মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ পূর্বাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহি লঞ্চ এমভি অভিযান-১০ ট্র্যাজেডি থেকে স্বামীসহ দুইবছরের শিশু কন্যাকে নিয়ে বেঁচে ফিরেছেন ক্রীড়া সাংবাদিক মেহেরিনা কামাল মুন। সেই বিভীষিকা থেকে ফিরে ভয়াবহ ঘটনার অভিজ্ঞতার কথা তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তুলে ধরেছেন। লঞ্চ থেকে নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার পর পা মচকে আহত হওয়া ক্রীড়া সাংবাদিক মেহেরিনা কামাল মুন বর্তমানে বরগুনার শ্বশুড় বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি লিখেছেন-“অনেকেই জানতে চাচ্ছেন। একে একে বলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর বারবার বলা মানেই বারবার ওই মুহুর্তের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। এক কথায় যদি বলি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা বা মৃত্যু আসতে দেখা।
স্বামী রাজিব হোসেন ও দুইবছরের শিশু কন্যা আনিয়াকে নিয়ে ওইদিন (২৩ ডিসেম্বর) অভিযান-১০ লঞ্চের যাত্রী মুন বলেন, রাতে যখন ঘুমিয়ে পরি, তখন চিল্লাচিল্লি শুনে রুম থেকে বের হয়ে দেখি শুধু আগুন আর আগুন। এক সেকেন্ডও কোনো কিছু চিন্তা না করে কেবিনের রুমে ঢুকে মোবাইল আর বাচ্চাটা কোলে নিলাম। স্বামীসহ আমি দৌঁড়ে গেলাম লঞ্চের তিনতলার একেবারে সামনের দিকে। মাথায় ছিলো খোলা জায়গায় থাকতে হবে কিন্তু নামবো কীভাবে কোনো পথ পাচ্ছিলাম না। এইটুকু বাচ্চা নিয়ে তিনতলা থেকে পানিতে নামা মানে বাঁচার সম্ভাবনা কম। হঠাত করে দেখি ৪০-৫০ জন লোক পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে। আমরা ওপর থেকে সেটাও সাহস করতে পারিনি। আমি সবচেয়ে বেশি আতংকিত ছিলাম। কীভাবে নামবো এই বাচ্চা নিয়ে।
ওর বাবা বললো, পানিতে নামা লাগলেও নিচতলা থেকে নামবো। এরমধ্যে আমাদের সামনে এক নারী নিজের পরনের শাড়ি খুলে রেলিংয়ে বেঁধে নেমে গেলেন নিচের দিকে। সেই শাড়ি ঝুলছিল। আমার স্বামী রাজিব হোসেন ভাবলো ওই শাড়ি দিয়েই নামবে মেয়েকে নিয়ে। আমি আমার ওড়না দিয়ে মেয়েকে ওর বাবার কোমরে বেঁধে দিলাম। কারণ চিন্তা এলো হাতে নিয়ে নামলে যেকোনো সময় হাত ছুটে যেতে পারে। এসব করতে করতে তখন আগুন তিনতলায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি ভয়াবহ কালো ধোঁয়ার মধ্যে আগুনের হল্কা। মেয়ে শ্বাস নিতে পারছিলো না। মেয়ের বাবা নেমে গেলো। আমিও তার পেছনে নামলাম, কিন্তু দোতলা পর্যন্ত নেমে সেই শাড়ি শেষ। অন্ধকার ও ধোঁয়ায় রেলিং আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একলোক একটানে আমাকে নিচতলায় নামিয়ে আনলো। এরমধ্যে লঞ্চের অন্য পাশ থেকে লোকজন চিল্লাচ্ছে, ভাই আপনারা এদিকে আসেন, এপাশে আসেন, এদিকে মাটি আছে। পরে সেই ধোঁয়া ও অন্ধকারের মধ্যেই ওপাশে গিয়ে কোনো কিছু না ভেবেই লাফ দিলাম। কাঁদার মধ্যে পা আটকে মচকে গেলো। এরমধ্যেই পেছন দিকে লঞ্চের মধ্যে এক সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়েছে। ভাবছি, এক থেকে দেড় মিনিট দেরি হলে কী হতো জানি না। ক্রীড়া সাংবাদিক মেহেরিনা কামাল মুন বলেন, অনেক কিছু বলার, আসলে মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। সেই বিভিষিকাময় রাতের কথা মনে পরলে এখনও শিউরে উঠি। ভয়াবহ সেই রাতের অভিজ্ঞতা এখনও তাড়া করছে। হয়তো সারাজীবনই সেই রাতটি দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করবে।
বিআইডব্লিউটিএ’র অভিযান \ বরিশাল নদী বন্দরে ঢাকাগামী লঞ্চে অভিযান চালিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তারা। ২৯ ডিসেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে আটটার দিকে বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। তিনি (মোস্তাফিজুর রহমান) বলেন, সদর দপ্তরের নির্দেশে লঞ্চগুলোতে অভিযান চালানো হয়েছে। লঞ্চগুলোর সার্ভে সনদ, সবসরঞ্জাম যথাযথভাবে রয়েছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হয়েছে। এছাড়া সব লঞ্চেই রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তারা জানান, একইদিন বিকেলে ঢাকার সদরঘাটে অভিযান চালিয়ে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ঢাকা-বরিশাল রুটের অ্যাডভেঞ্চার-৯, স¤্রাট-২, ঢাকা-পটুয়াখালী (বগা) রুটের জামাল-৫, ঝালকাঠি রুটের ফারহান-৭, ঢাকা-তুষখালী রুটের পূবালী-৭, ঢাকা-হাতিয়া রুটের তাসরিফ-২ এবং ঢাকা-মেহেন্দিগঞ্জ রুটের ইয়াদ-২ লঞ্চ থেকে ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছেন। ভ্রাম্যমান আদালত ওইসব লঞ্চে তেলের লাইনে লিকেজ পেয়েছেন। এছাড়া লঞ্চগুলোর ইঞ্জিনের তাপ নিয়ন্ত্রণের পাইপে তাপনিরোধক আস্তরণ ছিলোনা। একটিতে কোন অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র অপরটিতে নেভিগেশন লাইট ছিলোনা।
অভিযান লঞ্চ জব্দ \ সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে আগুনের ঘটনায় দায়ের করা একটি মামলার আলামত হিসেবে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি জব্দ করা হয়েছে। ঝালকাঠি সদর থানার ওসি (তদন্ত) সাইফুল ইসলাম বলেন, লঞ্চের নিখোঁজ যাত্রীর এক স্বজনের দায়ের করা মামলায় লঞ্চটি জব্দ করা হয়েছে। ওসি আরও বলেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। তাদের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত লঞ্চটি ঝালকাঠি লঞ্চ টার্মিনালে থাকবে।
Leave a Reply