বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪২ পূর্বাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ করোনাভাইরাস দুর্যোগের মধ্যেও দক্ষিণাঞ্চলে লেবুর বাম্পার ফলন হয়েছে। স্বল্প জমিতে লেবু চাষ করে লাভবান হয়েছেন অনেক কৃষক। তবে গেলো রমজান এবং করোনার শুরুতে লেবুর ঊর্ধ্বমুখী মূল্য থাকলেও বর্তমানে তা নেমে গেছে। ইতিপূর্বে হালি (চার টি) হিসেবে লেবু বিক্রি হলেও বর্তমানে তা কেজি দরেও বিক্রি হচ্ছে।
লেবু চাষিরা বলছেন, করোনা ও রমজানের শুরুতে প্রতি হালি লেবু যে দরে বিক্রি করতে পেরেছেন ইতিপূর্বে কোন মৌসুমেই এত দাম পাননি। ওই সময়ে প্রতি হালি লেবু বাগান থেকেই ২৮-৩০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন চাষিরা। এখন অবশ্য বরিশালের বাজারগুলোতে লেবুর দাম কম হলেও আগে যে চড়া দাম পেয়েছেন তাতেই খুশি লেবুচাষিরা।
চিকিৎসকরা বলছেন, এখন পর্যন্ত মহামারি করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। ভিটামিন ‘সি’ শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, আর সে কারণে ভিটামিন ‘স’ সমৃদ্ধ লেবু খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
চাষিদের কাছ থেকে জানাগেছে, ‘দেশে করোনা ভাইরাসের শুরুর দিকটাই ছিলো লেবু উৎপাদন মৌসুম। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ খেতে হবে। তাই করোনা সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় লেবুর চাহিদা।
করোনার কারণে বরিশালের লেবুচাষিদের ঢাকার মার্কেটের জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। গ্রাম ও আশপাশের শহরের ক্রেতাদের মধ্যে লেবুর চাহিদা ছিল অনেক বেশি। তাই এ মৌসুমে লেবু বিক্রিতে বেগ পেতে হয়নি তাদের। এদিকে দক্ষিণাঞ্চলে লেবুর ফলন বৃদ্ধিতে কৃষকের পাশে থেকে সহযোগিতা করছে বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। কৃষকদের জন্য তারা লেবু ও লেবু জাতীয় ফল উৎপাদনের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছেন। প্রণোদনাস্বরূপ লেবু, মাল্টা ও কমলা চাষের জন্য চারা ও সার বিতরণ করা হচ্ছে বিনামূল্যে।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, বরিশাল বিভাগে লেবু জাতীয় ফসলের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। লেবু, মাল্টা, বাতাবি লেবু, কমলা, এলাচি লেবু, জারা লেবু, কলম্বো লেবু, সাতকরসহ নানা ধরনের লেবুজাতীয় ফল রয়েছে। এ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দক্ষিণাঞ্চলব্যাপী চেষ্টা চলছে। লেবুজাতীয় ফলের চাষকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলে সফলতা আসবে বলে আশাবাদী অধিদফতরের কর্মকর্তারা।
পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার লেবু চাষি সুমন হাওলাদার বলেন, এবার লেবুতে খুব ভালো দাম পেয়েছি। করোনা ও রোজার শুরুতে প্রতি হালি লেবু ২৫ থেকে ৩০ টাকায়ও বিক্রি করেছি। বেপারীরা বাগান থেকে প্রতি ১০০ লেবু নিয়েছে ৫০০-৬০০ টাকা দরে।
তিনি বলেন, মাত্র ২০ শতক জমিতে লেবুর চাষ করেছি। প্রতিবছর দেড় লাখ টাকার মতো লেবু বিক্রি করা যায়। এবার দুই লাখের কাছাকাছি যাবে। এ পরিমাণ জমিতে অন্য কোনো ফসল ফলিয়ে এত টাকা লাভবান হওয়া সম্ভব না।
তিনি বলেন, লেবু ছাড়াও প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০হাজার টাকার কলম বিক্রি করা যায়। এখন অবশ্য লেবুর দাম কম। কারণ বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ পুরো লেবুর মৌসুম। এখন প্রতিটি গাছে লেবু ধরছে।
লেবু চাষের বিষয়ে বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার রাশেদুল ইসলাম বলেন, এক বিঘা জমিতে লেবু চাষ করেছি। প্রতিবার এক থেকে দেড় লাখ টাকার লেবু বিক্রি করি। এবার আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার লেবু বিক্রি করতে পারবো। ইতোমধ্যে দুই লাখ টাকার লেবু বিক্রি করেছি।
তিনি বলেন, করোনার কারণে এবার লেবুর চাহিদাও খুব বেশি। এবার বাজারে লেবু নিতে হয়েছে খুব কম। বাগান থেকেই বেপারীরা লেবু নিয়ে গেছে। করোনার প্রথম দিকে প্রতি হালি লেবু বাগান থেকে ২৫-৩০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। এখন অবশ্য দাম কম এখন প্রতি হালি ৮-১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর কিছু দিন পর এ মৌসুম শেষ হয়ে যাবে।
ঝালকাঠি জেলার সদর উপজেলার আরিফুল ইসলাম বলেন, এবার করোনার কারণে আমরা লেবুর ভালো দাম পেয়েছি। ৭ বিঘা জমিতে লেবু চাষ করেছি। করোনাকালের পরিস্থিতিতে গেল দুই মাসেই বাগান থেকে লেবু বিক্রি করেছি প্রায় ১৪ লাখ টাকার।
তিনি বলেন, লেবু চাষে তুলনামূলক পানি সেচ লাগে না। সারসহ পরিচর্যা আর শ্রমিক খরচ খুবই কম। তাই ক্রমেই বাড়ছে লেবুর বাগান। এ বছর লেবু বিক্রিতে চাষিদের কোনো সমস্যা হয়নি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাগানে এসে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন লেবু। করোনা ও রোজার সময় প্রতিটি লেবু বিক্রি হয়েছে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৭ টাকা পর্যন্ত।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঝালকাঠি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রিফাত শিকদার বলেন, আমাদের মাঠ পর্যায়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা লেবু চাষিদের সব সময় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এছাড়া বাগানে গিয়ে লেবুর ফলন তদারকি ও লেবুর ফলন আরও ভালো করতে কাজ করে যাচ্ছি। এছাড়া প্রদর্শনীর মাধ্যমে নতুন লেবুবাগান তৈরিতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়।
এ সম্পর্কে বরিশাল মেট্রোপলিটন কৃষি কর্মকর্তা ফাহিমা হক বলেন, লেবু সবসময় একটি উচ্চ ফলনশীল ফসল। কোন কৃষক লেবু চাষে ভালোভাবে দৃষ্টি দিলে সে লাভবান হবে।
বর্তমানে লেবুর চাহিদা বেশ ভালো জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে ভিটামিন “সি” এর অভাব মিটাতে সাহায্য করছে লেবু। আমরা লেবু চাষিদের পরামর্শ দিয়ে লেবু চাষে সহযোগিতা করছি।”
পিরোজপুর কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর’র উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, আমারা নিয়মিত লেবু চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকি। পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠিতে প্রচুর নার্সারি আছে। আমরা সেখানে লেবুর চারা তৈরিতে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকি।
বরিশাল কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর (খামারবাড়ি) এর উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, রোজার মাসের সাথে সাথে করোনা পরিস্থিতিতে লেবুর চাহিদা প্রচুর। ফলে এবার কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন। আমাদের খামার বাড়িতে একটি প্রকল্প আছে, যে প্রকল্পে বরিশাল জেলার ৪টি উপজেলায় কিভাবে লেবুর চাষ বাড়ানো যায় সে বিষয়ে লেবুচাষিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
৪টি উপজেলা হলো, বানারীপাড়া, উজিরপুর, গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া। এই চারটি উপজেলায় কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয় যাতে তারা লেবুর আবাদ আরও বাড়াতে পারে। এছাড়া আমরা লেবু জাতিয় ফসল মাল্টা চাষ বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেই।
তিনি আরও বলেন, আমরা মেলাসহ বিভিন্ন জায়গায় কৃষকদের লেবু ও মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ করণের পাশাপাশি লেবু এবং মাল্টা চাষিদের নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকি।
Leave a Reply