শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১১ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশে গত ছয় দশকের চলচ্চিত্রের গুণ ও পরিমাণগত মান ও বৈশিষ্ট্য বুঝতে হলে সময় কালকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথম ভাগে ১৯৫৬-১৯৬৬ সালের চলচ্চিত্র, দ্বিতীয় ভাগে ১৯৬৭-১৯৭১ সাল, তৃতীয় ভাগে ১৯৭২-১৯৮০ সাল, চতুর্থ ভাগে ১৯৮১-৯১ সাল, পঞ্চম ভাগে ১৯৯২-২০০০ সাল এবং ষষ্ঠ ও সর্বশেষ ভাগে ২০০১-২০১৬ সালের চলচ্চিত্র থাকবে।
১৯৭২-১৯৮০ সাল ভাগটি ঢাকার চলচ্চিত্রের গৌরবময় ও উজ্জ্বলতম অধ্যায়। স্বাধীনতা পরবর্তী এই সময়কালে বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বেশি প্রচার ও প্রসার লাভ করে। সেটা বাণিজ্যিক ও সমালোচক- দুই দৃষ্টিকোণ থেকেই। ১৯৭১ সালে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই ইপিএফডিসি নাম পরিবর্ত করে হয় ‘বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলভম্যান্ট কর্পোরেশন (বিএফডিসি)’।
এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বেশ কিছু উল্ল্যেখযোগ্য চলচ্চিত্র নির্মান হয়, যার মধ্যে চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’ অন্যতম। ‘ওরা ১১ জন’ স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। সদ্য যুদ্ধফেরত দুই তরুণ খসরু ও মাসুদ পারভেজ মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সময়কে সবার সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। এজন্য এমন একটি মাধ্যম খুঁজছিলেন তারা, যেটি একসঙ্গে দেশ-বিদেশি মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পৌঁছে দিতে পারবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছেও যা হয়ে উঠবে প্রামাণ্য দলিল। চাষী নজরুল ইসলামও এমন একটি ভাবনা মাথায় নিয়ে ঘুরছিলেন। এক পর্যায়ে এই তিনজন একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, চলচ্চিত্রই হতে পারে এমন মাধ্যম। আর এভাবেই নির্মাণ শুরু হয় ‘ওরা ১১ জন’।
চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত এ সিনেমায় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অভিনয় করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খসরু, মুরাদ, হেলাল ও নান্টু। ছবির প্রধান চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন- রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, হাসান ইমাম, আলতাফ, মুরাদ, নান্টু, বেবী, আবু, খলিলউল্লাহ খানসহ আরও অনেকে।
এই কালপর্বেই পরিচালনায় আসেন আলমগীর কবির, আব্দুল্লাহ আল মামুন, নারায়ন ঘোষ, শেখ নেয়ামত আলী, ঋত্বিক ঘটক (ওপার বাংলা), খান আতা, সুভাষ দত্ত, কবির আনোয়ার, আব্দুস সামাদ, প্রমুখ বিখ্যাত পরিচালকরা। সৃজনশীল নির্মাতা হিসেবে এই সময়ে তারা বেশকিছু শিল্পমানসম্পন্ন ছবি উপহার দিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘লাঠিয়াল’, ‘আলোর মিছিল’, ‘সুপ্রভাত’, ‘মেঘের অনেক রং’, ‘সারেং বউ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’। এসব ছবিতে তাদের বক্তব্য ও নির্মাণশৈলী শুধু দেশেই নয়; বিদেশেও প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়।
অন্যদিকে বাণিজ্যিক ধারার ছবির মধ্যে মুক্তি পায় কাজী জহিরের ‘অবুঝ মন’, ‘বধূ বিদায়’, মোস্তফা মেহমুদের ‘অবাক পৃথিবী’, মাসুদ পারভেজের ‘মাসুদ রানা’, আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমনি’, ইবনে মিজানের ‘নিশান’ ইত্যাদি। এসব ছবি বাণিজ্যধারায় অভিনবত্বের সূচনা করেন।
এই সময়ে ঢাকার চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার ও অনুদান প্রথার প্রচলন করা হয়। পাশাপাশি সূচনা পর্ব থেকে নির্মিত ছবিগুলোকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের জন্য ১৯৭৮ সালে ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করা হয়। দুই দশক অতিক্রান্ত চলচ্চিত্র অঙ্গণের জন্য যা ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ।
চলচ্চিত্রশিল্পী হিসেবে রাজ্জক, কবরী, শাবানা ও ববিতার পাশে এই দশকে সুচরিতা, আলমগীর, ফারুক ও উজ্জ্বলের মতো নায়ক-নায়িকার বিভিন্ন ছবিতে সপ্রাণ উপস্থিতি দর্শকদের হলমুখী করে তোলে। বিশেষত রাজ্জাক-কবরী, ববিতা-জাফর ইকবাল ও ববিতা-ফারুক জুটি শহর-গ্রাম উভয় শ্রেণির দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সত্তরে সদ্য শেষ হওয়া মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটও সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হয়ে ওঠে। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সুভাষ দত্ত পরিচালিত সিনেমা ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। কুসুমপুর গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ এবং প্রতিবাদে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে কেন্দ্র করে ছবিটি নির্মিত হয়। শতদল কথাচিত্রের প্রযোজনায় এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন, ববিতা, উজ্জ্বল প্রমুখ।
১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় আলমগীর কবির পরিচালিত ‘ধীরে বহে মেঘনা’, আলমগীর কুমকুম পরিচালিত ‘আমার জন্মভূমি’ এবং খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’। পরের বছর মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’, নারায়ন ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’। এসব ছবি দর্শকপ্রিয়তা পায় ও সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়।
এসবের পাশাপাশি অ্যাকশনধর্মী ছবি মুক্তির হিড়িক পড়ে যায়। যার সূত্রপাত হয় ১৯৭৩ সালে ‘রংবাজ’ ছবি মুক্তির মধ্য দিয়ে। অল্প সময়ে অ্যাকশন নির্ভর ছবির কদর বেড়ে যায়। দর্শকরা তখন ছবিতে বেশি বেশি অ্যাকশন দৃশ্য দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। যে ছবিতে যতো বেশি অ্যাকশন দৃশ্য, সে ছবি তত বেশি দর্শকপ্রিয়তা পেতে থাকে।
নিটোল, সামাজিক ও বক্তব্যধর্মী ছবির পাশাপাশি ফোক ফ্যান্টাসি ও আজগুবি কাহিনি নির্ভর পোষাকী ছবি তৈরির হিড়িক পড়ে যায় মধ্য সত্তর থেকে। একই সঙ্গে সামাজিক কাহিনী র্নিভর ছবি আসতে থাকে। এ সময় ভারতীয় হিন্দি ছবির অনুসরণে নির্মিত হতে থাকে বেশ কিছু বাংলা ছবি।
১৯৭৫ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার সামাজিক ছবি ‘লাঠিয়াল’ আলোড়ন তৈরি করে। ছবিটিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন, রোজী আফসারী, ফারুক, ববিতা। ছবিটির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে নারায়ণ ঘোষ মিতা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এরপর রাজেন তরফদারের ‘পালঙ্ক’, হারুনর রশীদের ‘মেঘের অনেক রঙ’, আলমগীর কবিরের ‘সূর্য কন্যা’, কবীর আনোয়ারের ‘সুপ্রভাত’, আবদুস সামাদের ‘সূর্যগ্রহণ’ এবং আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমনি’ বাংলা চলচ্চিত্রের ধারাকে পাল্টে দেয়।
১৯৭৭ সালে আলমগীর ‘কবিরের সীমানা পেরিয়ে’, সুভাষ দত্তের ‘বসুন্ধরা’ পরিচ্ছন্ন ছবি হিসেবে সমাদৃত হয়। শিল্প মানে সফল চলচ্চিত্র হিসেবে নন্দিত হয় ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ এবং আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘সারেং বৌ’। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার নির্মিত ‘সারেং বৌ’ ছবিতে আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে গাওয়া ‘ওরে নীল দরিয়া…’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রামের গল্প নিয়ে নির্মিত ছবিটিতে অভিনয় করেছেন ফারুক, কবরী, আরিফুল হক, জহিরুল হক, বিলকিস, বুলবুল ইসলাম, ডলি চৌধুরী প্রমুখ।
একই বছর মুক্তি পাওয়া ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবিটি পরিচালনা করেছেন আমজাদ হোসেন। ছবিতে অভিনয় করেছেন ববিতা, ফারুক, আনোয়ার হোসেন, রোজী সামাদ, আনোয়ারা, রওশন জামিল, এটিএম শামসুজ্জামান প্রমুখ।
স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্র ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ নির্মিত হয় ১৯৭৯ সালে। মসিউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর যৌথ নির্মাণে এটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে যায়। আবু ইসহাকের কালজয়ী উপন্যাস সূর্য দীঘল বাড়ী অবলম্বনে এটিই বাংলাদেশের প্রথম সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ছবিতে প্রধান প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন- ডলি আনোয়ার, রওশন জামিল, জহিরুল হক, আরিফুল হক, কেরামত মাওলা, এ টি এম শামসুজ্জামান।
Leave a Reply