শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৫২ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ যেখানেই বিবাদমান জমি, সেখানেই হাজির হন তিনি। কখনো মৌখিক, কখনো পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে নেমে পড়েন দখলের কাজে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি হাতে নিয়েছেন হাইকোর্টের রায়ে খারিজ হয়ে যাওয়াদের জমি।বলছিলাম বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুজ্জামান তনুর কথা। তিনি এবার মোক্ষম দান কষার জন্য কোপ দাগেন তাতলতীতে নির্মাণাধীন বরিশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সীমানায়। দেড় বছর আগে শুরু হওয়া প্রকল্পের জমির মাটি ভরাট যখন শেষ পর্যায়ে, ঠিক তখন গত নভেম্বর মাসে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়েছেন বিতর্কিতদের কাছ থেকে।পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়েই শুরু করেছেন সন্ত্রাসী মহড়া। দু’দফায় হামলা চালিয়েছেন প্রকল্পের নিয়োজিত লোকদের ওপর। প্রথমে এক চীনা প্রকৌশলীকে মারপিট করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। সম্প্রতি প্রকল্পের জ্বালানি সরবরাহের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় তার ক্যাডাররা। তার ভয়ে আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে প্রকল্পের লোকজন।অথচ তিনি যে জমিগুলোর মালিকানা দাবি করছেন তার কোনো ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই মৌজার জমিগুলো তিন দফায় বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। প্রথম দেওয়া হয় মগদের সাড়ে তিন একর করে, এরপরের ধাপে আড়াই একরের প্লট এবং সর্বশেষ দেড় একরের প্লট বন্দোবস্ত দেওয়া হয়।কিন্তু দেড় একর যাদের বন্দোবস্ত দেওয়া হয় তার বেশিরভাগই ওই আড়াই একর প্লটের জমিগুলো। এ কারণে সীমানা নির্ধারণ করতে গিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। তখন আড়াই একর প্লটের মালিকরা মামলা ঠুকে দেয়। সেই মামলা গড়ায় হাইকোর্ট পর্যন্ত। প্রত্যেকটি ধাপেই পরাজিত হয় দেড় একরের মালিকরা। সেই দেড় একরের মালিকদের কাছ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়েছেন চাঁদা না পেয়ে।প্রকল্পের কাজ শুরু হলে আট কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে বসেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যের সমঝোতার ভিত্তিতে ২৫ লাখ টাকা দেওয়া হয় তাকে। যা তিনি নিজের মুখেই স্বীকারোক্তি দেন বিদ্যুৎ বিভাগের এক তদন্ত কমিটির সামনে। তার আপন ভাই তালতলী উপজেলার চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মিন্টুও বিষয়টি স্বীকার করে নেন। তাদের এই চাঁদাবাজির স্বীকারোক্তি হতবাক করে তদন্ত কমিটির সদস্যদের।
এদিকে কাগজে কলমে পিছিয়ে থাকলেও পেশিশক্তির মহড়া অব্যাহত রেখেছেন তনু। গত ৫ ফেব্রুয়ারি তদন্ত কমিটি আসার পূর্বে ক্যাডারদের নিয়ে মহড়া দেন। পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো জেলা পুলিশের এক গোপনীয় প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর তথ্য। সরকারি দলের প্রভাব খাটিয়ে উপকূলে মাদকের কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন তার ছোট ভাই মো. তারেক। আর তারেককে শেল্টার দিয়ে যাচ্ছেন তনু।এতে করে তাদের পরিবারের প্রতি সাধারণ মানুষের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সরকারি দল তথা আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। যাকে পুঁজি করে বিএনপি রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে। ওই রিপোর্টে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে চাঁদাবাজির কথাও উঠে এসেছে।এ বিষয়ে তৌফিকুজ্জামান তনু বলেন, ‘হ্যাঁ আমি গত নভেম্বরে জমি কিনেছি এ কথা সত্যি। প্রকল্প এলাকায় জমি কেনায় কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি?’ এ সময় নিজেকে ৩৫ একর জমির মালিক দাবি করেন তিনি। কোর্টের রায়ে পরাজিতদের জমি নেওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব কথা ভিত্তিহীন।’বরিশাল পাওয়ার কোম্পানির প্রকল্প পরিচালক আব্দুস সবুর বলেন, ‘আমরা সকল বৈধ জমির মালিকদের কাছ থেকে জমি নিয়েছি। ওদের দাবি অনুযায়ী একটি দলিল রেজিস্ট্রি অফিসে দাখিল করেছিলাম। কিন্তু সাব রেজিস্ট্রার সেটি ফেরত দিয়েছে। তারা কোনো কথাই মানতে রাজি নয়।’এর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে আশ্রিত ৯৭ ভূমিহীন পরিবারদের দিয়ে খেলার চেষ্টা করেন তনু। তাদের দিয়ে মিছিল মিটিং ও মানববন্ধন করে পরিস্থিতি ঘোলা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বাস্তুহারা পরিবারগুলো পুনর্বাসিত হয়ে চলে গেলে নতুন করে ষড়যন্ত্র করেন কয়লা ভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বিরুদ্ধে।তনু ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভূমি দখলসহ অনেক চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী মাহমুদুল হাসান পিন্টুর কাছে ১২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। সেই টাকা না দেওয়ায় প্রকাশ্যে মারধর করা হয় তাকে।অনেকে তার হাতে নির্যাতিত হলেও অভিযোগ করার সাহস পায়নি। তালতলীবাসীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে পরিণত হয়েছেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। সরকারি দলের লেবেল থাকায় প্রশাসনও তার বিরুদ্ধে শক্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস দেখায় না। এতে দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তনু।জলমহল ইজারা থেকে উপজেলার টেন্ডার, এমনকি হাট-ঘাটের ইজারাও এখন তার আঙুলের ইশারায় চূড়ান্ত হয়। তার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই করা হয় নির্যাতন।
Leave a Reply