শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩০ অপরাহ্ন
এম. কে. রানা,অতিথি প্রতিবেদক::স্বাধীনতার পূর্বে দক্ষিণাঞ্চলে শিল্প কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে বরিশালে বিসিক শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। কাজ শেষ হতে সময় লাগে প্রায় ২৮ বছর। ১৩০.৬১ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় বিসিক শিল্প নগরী। যাতে ৩৩৪টি উন্নত এবং ১১২টি অনুন্নত প্লটসহ মোট ৪৪৬টি প্লট রয়েছে। ইতিমধ্যে ১৭৩টি শিল্প ইউনিটের বিপরীতে ৩৭৮টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
কিন্তু নানামুখী সংকট ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে ১৭৩টি ইউনিটের মাত্র ৭২টি ইউনিট উৎপাদমুখী। তদুপরী অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, বেহাল সড়ক, অবকাঠামোগত অপর্যাপ্ততা, জলাবদ্ধতা, ড্রেনেজ অব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় উৎপাদনমুখী শিল্প কারখানার মালিকগণও রয়েছে দোটানায়। তবে উদ্যোক্তাদের মতে পায়রা বন্দর পুরোপুরি চালু হলে এ অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। বিসিক কর্মকর্তারা নিরাপত্তায় ঘাটতির কথা স্বীকার করলেও অন্যান্য অভিযোগ মানতে নারাজ।
সরেজমিন দেখা যায়, বিসিকের সীমানা প্রাচীর না থাকায় গরু-ছাগল যত্র-তত্র ঘোরাফেরা করছে। বিসিক অঞ্চলে নির্দিষ্ট সীমানা প্রাচীর না থাকায় বিভিন্ন সময়ে চুরির ঘটনাও ঘটছে। নির্দিষ্ট ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় রাস্তার ওপরেই পানি জমে আছে। সংস্কারের অভাবে অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে কাদার সৃষ্টি হয়েছে রাস্তার ওপর। চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলো।
বিসিকের একটি কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, এখানে যে বিসিক শিল্প নগরী, তা বোঝা যায় না। যেন গরু-ছাগলের চারণভূমি। সীমানা প্রাচীর না থাকার কারণে বাইরের গরু-ছাগল ভেতরে আসে। এগুলো দেখভাল করার কেউ নেই।
অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার কোনও উদ্যোগ কখনও নেয়নি। রাস্তাঘাট এবং আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল। ষাটের দশকে নির্মিত সড়কগুলোর বেশিরভাগই এখন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও চাহিদার তুলনায় খুবই কম। তাছাড়া যেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে তা পাওয়াও সহজসাধ্য নয়।
সবচেয়ে বড় সমস্যা মহাসড়ক কিংবা নদীবন্দর থেকে এ শিল্পনগরীর দূরত্বের বিষয়টি। মহাসড়ক এবং নদীবন্দর দূরে থাকায় এখানে উৎপাদিত শিল্পপণ্য সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে মালিকদের বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়। বর্তমানে এখানে চালু থাকা শিল্প কলকারখানাগুলোর মধ্যে খান সন্স টেক্সটাইল মিলস, বেঙ্গল বিস্কুট লিঃ, মোহাম্মদী ইলেকট্রিক প্রজেক্ট, সুগন্ধা ফ্লাওয়ার মিলস, আজমিরী খাজা বিস্কুট, বরিশাল আয়রন মিলসহ অন্য শিল্প ইউনিটগুলোও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। শুধুমাত্র ফরচুন সুজ কোম্পানীটি বেশ ভালভাবেই চলছে। এখানে তৈরীকৃত জুতা পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে রপ্তানী করা হয়।
এছাড়া কিছু কিছু প্লটে কারখানার নাম-ঠিকানা সম্বলিত প¬্যাকার্ড পুঁতে রাখলেও নেই কোনো কার্যক্রম। যুগ যুগ ধরে ওই সকল প্লটে শিল্প কারখানা স্থাপন করা না হলেও অজানা কারণে ওই সকল প্লটের বরাদ্দ বাতিল করেনি কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবী ব্যাংক ঋণসহ নানা জটিলতা থাকায় বরাদ্দ বাতিল করা সম্ভব হচ্ছেনা।
এদিকে বিসিক শিল্প নগরীতে শিল্প কারখানা স্থাপনের শর্ত থাকলেও একশ্রেনীর অসাধু লোক প্লট বরাদ্দ নিয়ে সেখানে দীর্ঘদিন যাবত পরিবার পরিজন নিয়ে আবাসস্থল গড়ে তুলেছে। কেউ বা আবার ঘর তুলে সেখানে ভাড়াটিয়া দিয়েছে।
স্থানীয় প্রবীন এক বাসিন্দা বলেন, দীর্ঘ বছর পূর্বে বিসিকে ঢুকলে মেশিনারির শব্দ পাওয়া যেত। এখন আর তা নেই। আজ কেবল সেগুলো স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশ এগিয়েছে ঠিকই কিন্তু বিসিকে নতুন কোন শিল্প কারখানা গড়ে না ওঠায় এমনটি হয়েছে।
বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি কারখানার মালিক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পূর্ণাঙ্গ শিল্পনগরী গড়ে না ওঠার মূল কারণ ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানা জটিলতা। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আওতায় এখানে বিদ্যুৎ এবং পানির বিলের ক্ষেত্রে তেমন কোনও সুযোগ-সুবিধাও পাওয়া যায় না। যে ৫০টি কারখানা চালু আছে সেগুলোর প্রতিদিন ৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। অথচ পাচ্ছে মাত্র ১ মেগাওয়াট। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ও আলাদা ফিডারের আওতায় এনে কারখানাগুলোকে নিয়মিত সচল রাখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিসিকের পরিবেশ বিভিন্ন কারণে শিল্প চালানোর জন্য অনুপোযোগী হয়ে উঠেছে। তাই স্থানীয় প্রশাসন, জনগণ ও সরকারের এই কুটির শিল্পের বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।
স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগ, বরিশাল বিভাগে শিল্প গড়ার দিকে সরকারও কখনো নজর দেয়নি। দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) হয়েছে। নতুন করে অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে, কিন্তু বরিশালে কিছুই হচ্ছে না। এমনকি বরিশালে যে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগর আছে, সেটিও অবহেলিত।
অবশ্য ভবিষ্যতে পটুয়াখালীতে পায়রা বন্দর পুরোপুরি চালু হলে এবং পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে বরিশালে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার আশা দেখছেন জেলার ব্যবসায়ীরা। পায়রা বন্দর চালু হলে এই অঞ্চলে পণ্যের কাঁচামাল পরিবহন সহজ হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ হলে বরিশালে পণ্য তৈরি করে তা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পাঠাতে সমস্যা দূর হবে। এতে বরিশালে বিনিয়োগ বাড়বে বলেও মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
এসব নিয়ে কথা হয় বরিশাল বিসিক শিল্পনগরী কর্মকর্তা মোঃ শাফাউল করিমের সাথে। তিনি বলেন, নিরাপত্তায় কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। তবে আগের তুলনায় এখন এখানে নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। এছাড়া পদ্মা সেতু ও পায়রা বন্ধরটি পুরোপুরি চালু হলে বরিশাল বিসিক হবে দেশের অন্যতম শিল্প নগরী। রাস্তাঘাটের বেহলা দশার প্রশ্নে তিনি বলেন, রাস্তাগুলো সংস্কারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলেন তিনি।
Leave a Reply