শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০৩ পূর্বাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল//যখন-তখন খসে পরছে পলেস্তরা। রান্নাঘরে অনায়াসে ঢুকে বাসা বাঁধছে ইঁদুর-মসুক। ঢুকে পরছে কুকুর-বিড়াল। দায়িত্বে যারা থাকছেন তারা কিছুক্ষণ পরপরই লাঠি নিয়ে সেসব প্রাণী তাঁড়াতে ছুটছেন। ধর-ধর, গেল-গেল শব্দে বেঁধে যায় এক লঙ্কাকান্ড। পুরো ভবনটি মেয়াদোত্তীর্ণ। বৃষ্টি নামলেই ঝুপঝুপ করে পানি ঝরে ছাদ চুঁইয়ে। নিরাপত্তার জন্য শক্ত কলাপসিবল গেইট নেই। আছে স্থানীয় বখাটেদের অবিরাম উৎপাত আর বিশ্রি পরিবেশ। চিকিৎসকরা নিরাপত্তাহীনতায় দুপুরের পর হাসপাতালে থাকতে পারেন না। রাত নামলে বখাটেদের জন্য হাসপাতালের সামনের ও ছাদের গেট খুলে দিতে হয় ডিউটিরত নার্সদের। মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমান পতিতা নিয়ে কেউ কেউ ছাদে চলে যান।
বাহ্যিক এই চিত্রটি হল বরিশালের একমাত্র বক্ষব্যাধী হাসপাতালের। অযত্ন-অবহেলায় প্রতিনিয়ত ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। এর দায়িত্বে সিভিল সার্জন থাকলেও তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি নিরাপত্তার জন্য দায় চাপন কাউনিয়া থানা পুলিশকে। আবার কাউনিয়া থানা পুলিশ বলছে, সেখানে কোন ধরণের নিরাপত্তাহীনতা নেই। নিরাপত্তাহীনতার কথাটি ‘সম্পূর্ণ ভূয়া’।
তবে দায়িত্বরত চিকিৎসক ও কর্মচারীরা সর্বদা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকেন বলে দাবী করেছেন বক্ষব্যাধী হাসপাতালের কর্মরতরা। তারা নিরাপত্তা চেয়ে কয়েক দফায় সিভিল সার্জনের কাছে আবেদন করেছেন। সিভিল সার্জন অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেসব আবেদন ফাইলবন্দী হয়েই আছে।
নগরীর আমানতগঞ্জে ১১ একর জমিতে ষাটের দশকে নির্মিত হয় বরিশাল বিভাগের একমাত্র বক্ষব্যাধি হাসপাতালটি। মাঠ, দীঘি আর গাছপালায় ভরা হাসপাতাল কমপ্লেক্সের পরে স্থাপিত হয়েছে ক্লিনিকও। বর্তমানে ২০ শয্যার হাসপাতালে ১৬টির মধ্যে ১২টি পদে কাগজে-কলমে লোক থাকলেও বাস্তবে রয়েছে এর চেয়েও কম। হাসপাতালে সহকারী নার্স পদে তিনজনের স্থলে একজনও নেই, রন্ধন শ্রমিক দু’টি পদের একটি শূন্য। ঝাড়ুদারের দু’টি পদের মধ্যে একজন ডেপুটেশনে সিভিল সার্জন অফিসে আর অন্যজন সদর হাসপাতালে কর্মরত। সব মিলিয়ে অনুমোদিত ১৬টি পদের ৬টিই শূন্য রয়েছে। সিনিয়র স্টাফ নার্সের তিনটি পদের স্থলে ডেপুটেশনে একজন আসায় একজন বেশি রয়েছেন।
পাশাপাশি অফিস সহকারীর পদ না থাকলেও সে পদে ১০ বছর আগে ডেপুটেশনে এসে দায়িত্ব পালন করছেন এক নারী। বরিশাল বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও ক্লিনিক যেন নিজেই বক্ষব্যাধীতে আক্রান্ত। হাসপাতালের বক্ষব্যাধি ক্লিনিকেও ১৭টি পদের বিপরীতে ১৪ জন কর্মরত। গুরুত্বপূর্ণ জুনিয়র কনসালট্যান্ট (টিবি অ্যান্ড লেপ্রোসি) ও সহকারী নার্সের একটি করে পদ থাকলেও সে দু’টি শূন্য রয়েছে। নার্সবিহীন ক্লিনিকে মাত্র একজন মেডিকেল অফিসার দিয়ে চিকিৎসা সেবা চলছে।
অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় চালকের পদটিও শূন্য। সরেজমিনে হাসপাতাল কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা গেছে, সংস্কারের অভাবে স্যাঁত স্যাঁতে ভবনের বিভিন্ন স্থানে পলেস্তারা খসে পড়ছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অভাবে গোটা হাসপাতালটি রুপ নিয়েছে ডাস্টবিনে। অফিস সহকারী মিসকাত জাহানের অভিযোগ, সুইপার ও গার্ড না থাকায় নোংরা ও অরক্ষিত থাকে হাসপাতাল কমপ্লেক্স।
মাদকসেবী-বখাটেদের উৎপাতে নারীদের রাতে হাসপাতাল কম্পাউন্ডে থাকাটাই দায়। হাসপাতালে দায়িত্বরত দুজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, নিরাপত্তা চেয়ে আমরা অনেক আবেদন করেছি। কাউনিয়া থানায় জিডিও করেছি। বাস্তবতা হল যখন জিডি করা হয় তখন কয়েকজন পুলিশ এসে ঘুরে যান। এরপর আবার পূর্বের অবস্থায় চলে যায় হাসপাতাল এলাকার পরিবেশ। ওই চিকৎসক দুজনের অভিমত, বরিশাল বিভাগীয় বক্ষব্যাধী হাসপাতালে যতটা প্রতিকূলতার মাঝে তারা দায়িত্ব পালন করেন তার দশ ভাগের একভাগও নিরাপত্তাহীন হয়ে দেশের কোন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করেন না।
সবসময় স্থানীয়দের হুমকি-ধামকির মাঝে থাকতে হয় তাদের। গরু ছাগল চড়ানো থেকে শুরু করে মাদক সেবনের আসর-সবই হয় হাসপাতালের এরিয়ায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কাগজ-পত্রে ৬ জন মহিলা ও ১ জন পুরুষ রোগী ভর্তির তথ্য থাকলেও বাস্তবে একজন নারী ও একজন পুরুষ রোগী চিকিৎসাধীন। আর বাকি শয্যাগুলো খালি পড়ে আছে। চিকিৎসাধীন বজলু খন্দকার (৬৫) বলেন, ২২ দিন ধরে এই হাসপাতালে আছেন। বিশাল কক্ষে তিনি একা। টয়লেটের দরজা ভাঙা। ওয়ার্ডে জানালার গ্লাস না থাকায় ভেতরে বাতাস ঢুকে পরে হু হু করে। বাইরে গাঁজাসেবীরা আসর বসালে তার কড়া গন্ধ ঢুকে হাসপাতালে থাকার পরিবেশই নষ্ট করে দেয়। কয়েকদিন আগে কয়েকজন গাঁজাসেবীকে হাসপাতালের পিছনে জানালার কাছে বসে গাঁজা সেবন করতে ‘না’ করেছিলেন তার পুত্র হানিফ। এর প্রতিক্রিয়ায় জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরে গাঁজার ধুঁয়া ছেড়ে হেসেছে সেবীরা।
ওদিকে হাসপাতালে ল্যাব না থাকায় বাইরে থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হচ্ছে। যাচ্ছে বাড়তি টাকা।
২০১৪ সালে নারী ও পুরুষ রোগীদের জন্য আলাদা এবং স্পেশালাইজড দু’টি এমডিআর কক্ষ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনও তা চালু হয়নি। ক্লিনিকে রয়েছে ল্যাবরেটরি, জিন এক্সপার্ট কক্ষ ও এক্স-রে মেশিন। ম্যানুয়াল পদ্ধতির এক্স-রে মেশিনটির জন্য বরাদ্দ কক্ষে রেডিয়েশন রোধক কোনো ব্যবস্থা নেই। পুরো ভবনের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে।
সীমিত জনবল দিয়েও হাসপাতাল ও ক্লিনিক মিলে ইনডোর ও আউটডোর সেবা চালু রয়েছে বলে জানান বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, বক্ষব্যাধী হাসপাতালের যে অপূর্ণতা তা সহজেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। শিশু হাসপাতালটি নির্মিত হলে সেখানে স্থানান্তর করার মাধ্যমে অনেকাংশের প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। নিরাপত্তার প্রশ্নে বলেন, ওই হাসপাতালটিকে নিরাপদে রাখতে পারে কাউনিয়া থানা পুলিশ। কিন্তু তারা তা করছে না।
নিরাপত্তার জন্য আমাদের আলাদা কোন বাহিনী নেই। আমরা হাসপাতাল পুলিশের জন্য চেষ্টা করছি। সেটি বাস্তবায়ন হলে আর অসুবিধা হবে না। তার আগে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে মূলত কাউনিয়া থানা পুলিশের অসহযোগীতার কারনে। এই কর্মকর্তা বলেন, নিরাপত্তাহীনতার কারনেই অনেকাংশ সেবা ব্যহত হচ্ছে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের।
যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাউনিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, নিরাপত্তাহীনতার কথাটি সম্পূর্ণ ভূয়া। তারা যখন দিনে দায়িত্ব পালন করেন তখন যদি কেউ অসুবিধা করে তাতো কেউ মুঠোফোনে হলেও জানায়নি। জানালে যদি পুলিশ না যেত তখন বলতে পারত পুলিশ অসহযোগীতা করছে। আনোয়ার হোসেন বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগীতার অভিযোগ দেশে একটি সহজ বিষয়। এটি প্যাশন হয়ে দাড়িয়েছে। বাস্তবতা হল আমি সেখানে নিজে পরিদর্শন করি। র্ফোস পাঠিয়ে ডিউটি করাই। মূলত যারা এই কথা বলছেন তারা ডিউটি ফাঁকি দেওয়ার জন্য মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন। ওসি দাবী করেন, এই সরকারের আমলে নিরাপত্তাহীনতার কথাটি কেউ বিশ্বাস করবেন না। এই কর্মকর্তা বলেন, বক্ষব্যাধী হাসপাতালে নিরাপত্তার কোন ঘাটতি নেই।
Leave a Reply