এরপর করিম মিয়া থতমত খেয়ে চোখ খুললেও তখন তার বলার মত কিছু ছিল না।
আহমেদ খান চারবছর ধরে রাজধানীতে থাকেন। তার সাথে এক অনাকাঙিক্ষত ঘটনা ঘটেছিল আজ থেকে মাস দু’য়েক আগে। যা ভেবে এখনো তিনি ভয়ে আঁতকে উঠেন। ঘড়ির কাটায় তখন রাত দশটা। বাসে ফার্মগেটের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন এই তরুণ। হঠাৎ বাসে উঠে আসেন এক হিজড়া। বাসের যাত্রী ছিল মাত্র চারজন। তৃতীয় লিঙ্গের যিনি টাকা তুলছিলেন তিনি খানের কাছে এসে তিনশ’ টাকা দাবি করে বসেন। কিন্তু খান এতো টাকা নেই বলে ২০ টাকা বের করে দেন এবং জানান তিনি শিক্ষার্থী। কিন্তু ওই হিজড়া তার কথায় কর্ণপাতও করলেন না। শেষমেশ ১০০ টাকা দিলেও তা না নিয়ে রেগে গিয়ে খানের অণ্ডকোষ চেপে ধরেন ওই হিজড়া।
শুধু নিজামুল, করিম মিয়া আর আহমেদই না, এ ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে রাজধানীর বিভিন্ন অলি-গলি, বাস, লেগুনায়। অনেক সময় বাসা-বাড়িতেও দল বেধে হানা দেয় হিজড়া সম্প্রদায়ের কোনো কোনো দল। আর এর ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ জনগণের।
সরেজমিনে ঘুরে কথা হয় আরো কয়েকজনের সাথে। একজন হিজড়া আগারগাঁওয়ে এভাবেই টাকা তুলছিলেন। সিগন্যাল ছাড়ার পর রিকশার এক যাত্রী বেশ উচ্চস্বরেই বললেন, ‘এই সিগন্যাল তো বাঁচলাম, সামনে আবার না আটকায়!’
যাত্রীরা জানান, যেসব সিগন্যালে হিজড়ারা দলবদ্ধ হয়ে টাকা তোলে, সেখানে তারা বেশি ভয়ে থাকেন। হিজড়াদের উগ্র আচরণ, গায়ে হাত দেয়াসহ বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে তারা বাধ্য হয় টাকা দিতে। ঈদ, থার্টি ফাস্ট নাইটসহ অন্যান্য দিনকে সামনে রেখে হিজড়াদের টাকা তোলা শুধু সিগন্যালেই নয়, অফিস-আদালতেও চলে। বকশিশ না দেয়া পর্যন্ত হিজড়ারা একেকটি অফিস প্রায় ঘেরাও করে রাখে। এতে নগরবাসী আতঙ্কে থাকার পাশাপাশি বিরক্তও হচ্ছেন। তবে হিজড়াদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা নিরুপায় হয়েই যাত্রী বা অন্যদের জিম্মি করছে।
সরকার ২০১২ সালে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে একটি কর্মসূচি হাতে নেয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদপ্তর এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
দেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিয়ে সঠিক তথ্য নেই। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদপ্তর ১৫ জুলাই ২০২০ -এর এক জরিপে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশের একই সময়ে করা জরিপের হিসাবও বলছে, সংখ্যাটি দশ হাজারের কাছাকাছি। তবে এ সংখ্যা অনেক বেশি বলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত।
সরকারের কর্মসূচি বর্তমানে চলছে ৬৪ জেলায়। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ৫,৫৬,০০,০০০/- (পাঁচ কোটি ছাপ্পান্ন লক্ষ) টাকা। এ অর্থবছরে মোট উপকারভোগীর সংখ্যা ৫ হাজার ৭৬৭। কর্মসূচির আওতায় প্রাথমিক থেকে উচ্চ স্তর পর্যন্ত শিক্ষাবৃত্তি, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া, প্রশিক্ষণ শেষে ১০ হাজার টাকার অনুদান এবং ৫০ বছরের বেশি বয়সী এবং অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের মাসিক ৬০০ টাকা করে ভাতা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া স্কুলগামী হিজড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৪ স্তরে (জনপ্রতি মাসিক প্রাথমিক ৭০০, মাধ্যমিক ৮০০, উচ্চ মাধ্যমিক ১০০০ এবং উচ্চতর ১২০০ টাকা হারে) উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে।
রাজধানীতে একটি কলেজ থেকে এম এ পরীক্ষা দেবেন একজন হিজড়া। তিনি সরকারের কর্মসূচির আওতায় মাসিক এক হাজার টাকা করে শিক্ষাবৃত্তি পাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই হিজড়া বলেন, ‘পরিবার আমাকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করে। নিজের থাকা, খাওয়া, পড়াশোনাসহ খরচ মেটানোর জন্য মিরপুর এলাকা থেকে টাকা তুলি।
এ বিষয়ে কথা হয় সচেতন সমাজসেবা হিজড়া সংঘের নির্বাহী পরিচালক ইভান আহমেদ কথার সাথে। তার সংগঠন তৃতীয় লিঙ্গের মানবাধিকার, এইচআইভি এইডস নিয়ে কাজ করে। তিনি বলেন, আসলে বাসে বা অন্য কোথা থেকে টাকা তোলাটা হিজড়াদের কোনো পেশা না। আমরা কোনো কাজ না পেলে এ ধরনের পথ বেছে নেই। আসলে সরকার তো অনেক আশা-ভরসাই দিয়েছেন। কিন্তু সব তো আর পূরণ করা হয় না। কতজন আসলে সহায়তা পাচ্ছেন তার খোঁজ নিলেই সত্যতা বেরিয়ে আসত। সরকারের আমাদের বিষয়ে আরো একটু সংবেদনশীল হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। পাশাপাশি হিজড়াদের সবাইও খারাপ না। যারা তুলনামূলক খারাপ আচরণ করে তাদেরও এ ধরনের ব্যবহার পরিহার করা উচিত।
তবে পুলিশ বলছে, তারা চেষ্টা করছে হিজড়াদের নিয়ন্ত্রণ করতে। এক্ষেত্রে দ্রুত সাহায্য পেতে ৯৯৯ এ কল করার পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে পুলিশের সহযোগিতা নিতে হবে সাধারণ মানুষকে। এক্ষেত্রে তারা ৯৯৯ এ কল করে দ্রুত সেবা পেতে পারেন। বাসা বাড়িতে তারা চাঁদাবাজির জন্য আসলে এই হটলাইনে কল করলে দ্রুত পুলিশ পাঠানো সম্ভব হবে। তবে এমন অভিযোগ আমরা বেশ কিছু পেয়েছি।
প্রসঙ্গত, হিজড়া জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও আবহমান কাল থেকে এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সরকার ২০১৩ সালে হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সর্বোপরি তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদেরকে সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে সরকার নানান কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
২০১২-২০১৩ অর্থ বছর হতে পাইলট কর্মসূচি হিসেবে দেশের ৭টি জেলায় হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু হয়। এ ৭টি জেলা হলো: ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, খুলনা, বগুড়া এবং সিলেট। ২০১২-১৩ অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল ৭২,১৭,০০০(বাহাত্তর লক্ষ সতের হাজার) টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে নতুন ১৪ টি জেলাসহ মোট ২১টি জেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে এবং জেলাগুলো হচ্ছে ঢাকা, গাজীপুর, নেত্রকোনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, সিলেট।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৪,০৭,৩১,৬০০ (চার কোটি সাত লক্ষ একত্রিশ হাজার ছয়শ টাকা)। ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরের কর্মসূচির বরাদ্দ ৪,৫৮,৭২,০০০.০০ (চার কোটি আটান্ন লক্ষ বাহাত্তর হাজার) টাকা।
২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ৬৪ জেলায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৬৪ জেলায় বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ১১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা।২০১৯-২০ অর্থ বছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ৫,৫৬,০০,০০০/- (পাঁচ কোটি ছাপ্পান্ন লক্ষ) টাকা।
Leave a Reply