শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০১ পূর্বাহ্ন
আলম রায়হান
তিন সিটি নির্বাচনের ভোট গ্রহণ ৩০ জুলাই। এক অর্থে দরজায় কড়া নাড়ছে বহুল প্রতীক্ষিত দিনটি। এদিকে সিলেট ও রাজশাহীকে ছাড়িয়ে অন্যরকম আলোচনার কেন্দ্রে আছে বরিশাল। আরও পরিষ্কার করে বলা চলে, সব আলোচনার সিংহভাগই আবর্তিত হচ্ছে দক্ষিণবঙ্গের সিংহপুরুষ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর পুত্র সাদিক আবদুল্লাহকে কেন্দ্র করে। প্রায় সর্বত্রই একই প্রশ্ন, কী হবে সাদিকের?
মেয়র পদপ্রার্থী ছয়জনের মধ্যে একজনকে নিয়েই আলোচনা ও সব জল্পনা-কল্পনা আবর্তিত হচ্ছে। আর কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে অন্যরকম আলোচনায় আছেন একজন, যার একমাত্র প্রতিশ্রুতি হলো ২২ নং ওয়ার্ডকে মাদকমুক্ত করা। অথচ তিনি নিজেই মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে নগরীতে পরিচিত। মাদকসহ তিনি ধরাও পড়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। ওই ছবি বরিশালের বহুল প্রচারিত দৈনিক ‘আজকের পরিবর্তন’-এ ছাপা হয়েছে। এরপরও তিনি সাবেক এক প্রতিমন্ত্রীর কাছের লোক পরিচয় দিয়ে মাদক ব্যবসা চালাচ্ছেন এবং নির্বাচিত হলে এলাকা মাদকমুক্ত করার কথা বলছেন। এ কারণে সিটি নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনায় অনেককেই ছাড়িয়ে গেছেন এই কাউন্সিলর পদপ্রার্থী।
তবে সব আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন মেয়র পদপ্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। স্থানীয় পর্যবেক্ষক মহলের মতে, ৭৫-এর শহীদ পরিবারের সন্তান বলেই তাকে প্রতিরোধে নিরন্তর চেষ্টা চলছে। আর একই কারণে তাকে নিয়ে এত আলোচনা, করা হচ্ছে সমালোচনাও।
স্বাধীনতাবিরোধীদের কারসাজিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেই রাতে ঘটনাচক্রে বেঁচে যান আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। যদিও তিনি সেদিন পিতা-পুত্রÑভগ্নিসহ হারিয়েছেন অনেক স্বজন। এর পরও তাকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বরিশালের রাজনীতিতে তাকে মানতে পারছে না শুরু থেকেই। এ কারণেই তাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে প্রতিবারই তিনি বেঁচে গেছেন অনেকটা অলৌকিকভাবে। এরপরও অপশক্তির আশা ছিল, কালের পরিক্রমায় বরিশালে হাসানাত যুগের অবসান ঘটবে। কিন্তু সাদিক আবদুল্লাহ আদাজল খেয়ে রাজনীতিতে নেমে পড়ায় ইকোয়েশনে অন্য মাত্রা যুক্ত হয়ে যায়।
এরপরও স্বাধীনতাবিরোধীরা ভেবেছিল, সাদিক বাচ্চা ছেলে; রাজনীতির মাঠে ছোটাছুটি করা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে তার কর্মকা-! কিন্তু এই ভাবনায় বড় রকমের ঝাঁকুনি দেয় সাদিকের সাংগঠনিক দক্ষতা, অকল্পনীয় পরিশ্রম করার ক্ষমতা ও বিনয়। বিরুদ্ধপক্ষের উদ্বেগ আরও বেড়ে যায় বরিশাল সিটি নির্বাচনে সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ায়। এর ওপর বরিশাল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের সব নেতা-কর্মী আন্তরিকভাবে সাদিকের পাশে দাঁড়ানোর ঘটনায় বিরুদ্ধপক্ষের উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। এ অবস্থায় সাদিককে ঠেকাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে ৭৫-এর থিংক ট্যাংক।
রাজনীতিতে নবাগত সাদিক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে বিএনপি থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় মুজিবুর রহমান সরোয়ারের মতো বর্ষিয়ান নেতাকে। যিনি অর্থ-বিত্ত, সাংগঠনিক ক্ষমতা ও মাসল পাওয়ারের বিবেচনায় রয়েছেন শীর্ষে। বরিশালের মানুষ তাকে ঝানু নেতা হিসেবেও চেনে, যিনি বেড়ে উঠেছেন একেবারে গ্রাসরুট থেকে, নিজের যোগ্যতায়। নির্বাচনের কৌশলী নেতা হিসেবেও তাকে বিবেচনা করা হয়। আবার বরিশাল সদরে তার নিজেরই নির্বাচনী অভিজ্ঞতা রয়েছে অন্তত পাঁচবারের। এ কারণে তিনি ভোটারদেরও যেমন চেনেন, তেমনি জানেন নির্বাচনের অন্ধ অলিগলি। কিন্তু এবার হয়তো তার বিধিবাম!
পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র পদপ্রার্র্থী না হলে বিএনপি মুজিবুর রহমান সরোয়ারকে প্রার্থী করত না। বরিশাল সিটির মেয়র পদ দখল করা বিএনপির জন্য যত না প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হলো সাদিককে ঠেকিয়ে বরিশালে হাসনাত যুগের অবসান ঘটানো; যে রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মাধ্যমে। নানান সংকট মোকাবিলা করে এ ধারা সমুন্নত রেখেছেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। আর এ ধারা অব্যাহত রাখার দায়িত্ব নেয়ার জন্য প্রস্তুত সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। এটিই স্বাধীনতাবিরোধীদের নেপথ্য শক্তি ৭৫-এর থিংক ট্যাংকের গভীর উদ্বেগের বিষয়। ফলে মুজিবুর রহমান সরোয়ারের মতো হ্যাভিওয়েট নেতাকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের শরিক দল জাতীয় পার্টিও শক্ত প্রার্থী দিয়েছে। বিষয়টি অনেকের বিবেচনায় রহস্যজনক। তবে ভোটের হিসাবে জাতীয় পার্টির লাঙ্গলের প্রার্র্থী ইকবাল হোসেন তাপস যেটুকু ক্ষতির কারণ হবেন সাদিক আবদুল্লাহর, তার চেয়ে মুজিবুর রহমান সরোয়ারের জন্য অনেক বেশি মহা-উদ্বেগের কারণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন চরমোনিাই পীরের ইসলামী শাসনতন্ত্রের হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী ওবাইদুর রহমান মাহবুব।
মুজিবুর রহমান সরোয়ারের সঙ্গে চরমোনাইর পীরের বিরোধিতা কেবল রাজনৈতিক নয়, ব্যক্তিগতও। একেবারে সাপে-নেউলে সম্পর্ক! চরমোনাইতে একবার এই পীরের বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছিলেন জনাব সরোয়ার। তার একাধিক দাঁতও ভেঙে গিয়েছিল। সেদিন তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও তার অবস্থা খুবই শংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। তাকে দীর্ঘদিন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। সূত্রমতে, পীর পরিবারের সঙ্গে সরোয়ারের সেই বিরোধের দৃশ্যত অবসান হলেও ভেতরে জ্বলছে তুষের আগুনের মতো।
এদিকে মেয়র পদপ্রার্থী হিসেবে অন্যরকম উচ্চতায় আছেন বাসদের ডা. মনীষা চক্রবর্তী। তার মই মার্কা সবার ভোট ব্যাংকেই ভাগ বসাবে; ইসলামী আন্দোলন ছাড়া। তবে রাজনৈতিক স্পষ্ট বিভাজনের বাস্তবতায় ডা. মনীষা খুব বেশি উদ্বেগের কারণ হয়তো কারও জন্যই নন এবারের নির্বাচনে। তবে বরিশালের রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ নির্বাচনে তিনি বড় রকমের ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবেন বলে মনে করছেন বরিশালের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।
আর সিপিবির মেয়র পদপ্রার্থী অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ খুবই সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। কিন্ত তার কাস্তে দিয়ে কার ভোট কতটুকু কাটতে পারবেন তা কেউই তেমন ধর্তব্যের মধ্যে নিচ্ছেন না। এর চেয়ে করুণ অবস্থা স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী বশির আহমেদ ঝুনুর। নগরবাসীর ধারণা, ভোটের মাঠে তার হরিণ দাঁড়াতেই পারবে না, দৌড়ানো তো অনেক পরের হিসাব। কেউ কেউ রসিকতা করেন, এই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে কচ্ছপ প্রতীক দিলে তা যথার্থ হতো!
সব মিলিয়ে নানা ইকোয়েশনে খুবই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। তবে সবকিছু ওলটপালট করে দিতে পারত ১৪ জুলাই বরিশাল সদরঘাটে ঢাকাগামী লঞ্চের রহস্যজনক ঘটনা। সেদিন পুলিশ বিচক্ষণতা ও অসীম ধৈর্যের পরিচয় না দিলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকত তা বলা কঠিন। আর তা কোনো অবস্থাতেই সাদিক আবদুল্লাহ অথবা আওয়ামী লীগের পক্ষে যেত না।
সূত্রমতে, সেদিন একাধিক লক্ষ্য হাসিলের নীলনকশার নাটক করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ লক্ষ্য ছিল, সাজানো নাটকের কাভারেজে বিএমপির ভারপ্রাপ্ত কমিশনার মাহফুজুর রহমানকে সরিয়ে দেয়া। নিদেনপক্ষে নির্বাচনের আগেই তার মাথার ওপর শূন্য পদে কাউকে বসানো। কিন্তু নেপথ্য খেলোয়াড়দের এই লক্ষ্যও পূরণ হয়নি। ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমানকে সরিয়ে দেয়া হয়নি। বিএমপি কমিশনারের শূন্য পদে মোশাররফ হোসেনকে পদায়নের জন্য সব আনুষ্ঠানিতা সম্পন্ন হলেও তাকে বরিশালে এখনই পাঠানো হচ্ছে না। তাকে বরিশাল পাঠানো হবে সিটি নির্বাচনের পরে। ফলে সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার কঠিন দায়িত্ব ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমানকেই পালন করতে হবে। আর তিনি দক্ষ ও কঠিন কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশ বিভাগে পরিচিত। এদিকে সিভিল প্রশাসনে জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমানের পরিচয়ও এরই মধ্যে পেয়েছে বরিশালবাসী। উল্লেখ্য, নির্বাচনে জেলা প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়, প্রধান!
তবে উদ্বেগের দিকও আছে। অনেকের ধারণা, ১৪ জুলাইয়ের ঘটনায় বরিশাল পুলিশের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে তাকে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনারের কাজকে কিছুটা হলেও জটিল করে দিয়েছে। এর পরও তার সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাস বা মাসল পাওয়ার শো করার কারও কোনো পরিকল্পনা থাকলে তা মোটেই সহজ হবে না বলে ধারণা অভিজ্ঞ মহলের। আর তা সামগ্রিক বিচারে সাদিক আবদুল্লার জন্য সুবিধাজনক অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
বিভিন্ন শক্তিকেন্দ্রের ইতিবাচক অবস্থানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রায় দুই বছর ধরে সাদিকের সাংগঠনিক কর্মকা-। আর নির্বাচনী প্রচারণায় সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার অভাবনীয় সাফল্য সবার নজর কেড়েছে অনেক আগে। সামগ্রিক অবস্থার বিচারে বরিশালের পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, হয়তো সাদিক আবদুল্লাহর পরিশ্রম বৃথা যাবে না। এবং এবার বরিশালের সিটি নির্বাচনে বড় রকমের হোঁচট খাবে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির নেপথ্য কুশীলবরা।
আলম রায়হান: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
Leave a Reply