বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২৭ পূর্বাহ্ন
সৈয়দ মেহেদী হাসান॥ সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার খয়রাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূরে আলমকে বহিস্কার করেছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রাণয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ। বহিস্কারাদেশে বির্তকিত ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সরকারি চাল আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় সরকার এই সিদ্ধান্ত নেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে ওই ইউনিয়নের দুইজন ইউপি সদস্যকে চাল চুরির দায়ে গ্রেফতার ও জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালত কারাদন্ড প্রদান করেন। অত্যান্ত প্রতাপশালী এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে অনেক অনিয়মের খবর বেরোলেও সবাই চুপ ছিলেন। এমনকি দলের সুনাম ক্ষুন্ন করলেও কেউই নূরে আলমের অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলেননি। সেই সুযোগে চেয়ারম্যানের সাথে জুটে যায় কতিপয় অসাধু ইউপি সদস্য। তার এই সাঙ্গপাঙ্গদের কারেন কেদারপুর ইউনিয়ন ছিল অনিয়মের স্বর্গরাজ্য।
লোকমুখে কথা ওঠে, ‘ত্রাণ যা পায়/ চলে যায় নূরে আলমের চিতায়’।
কিন্তু ছাড় দিলেন না বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান। সকল বাধা উপেক্ষা করে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে দৃঢ় ছিলেন তিনি। আর তাই লেজ গুটাতে হয়েছে প্রতাপশালী দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট নূরে আলম বাহিনীকে। ইতিমধ্যে নূরে আলম পালিয়েছেন। কিন্তু রক্ষা হয়নি। তার বিরুদ্ধে ঠুকে দেওয়া হয়েছে মামলা। সহযোগী দুইচোরকে নিক্ষেপ করা হয়েছে কারাগারে।
বাবুগঞ্জ উপজেলাবাসী বলছে, নূরে আলমের অনিয়মের শাস্তি হতো না যদি জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান জিরো টলারেন্স নীতি না গ্রহণ করতেন। তিনি শক্ত অবস্থানে ছিলেন বিধায় চালচোর সিন্ডিকেট এখান থেকে বিদায় নিচ্ছেন। পাশাপাশি অন্য যারা গরিবের প্রাপ্য লুটপাট করে খাওয়ার চিন্তায় ছিলেন বা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারাও শুধরে গেছেন।
বাবুগঞ্জ উপজেলার একটি কলেজের সহকারী অধ্যাপক আব্দুর রশিদ বলেন, আমরা সৌভাগ্যবান যে দুঃসময়ে এসএম অজিয়র রহমানের মতন সৎ, নির্লোভ একজন সরকারী কর্মকর্তা পেয়েছি।
পূর্ব অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে ওই শিক্ষক বলেন, এটি বরিশালবাসীর জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে দুর্নীতিবাজদের নিশ্চহ্ন করতে পারেন। জেলা উপজেলায়তো অনেক প্রতাপশালী নেতা, রাজনীতিবিদ আছেন; তারা কিন্তু গরিবের হক পূরণে শক্ত হাতে দাড়াননি। কেউ নির্দেশনাও দেননি যে, করেনার সময় মানুষ না খেয়ে থাকতে পারে। দুর্নীতি করা যাবে না। বরংছ আমরা শুনেছি নূরে আলমকে রক্ষা করতে অনেক নেতা ম্যানেজ মিশনে নিমেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেলা প্রশাসক অনমনীয় থাকায় দুর্নীতিবাজকে আইনের আওতায় আসতে হলো।
কেদারপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মোহেবুল্লাহ বলেন, জেলা প্রশাসক সাহেবের দুর্নীতি বিরোধী অবস্থানের আলোচনা গোটা বাবুগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি শুধু সরকারি কর্মকর্তা নন, এখন অসহায় মানুষের অভিভাবক হয়ে গেছেন।
শুধু যে বাবুগঞ্জ উপজেলা তা কিন্তু নয়; বানারীপাড়ায় রচিত হয়েছে আরও বড় ইতিহাস। অত্যান্ত প্রতাপশালী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব চালচুরি করায় ছাড় দেননি জেলা প্রশাসন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি একেএম ইউসুফ আলী ২৫৬ বস্তা সরকারী চাল আত্মসাত করায় ৬ মাসের কারাদন্ড প্রদান করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। জেলা প্রশাসনের কর্মকান্ড আর জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমানের সুনাম আরও ছড়িয়ে পড়ে এই রাঘববোয়াল চালচোরকে কারাদন্ড প্রদানের মাধ্যমে। তাছাড়া অন্য উপজেলা, যেমন মেহেন্দীগঞ্জ, হিজলা, মুলাদী, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল সদর, গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর এবং বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে সর্বাত্মক তৎপরতা চালাচ্ছে জেলা প্রশাসন।
এসব ঘটনার প্রভাবে দুর্নীতিবাজ ও তাদের প্রশ্রয়দাতাদের মুখে চুনকালী পড়েছে। সঠিকভাবে ত্রাণ পাচ্ছেন জেলার মানুষ। শুধু যে ত্রাণ চোর, অনিয়মকারীদের পিছু হেটেই কার্যক্রম শেষ করছেন না অজিয়র রহমান। উজার করে দিচ্ছেন গরিবদের জন্য। সরকারি বরাদ্দের শতভাগ যেন অসহায়ের ঘরে পৌঁছে সেজন্য করছেন সার্বিক পর্যবেক্ষণ।
দায়িত্ব নিয়েছেন সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি গরিব মানুষকে সহায়তা পৌঁছে দিতে। এজন্য সিটি কর্পোরেশনকে বরাদ্দ দিয়েছেন ২৬০ মেট্রিকটন চাল। এছাড়া নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়ের জন্য নগদ পাঁচ লাখ ৩০ হাজার টাকা প্রদান করেছেন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে।
জেলা প্রশাসনের বরাদ্দ পেয়ে সেগুলোই সিটি কর্পোরেশনের নামে নগরবাসীর মধ্যে বন্টন করছেন সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এছাড়া প্রতিনিদনই করোনা প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করতে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে অজিয়র রহমান। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, করোনার প্রার্দুভাব বরিশালে পৌঁছা থেকে অদ্যবধি একটু সময়ের জন্য এই একটি মানুষের তত্ত্বাবধান ছাড়া কিছু হয়নি। তিনি শারীরীক দিক থেকে ক্লান্ত হয়েছেন; কিন্তু করোনা যুদ্ধে মানসিক দিক থেকে কখনো ক্লান্তি ছোঁয়নি। ফলে ১০ উপজেলার প্রশাসন অদম্য; কাজ করে যাচ্ছেন।
যদিও নিজের কাজের বিষয়ে এখনি মন্তব্য করতে রাজি নন জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান। এককথায় তিনি মনে করেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে তিনি তিনি দায়িত্ব পালন করছেন।
সিনিয়র সাংবাদিক ও সংস্কৃতিজন সাইফুর রহমান মিরন মনে করেন, একজন অজিয়র রহমান বরিশালের জন্য যা করে চলেছেন সেটা কেবল অনন্যই নয়, অনেক ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত। করোনা ঝুঁকি থাকার পরও তিনি সর্বত্র ছুটে চলছেন। স্বাস্থ্য ঝুঁকির পরও কেবল ত্রাণ দিয়ে নাগরিকদের পাশে থাকছেন তা নয়। তিনি স্বশরীরে উপস্থিত হচ্ছেন করোনা ঝুঁকি কমাতে কার্যক্রম নিয়ে। কখনো রাস্তায় স্প্রে দিয়ে জীবানুনাশক ছিটাচ্ছেন, কখনো আবার চিকিৎসকদের জন্য পিপিই সরবরাহ করছেন। কখনো ছুটে যাচ্ছেন করোনা ল্যাবের সার্বিক বিষয় জানতে। কখনো আবার নাগরিকদের সতর্ক ও সচেতন করতে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনায়। তাঁর জীবনের ঝুঁকিকে পাশে রেখে বিরামহীনভাবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তিনি অতন্দ্র প্রহরীর মত বরিশালবাসীর জন্য নিবেদিত। এটা বলতে আরকোন শঙ্কা নেই, এসএম অজিয়র রহমান প্রকৃতপক্ষেই বরিশালবাসীর একজন অভিভাবক।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ২২ এপ্রিল পর্যন্ত জেলায় ত্রাণ সহায়তা পেয়েছেন ১ লাখ ৪০ হাজার ৩৩৪টি অসহায় ও কর্মহীন পরিবার। জনপ্রতি ১০ কেজি করে মোট ১৪শ ৩ দশমিক ৩৪ মেট্রিকটন চাল বিতরণ করা হয়েছে এসব মানুষের মাঝে। এছাড়াও তাদের মাঝে ত্রাণ সহায়তা স্বরূপ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় বাবদ নগদ ৬২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা এবং শিশু খাদ্য বাবদ ১ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা খরচ করেছে জেলা প্রশাসন। বরিশাল সিটিসহ ১০ উপজেলায় এসব ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হয়।
হিসেব বলছে, বরিশাল সদর উপজেলায় ২৬ হাজার ২০০টি পরিবারের মাঝে ২৬২ মেট্রিকটন চাল, বাকেরগঞ্জ উপজেলায় ১৪ হাজার ৭০০ পরিবারকে ১৪৭ মেট্রিকটন চাল, হিজলা উপজেলায় আট হাজার ১০০টি পরিবারের মাঝে ৮১ মেট্রিক টন চালসহ নগদ চার লাখ ৯৩ হাজার, বাবুগঞ্জ উপজেলায় আট হাজার ৪০০ পরিবারের মধ্যে ৮৪ মেট্রিক টন চালসহ নগদ ৪ লক্ষ ৯৩ হাজার টাকা, উজিরপুর উপজেলায় ১১ হাজার ২০০টি পরিবারকে ১১২ মেট্রিক টন চালসহ নগদ ৫ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়। বানারীপাড়া উপজেলায় ১০ হাজার ৪০০টি পরিবারের মাঝে বিতরণ করা হয় ১০৪ মেট্রিক টন চালসহ নগদ ৫ লক্ষ ১৭ হাজার টাকা। আগৈলঝাড়া উপজেলার আট হাজার ২০০টি পরিবারের মাঝে ৮২ মেট্রিক টন চালসহ নগদ ৪ লক্ষ ৮৫ লাখ, গৌরনদী উপজেলায় দশ হাজার ২০০টি পরিবারের মধ্যে ১০২ মেট্রিক টন চালসহ নগদ ৫ লক্ষ ৯ হাজার টাকা ও শিশু খাদ্য বাবদ ৬০ হাজার টাকা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার ১২ হাজার পরিবারের মাঝে ১২০ মেট্রিক টন চাল বিতরণসহ নগদ ৫ লক্ষ ৭৩ হাজার টাকা ও ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা শিশু খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
Leave a Reply