শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫২ অপরাহ্ন
আকতার ফারুক শাহিন॥ সিনিয়র সিটিজেন মাহমুদা বেগম। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন তাও প্রায় বছর ১৫ আগে। ১৯৭১ সাল থেকে বসবাস করছেন বরিশালে। ৭০ ছুঁই ছুঁই বয়সের মানুষটির জীবনের প্রায় পুরোটা সময় কেটেছে বরিশালে।
দীর্ঘ এ সময়ে কখনই পানি উঠতে দেখেননি বরিশাল শহরে। তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে টানা বৃষ্টির কারণে কিছু কিছু নিচু এলাকায় পানি জমলেও ঘণ্টা দেড়-দুয়েকের মধ্যেই তা নেমে যেত। কিন্তু এ বছর যেভাবে জোয়ারের পানিতে দিনে দু’বার করে ডুবছে নগরী- এমনটা আর কোনোদিন দেখিনি। শুধু নিুাঞ্চলই নয়, প্রধান প্রধান সড়কগুলোতেও বইছে জোয়ারের স্রোত। ’৮৮-এর বন্যায় যখন রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত তলিয়ে গেল তখনও কিন্তু খটখটে শুকনো ছিল বরিশাল। কিন্তু এখন কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না।
মাহমুদা বেগমের মতোই বিস্ময়ে হতবাক বরিশালের মানুষ। এ পরিস্থিতি যে সবার অচেনা। ৪২ বছরেরও বেশি সময় ধরে বরিশালের বাসিন্দা নগরীর বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট অমল সিং বলেন, ‘ভাটি অঞ্চলের দেশ বরিশাল। একদিকে আমরা সমুদ্রের খুব কাছে আর অন্যদিকে অসংখ্য নদ-নদী খাল-বিলে পরিপূর্ণ এ অঞ্চল। জোয়ার-ভাটার এ এলাকায় শহরাঞ্চলে পানি উঠতে পারে এটা আমরা কখনও দুঃস্বপ্নেও ভবিনি। অথচ সেটাই এখন বাস্তবতা। নগরীর এমন কোনো এলাকা নেই যা এখন দিনে দু’বার জোয়ারের উপচে পড়া পানিতে প্লাবিত হচ্ছে না। মানুষের বাড়িতে ঢুকছে পানি। খাটের উপর চুলা তুলে রান্নার কাজ করতে হচ্ছে। দুর্ভোগ এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। দেশের উত্তরাঞ্চলে বছরের এ সময়টাতে এভাবে বন্যার পানিতে ডোবা এবং দুর্ভোগ পোহানো স্বাভাবিক ঘটনা হলেও আমাদের জন্য রীতিমতো বিস্ময়কর।
শুধু বরিশাল নগরীই নয়, দিনে দু’বার করে জোয়ারের পানিতে ডুবছে পুরো দক্ষিণ উপকূল। জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ছে বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠী এবং পিরোজপুরসহ প্রায় সব জেলা শহরে। পটুয়াখালী শহরের অবস্থা তো আরও করুণ। সেখানে শহর রক্ষা বাঁধ উপচে ঢুকছে পানি। দক্ষিণাঞ্চলের আরও বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে পাওয়া গেছে এভাবে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢোকার খবর। গত ৩-৪ দিন ধরেই চলছে এ অবস্থা। এর আগে গেল মাসের শেষের দিকে আরও একবার অস্বাভাবিক উঁচু জোয়ারের পানিতে দক্ষিণের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হলেও তখন জলমুক্ত ছিল বরিশাল নগরী। কিন্তু এবার আর সেই রক্ষা হয়নি। বৃহস্পতিবার বিকালে নগরীর প্রধান সড়ক সদর রোডে বইতে দেখা গেছে জোয়ারের স্রোত।
একই অবস্থা ছিল ভাটিখানা, নবগ্রাম, আমানতগঞ্জসহ আরও অনেক এলাকায়। স্রোত না বইলেও নিমজ্জিত হয়েছে নগরীর অন্যান্য এলাকা। কিছু কিছু জায়গায় সৃষ্টি হয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। সবচেয়ে করুণ অবস্থা নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোর। নগরীর পলাশপুর এলাকার বহু ঘর-বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দিনে দু’বার করে ডুবছে হাঁটু এমনকি কোমরপানিতে। স্মরণাতীতকালের রেকর্ড ভেঙে এভাবে জোয়ারের পানিতে বরিশালসহ সমগ্র দক্ষিণ উপকূল প্লাবিত হওয়ার ব্যাখ্যায় মৌসুমি বায়ুর প্রভাব, উজান থেকে নামতে থাকা বন্যার পানি এবং অস্বাভাবিক উঁচু জোয়ারের কথা বলছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্মকর্তারা। পাউবোর বরগুনা-পটুয়াখালী অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মজিবর রহমান বলেন, ‘শুক্রবার বরগুনা অঞ্চলে বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে ছিল সর্র্বোচ্চ জোয়ার। এ সময় পানির উচ্চতা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫৪ মিটারে। গত ক’দিন ধরেই এমন উচ্চতার জোয়ার আসছে নদীতে। লঘুচাপের প্রভাব এবং সঞ্চালনশীল মৌসুমি বায়ুর কারণে সাগরেও জোয়ার আসছে উঁচু হয়ে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে উত্তরাঞ্চল থেকে নামতে থাকা বন্যার পানি। এসব কারণেই মূলত উপচে উঠা পানিতে প্লাবিত হচ্ছে নিুাঞ্চল।
এপ্রসঙ্গে বরিশালের পরিবেশ ফেলো মুরাদ আহম্মেদ বলেন, ‘২০০৫ সালে ৩ দশমিক ৫১ এবং ২০০৬ সালে ৩ দশমিক ৯৬ মিটার উচ্চতার জোয়ার হয়েছিল বরিশাল অঞ্চলের প্রধান নদ-নদী বিষখালী-পায়রা এবং বলেশ্বরে। কিন্তু তখনও এভাবে প্লাবিত হয়নি দক্ষিণাঞ্চল। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। গত ২-৩ বছর ধরে ঘটছে এটা। এর আগে এমনটা আর কখনও হয়নি। গবেষণায় দেখা গেছে যে, গত ৫০ বছরে সাগর এবং নদ-নদীর জোয়ারের উচ্চতা পূর্বের তুলনায় গড়ে ২ থেকে আড়াই ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই পূর্ণিমার প্রভাবে উপকূলে ৩ দশমিক ৬২ মিটার উচ্চতার জোয়ারের রেকর্ড রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। এ উচ্চতা নদী তীরের বাঁধের প্রায় সমান। ঘূণিঝড়কেন্দ্রিক জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতাও ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব কারণে কার্যকারিতা হারাচ্ছে বাঁধ। বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে আগে যেটা দরকার তা হল বেড়ি বাঁধগুলোর উচ্চতা বৃদ্ধি। এর সঙ্গে গবেষণা করে দেখতে হবে যে কেন এভাবে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। নদীর তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেও এমনটা হতে পারে। তবে যথাযথ গবেষণা আর পরীক্ষা-নীরিক্ষা না করে কিছুই বলা বা করা ঠিক হবে না।
এসব বিষয় নিয়ে আলাপকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশাল অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শফিউদ্দিন বলেন, ‘স্বাভাবিক জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি আমরাও লক্ষ্য করেছি। নদ-নদীগুলোর নাব্য হ্রাসের কারণেও এমনটা হতে পারে। পটুয়াখালীতে বেড়িবাঁধ উপচে শহরে পানি ঢোকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হয়তো এটা হয়েছে। বরিশাল অঞ্চলে এমন বহু বাঁধ রয়েছে যেগুলো গত ১৫-২০ বছরেও মেরামত করা হয়নি। পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে বহু বাঁধের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। স্বাভাবিক নিয়মেই বহু ব্যবহারে এগুলোর উচ্চতা কমেছে। এ কারণেই বাঁধ উপচে পানি ঢুকছে।
এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বরিশাল নগরীসংলগ্ন কীর্তনখোলা নদী তীরে রক্ষা বাঁধ নির্র্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তাছাড়া নদ-নদী এবং সাগরের জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়ে ৮শ’ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ একটি প্রকল্প নিয়েছে সরকার। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কোস্টাল অ্যামব্যাংকমেন্ট ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্ট নামে এ প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনা এবং বাগেরহাট এলাকার সাগর তীরবর্তী বাঁধগুলো উঁচু করে নির্মাণ করা হবে। এ প্রকল্প সফল হলে পর্যায়ক্রমে তা সারা দেশে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।
হিজলা প্রতিনিধি জানান, বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে মেঘনার পানি। উপজেলার নিুাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সিংহভাগ এলাকা পানির নিচে ডুবে গেছে। হরিনাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান আ. লতিফ খান জানান, তার ইউনিয়নের হরিনাথপুর এলাকার কিঞ্চিৎ এলাকা বাদে পুরো এলাকা পানির নিচে। মেমানিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার নাসির উদ্দিন, হিজলাগৌরব্দী ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মিলন, ধুলখোলা ইউপি চেয়ারম্যান মকবুল আহম্মেদ মিয়া জানান, অমাবস্যার জোয়ারের প্রভাব এবং বাতাসের প্রভাবে দিনের ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা তিনটি ইউনিয়ন পুরো পানির নিচে চলে যায়। এ অঞ্চলের মানুষের জীবযাত্রা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে থাকতে হয় তার এলাকার লোকজনদের। এদিকে বেপরোয়া পানি বৃদ্ধি এবং মেঘনার স্রোতে ভেসে গেছে উপজেলাসংলগ্ন বাউশিয়া, বাহেরচর, পুরাতন হিজলা, দুর্গাপুর। উপজেলা সদর টেকের বাজারে পানি ঢুকে পড়েছে।
হিজলা উপজেলা পল্লী বিদ্যুতের সাব জোনাল অফিসের জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার আ. হালিম জানান, ৮নং বাউশিয়া এলাকায় মাত্র এক সপ্তাহে ১ থেকে দেড় কিলোমিটার পল্লী বিদ্যুতের লাইন মেঘনায় বিলীন হয়েছে। বেপরোয়া ভাঙন ও জোয়ারের তোড়ে ভেসে গেছে তাদের বেশ কিছু খুঁটি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার বকুলচন্দ্র কবিরাজ জানান, অমাবস্যা এবং বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের কারণে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপজেলার নিুাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সব ইউনিয়নের আশ্রয়ন কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বিপদ মোকাবেলায় সজাগ দৃষ্টি রাখতে চেয়ারম্যানদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।
Leave a Reply