শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২০ পূর্বাহ্ন
প্রিন্স তালুকদার: কোন কিছুতেই যেন থামছে না বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার সর্বনাশা সুগন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গন। নদীবেষ্টীত উপজেলার চারিদিকে শুধু ভাঙ্গনের শব্দ। সর্বগ্রাসী সুগন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গনের কবলে পরে সর্বহারা হয়ে কয়েক গ্রামের মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ভাঙ্গন ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেই কোন কার্যকর পদক্ষেপ, এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। বছরের পর বছর ধরে থেমে থেমে বন্যা ও প্রতিদিনের নদী ভাঙ্গনের সুর বাবুগঞ্জবাসীর যেন নিত্য সঙ্গি।
এদিকে, গত কয়েকদিনে নতুন করে ভাঙ্গনের ফলে বিলিন হয়ে গেছে কয়েকটি বাড়ী ও স্থাপনা। ভাঙ্গনের হুমকিতে রয়েছে রাজধানী ঢাকার সাথে দখিনের জনপদের সংযোগস্থাপনকারী বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু, বরিশাল বিমান বন্দর, বরিশাল-মুলাদী-হিজলা-পাতারহাট সড়ক, বাবুগঞ্জ বাজার ও মসজিদ মাদ্রাসাসহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিলীন হতে চলছে ক্ষুদ্রকাঠী, দক্ষিন রাকুদিয়া এলাকার বসতভিটা, ফসলী জমি। এলাকার বিশিষ্টব্যক্তিরা বলেন, সুগন্ধা নদীর পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত পানির প্রচন্ড ¯্রােতের গতি আড়াআড়ি ভাবে এসে বাবুগঞ্জ বাজারের পশ্চিমাংশে ক্ষুদ্রকাঠী এলাকা ও উত্তরাংশে পশ্চিম রাজগুরুসহ খেঁয়াঘাট এলাকায় আঘাত হানে।
এখান থেকেই ভাঙ্গনের শুরু যা এখন প্রচন্ড হুমকির ভাঙ্গনের আগ্রাসী রুপ ধারন করেছে। ভাঙ্গনের আগ্রাসী হুমকির মুখে রয়েছে বরিশাল বিমান বন্দরের রানওয়ের উত্তরাংশ, ক্ষুদ্রকাঠী দিঘীর পাড় এলাকায় বরিশাল-মুলাদী-হিজলা-পাতারহাট সড়ক। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে যেকোন সময়। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবছর ভাঙ্গনের মাত্রা ও আংশকা যেন বেশী। গত কয়েক বছরে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে শতাধীক পরিবারের ভিটেবাড়ীসহ শত শত একর ফসলি জমি। শতাধিক পরিবার ভাঙ্গনের কবলে তাদের ভিটে বাড়ি সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে ঠাঁই নিয়েছেন অন্যত্র।
আতঙ্কে রাত যাপন করছেন ভাঙ্গন কবলিত এলাকার বাকি পরিবারগুলি। বর্ষা মৌসুম শুরু হতে না হতেই নদীতে পানির ¯্রােত দেখে আতঙ্কিত হয়ে পরেছেন এলাকার শতাধিক পরিবার। সুগন্ধ্যা নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে বিলীন হতে চলেছে বাবুগঞ্জ উপজেলা সদরসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম। নদী ভাঙনে কৃষিজমি ও বসতভিটে হারিয়ে মানবিক বিপর্যয়ের মুখে ক্ষতিগ্রস্থরা।
নদী ভাঙ্গন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি এলাকাবাসীর। স্থানীয়রা বলছেন, ভাঙ্গন রোধে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে অচিরেই রাজধানী ঢাকার সাথে দখিনের জনপদের সংযোগস্থাপনকারী বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু, বরিশাল বিমান বন্দর, বরিশাল-মুলাদী-হিজলা-পাতারহাট সড়ক, বাবুগঞ্জ বাজার ও মসজিদ মাদ্রাসাসহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
উপজেলা সদর, স্থাপনা ও গ্রামগুলো রক্ষায় দ্রুত উদ্যোগ নেয়ার দাবীতে এরই মধ্যে মানববন্ধন, সমাবেশসহ নানা প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করেছে এলাকাবাসী। সুগন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে এলাকার জনপদের। নদী ভাঙ্গন যেন গরীব ও ধনীকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। আপদে বিপদে ধনীরা গরীবদের সাহায্য করে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে কে কার সাহায্য করে। সুগন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গনে এলাকার বসতবাড়ি, বনজসম্পদ, চাষাবাদযোগ্য ভুমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার ইত্যাদি বিলীন হয়ে গেছে। তারপরও সুগন্ধ্যা নদীর ধ্বংসলীলা রোধকল্পে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
নদী সভ্যতার প্রতীক হলেও সুগন্ধ্যা নদী তীরবর্তী এলাকাবাসীর জন্য ধ্বংস ও ভয়ানক অভিশাপের প্রতীকরূপে বিরাজমান। তীরবর্তী এলাকাগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে সুগন্ধ্যা নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, ঘরবাড়ি, বনজসম্পদ, চাষাবাদযোগ্য ভুমি ও বসতবাড়ি ভাঙ্গন সমস্যা, বন্যার তান্ডবলীলায় ফসলহানি, নদীতে চর জাগা, নৌযান চলাচল বিপর্যস্ত, মৎস্য সম্পদের অভাব, সুগন্ধ্যা নদীর তীর সংরক্ষণে উদাসীনতা ও স্থানীয় জীবন যাত্রার নি¤œমান সেই ব্রিটিশ শাসন থেকে অব্যাহত আছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা রোধকল্পে সরকারী টেকসই নানা পদক্ষেপ, ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসন ও সাহায্য সহযোগিতা করা হয়ে থাকে। কিন্তু বাবুগঞ্জ উপজেলার জনগনকে কোন সরকারী সাহায্য, পুনর্বাসন করা হয়নি, এমনকি যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই ভাঙ্গনের তীব্রতা রোধকল্পে বাস্তবসম্মত টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
যার ফলে জনপদের বিভিন্ন পেশার লোকজন চাষাবাদযোগ্য জমি, বাসগৃহ, বনজসম্পদ বারবার হারানোর বেদনায় এলাকার বাতাসে দুঃখ ও হতাশার করুন ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। নদী ভাঙ্গনের ফলে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা চরমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। যার ফলে বেকারত্ব, অশিক্ষা, দারিদ্রতা আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখ্য, ইতিপুর্বে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একাধিকবার নদী গর্ভে বিলিন হওয়ায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে। নদী ভাঙ্গনে অনেকের বাড়ীঘর হারিয়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে।
কেউ কেউ অন্যের বাড়িতে আশ্রিতা হিসেবে জীবনযাপন করে আসছে। একদিকে নদী ভাঙ্গন অন্যদিকে সামান্য বৃষ্টির কারনে সুগন্ধ্যা নদীর তীরবর্তী মানুষের অকাল বন্যার শিকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। এটা যেন তাদের জীবনে আষ্ঠেপৃষ্টে বাধাঁ। এলাকাবাসী করাল সুগন্ধ্যা নদী ভাঙ্গন থেকে মুক্তি চায়।
তারা এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বাবুগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যাপক গোলাম হোসেন বলেন, দুই বছর আগে সরকারি দপ্তর ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ভাঙ্গন কবলিত এলাকাবাসী নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে বেশ কয়েকবার আবেদন করেছিল। কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে নিজেদের উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁশের নির্মীত শতাধিক পার্কোপাইন ক্ষুদ্রকাঠী এলাকার নদীতে ফেলে ভাঙ্গন প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়েছিল। পরে বেশ কিছু খাঁচা তৈরী হলেও অর্থাভাবে থেমে যায় আগ্রাসী নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধের উদ্যোগ। একাধিকবার ইন্টারন্যাশনাল রিভার এন্ড ওসান কনফারেন্সে অংশগ্রহনকারী আরিফুর রহমান জানান, নদী ভাঙন নিছক প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া নয়। দীর্ঘ অবহেলা ও পরিকল্পনাহীনতা কিংবা উন্নয়নের ভ্রান্ত মডেল নদী ভাঙ্গনের করাল গ্রাসের কাছে বিপন্ন করে তুলে।
স্থানীয় সাংবাদিক ফাহাদ হাসান বলেন, বরিশাল বিমান বন্দর, বাবুগঞ্জর উপেজলা সদর, পাশ্ববর্তি আবুল কালাম ডিগ্রী কলেজ ও বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের বাড়ী সহ সংগ্রহসালা এবং উপজেলা হাসপাতাল রক্ষায় একটি নদী শাষন প্রকল্প পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং মন্ত্রণালয় হয়ে পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রায় ৩৬৪ কোটি টাকা ব্যয় সম্বলিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সরকারী, বেসরকারী বিপুল সম্পদ সুগন্ধা নদীর ছোবল থেকে রক্ষা পাবে। প্রকল্প প্রস্তাবটি বর্তমানে পুনরায় যাচাই-বাচাই করা হচ্ছে। আরেক সংবাদিক ফয়ছাল আহম্মেদ বলেন, সুগন্ধা নদীর ভাঙন রোধসহ উজানের ঢলের পানি সাগরে যাবার মুখে ভাঙনকে সহনীয় পর্যায়ে নিতে পরিপূর্ণ সম্ভাব্যতা সমিক্ষা ও নকশা প্রনয়ন করে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহনের বিকল্প নেই।
এতেকরে বিপুল পরিমান ভূমি পুনরুদ্ধারেরও সম্ভবনা রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি। নদী গবেষক ও লেখক, রিভারাইন পিপল এর মহাসচিব শেখ রোকন জানান, পলল নদীকে বশে রাখতে হলে একদিকে যেমন পাড় বাঁধতে হয়, অন্যদিকে প্রয়োজন হয়, প্রবাহ যাতে মাঝনদী বরাবর থাকে, প্রবাহের জন্য যাতে পর্যাপ্ত গভীরতা থাকে, সেই ব্যবস্থা করা। দুর্ভাগ্যবশত, নদী শাসনের কাজ বরাবরই একচোখা। পাড় বাঁধার দিকে যতটা মনোযোগ দেওয়া হয়, প্রবাহকে মাঝনদীতে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তার সিকিভাগও নয়। এ বিষয়ে বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনের সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু বলেন, সুগন্ধা নদীর ভাঙ্গনের কবল থেকে রাজধানী ঢাকার সাথে দখিনের জনপদের সংযোগস্থাপনকারী বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু, বরিশাল বিমান বন্দর, বরিশাল-মুলাদী-হিজলা-পাতারহাট সড়ক, বাবুগঞ্জ বাজার ও মসজিদ মাদ্রাসাসহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রক্ষায় তিনি কাজ করে যাবেন।
নদী ভাঙ্গন রোধ প্রসঙ্গে গত শনিবার (২৭ এপ্রিল) দুপুরে খুলনার একটি অভিজাত হোটেল সিটি ইন এ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপকুলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প, ফেজ-১-এর ‘বাংলাদেশের উপকুলীয় এলাকার দীর্ঘ মেয়াদি পর্যবেক্ষন, গবেষণা এবং বিশ্লেষন’ শীর্ষক সমীক্ষার ওপর আঞ্চলিক মতবিনিময়ের এক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক ঝুঁকি বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।
বিষয়টিকে কার্যকর ব্যবস্থাপনায় না আনলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। তিনি বলেছেন, নদী ভাঙনের তাৎক্ষণিক সমাধান নয়, বরং স্থায়ী সমাধানের কথা ভাবছে সরকার। পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশের উপকুলীয় অঞ্চলকে প্রাকৃতিক সম্পদে সম্পদশালী বিবেচনা করা হয়। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও পরিবেশগত অবক্ষয় বিবেচনায় নিয়ে নতুন করে উপকূলীয় পোল্ডার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ভাবতে শুরু করেছে সরকার। স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের ভাবনাকে উন্নয়নকাজের সময় গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
দেশের অন্য এলাকা হতে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রকৃতি ভিন্ন হওয়ার উপকূলীয় এলাকার জন্য বিদ্যমান সমস্যার সমাধানও ভিন্ন হবে। সবাই মিলে কাজ করলে সমাধান সহজে অর্জিত হবে।
দেশের উপকূলীয় এলাকার ১৩৯টি পোল্ডারকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে টেকসই ব্যবস্থাপনার আওতায় আনলে এ অঞ্চলে বসবাসকারী দেশের ২৬ শতাংশ বা তিন কোটি ৮০ লাখ মানুষ উপকৃত হবে। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র প্রকল্পের পরিবর্তে বৃহৎ প্রকল্পের মাধ্যমে নদী শাসন করে ভাঙ্গন প্রতিরোধ করা সম্ভব।
Leave a Reply