শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পূর্বাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ বারবার উচ্চতা বাড়ানোর সুপারিশ করা হলেও প্রয়োজনের চেয়ে কম উচ্চতার নকশাতেই নির্মিত হচ্ছে গোমা সেতু। সে কারণে আবারও আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিএ)।
সংস্থাটি জানিয়েছে, বাকেরগঞ্জ উপজেলায় রাঙামাটি নদীতে নির্মাণাধীন গোমা সেতুর উচ্চতা না বাড়িয়ে নির্মাণ করা হলে এ রুট দিয়ে দূরপাল্লা বিশেষ করে ঢাকাগামী লঞ্চ ও বড় বড় মালবাহী নৌ-যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে এবং রুটটি মুখ থুবড়ে পড়বে। সেতুর উচ্চতা না বাড়িয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করায় আপত্তি জানিয়েছেন তারা।
সেতুর উচ্চতা দ্বিতীয় শ্রেণীর করার সুপারিশ জানিয়ে চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরিশাল-দিনারেরপুল-লক্ষ্মীপাশা-দুমকি আঞ্চলিক সড়কের ১৪তম কিলোমিটারে বাকেরগঞ্জ উপজেলায় রাঙামাটি নদীতে নির্মিত হচ্ছে গোমা সেতু। ২৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৮৩ দশমিক ১৮৮ মিটার দৈর্ঘ্য সেতুটি নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। আর নির্মাণাধীন এই সেতুর উচ্চতা ধরা হয়েছে নদীতে সর্বোচ্চ জোয়ারের পানির উচ্চতা থেকে ৭ দশমিক ৬২ মিটার। কিন্তু পানি থেকে এই উচ্চতা নিয়েই আপত্তি জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ।
তাদের মতে, এই নদী দিয়ে যাত্রী ও মালবাহী ছোট ও বড় আকারের নৌ-যান চলাচল করে, যা একটি নৌ-রুট হিসেবে পরিচিত। ফলে এ নদীতে সেতু নির্মাণ করতে হলে পানি থেকে এর উচ্চতা একটা নির্ধারিত নিয়মে হতে হবে। যাতে সড়ক ব্যবস্থা সচল থাকার পাশাপাশি নৌ-যান চলাচলের ব্যবস্থাও সচল থাকে। কিন্তু সেতুটি এমন একটি উচ্চতায় তৈরি হচ্ছে, যার নিচ দিয়ে দূরপাল্লার বিশেষ করে ঢাকাগামী লঞ্চ চলাচল কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তাই বিষয়টি আমলে নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে ১২ দশমিক ২ মিটার উচ্চতা করার প্রস্তব দিয়ে মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই অবস্থায় সেতু নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিআইডব্লিউটিএর আপত্তি থাকার পরেও গেলো বছরের ২৩ ডিসেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায় সেতুর কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী কাজ শুরু হলেও পুনরায় সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটারে নির্মাণের সুপারিশসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে বিআইডব্লিউটিএ। ওই প্রতিবেদন দখিলের পরে গোমা সেতু নির্মাণ কাজ দ্বিতীয় দফায় বন্ধ থাকলেও গেলো জুন মাসের প্রথমদিকে তা আবার শুরু হয়।
এবারও বিআইডব্লিউটিএর একটি প্রতিনিধিদল সেতু এলাকা পরিদর্শন করে এবং তারা এরইমধ্যে সেতুটির নদীর অংশের উচ্চতা বাড়ানোর সুপারিশ পুনরায় কর্তৃপক্ষের কাজে পাঠিয়েছেন। আর সেতুর মধ্যের অংশে নকশার পরিবর্তন এনে নির্মাণ করা হলে গুরুত্বপূর্ণ নৌ-রুটটি রক্ষা পাবে বলে দাবি বিআইডব্লিউটিএর প্রকৌশল বিভাগের। তাদের দাবি, বিআইডব্লিউটিএর স্থানীয় কোনো বিভাগ থেকে পরামর্শ নেওয়া হয়নি সেতুটির নির্মাণযজ্ঞ শুরুর আগে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, করোনা পরিস্থিতিতে তেমন একটা নজরাদারি না থাকায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সেতুটি নির্মাণর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে সেতুটি নির্মাণ করলে নদীবেষ্টিত বরিশাল অঞ্চলের একটি নৌ-রুটে বড় আকারের নৌ-যানগুলো চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে, প্রভাব পড়বে পটুয়াখালী-ঢাকাগামী নৌ-রুটের লঞ্চ চলাচলে, প্রভাব পড়বে শেখ-হাসিনা সেনানিবাসের পণ্য পরিবহনেও। আর পায়রাবন্দর চালু হলে এর ক্ষতিকর প্রভাব আরও তীব্র হবে বলে দাবি স্থানীয়দের।
আর পটুয়াখালী-ঢাকা রুটে চলাচলকালী এমভি প্রিন্স সোহাগ-৭ লঞ্চের মালিক ও মাস্টারের দাবি, উচ্চতা না বাড়ানো হলে সেতুটির নিচ দিয়ে লঞ্চ চলাচল করানো সম্ভব হবে না। এছাড়া বিআইডব্লিউএর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন, তারা বিষয়টি অবগত রয়েছেন।
এদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলছে, তারা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেতু নির্মাণযজ্ঞ শুরু করছেন। তাদের মতে, রাষ্ট্রের দেওয়া অর্থের অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেতুটি নির্মাণ করা হবে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তীরণ নৌ-চলাচল ও পরিবহন সংস্থার পরিচালক মো. মামুন অর রশিদ বলেন, সরকার কোনো নদী ও নৌ-রুট বন্ধ হোক তা কোনোভাবেই চায় না। কিন্তু উচ্চতা না বাড়িয়ে সেতুটি নির্মাণ করলে ওই রুটে যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌ-যান চলাচল ব্যাহত হবে। তাই জনস্বার্থে এই সেতুর উচ্চতা বাড়ানো দরকরা।
বিআইডব্লিউটিএর নৌ-পথ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের দক্ষিণ ব-দ্বীপ অঞ্চলের যুগ্ম পরিচালক এসএম আজগর আলী জানান, বরিশালের বিআইডব্লিউটিএর নির্ধারিত রুটগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ রাঙামাটি নৌ-পথটি। এ নদীতে দ্বিতীয় শ্রেণীর নিচে কোনো সেতু নির্মাণ করা হলে নৌ-চলাচলে ব্যাহত হবে। কিন্তু এখানে নির্মাণ হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণীর সেতু, ফলে গোমা সেতুটি জোয়ারের পানির সর্বোচ্চ উচ্চাতার থেকে ৭ দশমিক ৬২ মিটারে নির্মাণ করা হবে। কিন্তু রুটটি সচল রাখতে গোমা সেতুর উচ্চতা দ্বিতীয় শ্রেণীতে অর্থাৎ ১২ দশমিক ২ মিটার করার প্রস্তবনা দিয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
মাঝারি ও বড়মানের সেতু নির্মাণের আগে বিআইডব্লিউটিএ থেকে নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স নেওয়ার কথা জানিয়ে বরিশাল বিভাগের সওজ নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসদু খান বলেন, সার্বিক সব ধরনের কাজ সম্পন্ন করে সেতুটি নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এরপর বিআইডব্লিউটিএর আপত্তির পর এর কাজ বন্ধ থাকলেও গত বছরের ২৩ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘সারাদেশে বিভিন্ন নদীতে যে উচ্চতায় সেতু নির্মিত হচ্ছে গোমা সেতুও একই উচ্চতায় সেতু নির্মিত হবে। বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি এড়াতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আন্তঃমন্ত্রাণালয়ের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন করে কোনো সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে উচ্চতা নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে সমম্বয় করা হবে। এটা তো আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভার সিদ্ধান্ত। সেই অনুযায়ী সেতু নির্মাণের কাজ পুনরায় শুরু হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ নতুন করে কেন আপত্তি তুলছে। তাদের এই আপত্তি অনুযায়ী সেতুর ডিজাইনে উচ্চতা বাড়াতে হলে সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হতো। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এ সেতু নির্মাণ শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও যোগ করেন সওজের ওই প্রকৌশলী।
বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বিআইডব্লিউটিএ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগকে নিয়ে বসার কথা জানিয়ে বলেছেন, প্রয়োজনে সেতু নির্মাণ কার্যক্রমে সংশোধন আনা হবে। কিন্তু কোনোভাবেই নৌ-রুটটিকে বন্ধ করে সেতু নির্মাণ হলে তা এখানকার জন্য দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি না।
Leave a Reply