শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৮ অপরাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ রমজান শুরু হতে দেড় মাসের মতো সময় আছে। পাইকারি বাজারে সাধারণত রমজানের পণ্য বিক্রি শুরু হয় ৪০ দিন আগে। সেই হিসাবে আগামী এক মাসের মধ্যেই রমজানের ভোগ্য পণ্য আমদানি করে বাজারে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এত কম সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভোগ্য পণ্য পৌঁছানো চ্যালেঞ্জিং হবে। তবে ঋণপত্র খোলা পণ্যগুলো যদি সময়মতো আমদানি করে এনে বাজারে যথাযথভাবে সরবরাহ করা যায়, তাহলে কোনো সমস্যা হবে না।
আমদানি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রমজানের সাতটি প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যের মধ্যে পাম তেল, সয়াবিন তেল, মসুর ডাল ও পেঁয়াজ—এই চার পণ্যের আমদানি ভালো। বাকি তিনটি ভোগ্য পণ্যের মধ্যে চিনি, ছোলা ও খেজুর আমদানি আগের বছরের তুলনায় কমেছে। এর মধ্যে অপরিশোধিত চিনি আমদানি কমেছে ২২ শতাংশ, ছোলা আমদানি কমেছে ২১ শতাংশ এবং খেজুর আমদানি কমেছে ৩ শতাংশ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও কাস্টমসের সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে এসব পণ্যের ঋণপত্র খোলা আগের (২০২১) ডিসেম্বরের তুলনায় কমেছে। আবার ডলারের সংকটের কারণে জাহাজে থাকা পণ্য খালাস করতে না পারার অভিযোগও রয়েছে।
জানতে চাইলে ভোগ্য পণ্যের আমদানিকারক এটিআর ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আলম বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে রাজি করানোর পর ২৫০ টন ছোলা আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলেছি। এখন সেই ছোলা মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং সমুদ্রবন্দর থেকে চট্টগ্রামে আনতে পারছি না। কারণ সরবরাহকারী আগেই টাকা পরিশোধের নিশ্চয়তা চাইছে। এখন ডলার ছাড়া সেই ছোলা আনা যাবে না। অথচ অনুমতি পেলে মাত্র পাঁচ দিনেই সেই ছোলা চট্টগ্রামে পৌঁছাত।’
ছোলা
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে ছোলার আমদানি হয় বছরে দেড় লাখ টন। এর বাইরে দেশেও কিছু ছোলা উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে রমজানের চাহিদা থাকে এক লাখ টনের মতো।
কাস্টমসের হিসাবে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ছোলা আমদানি হয়েছে সাড়ে ৫৩ হাজার টন। ২০২১ সালের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৬৭ হাজার ৬৪০ টন। সেই হিসাবে আমদানি কমেছে ২১ শতাংশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমদানি কমার কারণে বাজারে কতটা প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে ছোলা আমদানির ঋণপত্র হয়েছে সাড়ে ৭৫ হাজার টনের। ডিসেম্বরেই সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৫০ হাজার টন ছোলা আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। সেই ছোলা যদি আগের আমদানির সঙ্গে জানুয়ারিতে যোগ হয় তাহলে বাজারে ছোলার সরবরাহ দাঁড়ায় এক লাখ ২০ হাজার টন। বিপরীতে রমজানে ছোলার চাহিদা আছে এক লাখ টন। ফলে বাড়তি ২০ হাজার টন উদ্বৃত্ত থাকে জানুয়ারিতেই। এখন ঋণপত্র খোলার অনুমোদন পাওয়া ছোলা বাজারে রমজান শুরুর আগে পৌঁছানোই বড় চ্যালেঞ্জ বলছেন ব্যবসায়ীরা।
চিনি
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে চিনির মোট চাহিদা থাকে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন। আখ থেকে চিনির উৎপাদন ৩০ হাজার টন। বাকিটা আমদানি করেই মেটানো হয়। সারা বছর প্রতি মাসে গড়ে চিনির চাহিদা দেড় লাখ টন থাকলেও রমজানে চিনির চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়, অর্থাৎ তিন লাখ টনে উন্নীত হয়। এখন দেখা যাক, কী পরিমাণ চিনি দেশে আমদানি হয়ে গুদামে পৌঁছেছে।
কাস্টমসের হিসাবে, ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসে দেশে মোট সাত লাখ ৩৩ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে। ২০২১ সালের একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৪১ হাজার টন। আমাদনি কমেছে ২২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর তিন মাসে ঋণপত্র খোলা হয়েছে তিন লাখ ৭৫ হাজার টনের। এর মধ্যে ডিসেম্বরের চিনির পরিমাণ ৬৯ হাজার টন এখনো পৌঁছায়নি। সেটি জানুয়ারি নাগাদ পৌঁছার কথা। সেই চিনি যোগ করলে মোট আমদানি দাঁড়ায় আট লাখ টনের বেশি। ফলে রমজানের চাহিদার প্রায় আড়াই গুণ চিনি দেশে পৌঁছেছে।
চিনি আমদানি হয় অপরিশোধিত আকারে। ফলে সেই চিনি দেশে এসে কারখানায় পরিশোধন হয়ে বাজারে আসতে বেশ কিছু সময় লাগে। তাই তদারকি করতে হবে সবচেয়ে বেশি।
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এই মুহূর্তে তিনটি চিনিবাহী জাহাজ আছে। এর মধ্যে মেঘনা গ্রুপের একটি জাহাজে ৩৭ হাজার টন, এস আলম গ্রুপের জাহাজে সাড়ে ৫৫ হাজার টন এবং দেশবন্ধু গ্রুপের জাহাজে সাড়ে ৫৫ হাজার টন চিনি আছে। ডলার সংকটের কারণে সেগুলো জাহাজ থেকে ছাড় করা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী আরএম এন্টারপ্রাইজের মালিক আলমগীর পারভেজ বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে বহির্নোঙরে এসেও কিছু জাহাজ থেকে পণ্য নামানো যাচ্ছে না বলে জেনেছি। এই সংকট দ্রুত কাটানো দরকার। তা না হলে সরবরাহ সংকট তৈরি হবে।’
খেজুর
দেশে সবচেয়ে বেশি খেজুর খাওয়া হয় রমজানে। পুরো বছর যেখানে চাহিদা এক লাখ টন, শুধু রমজানেই চাহিদা থাকে ৫০ হাজার টন। ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে আমদানি হয়েছিল ১১ হাজার ৭৭৩ টন। আর ২০২১ সালে আমদানি হয়েছিল ১২ হাজার ১৫৩ টন। অর্থাৎ আমদানি কমেছে ৩ শতাংশ। ফলে এটি উদ্বেগের বিষয় নয়। কারণ ২০২২ সালের অক্টোবরে চার হাজার ৮০০ টন, নভেম্বরে সাড়ে চার হাজার টন এবং ডিসেম্বরে পৌনে ১৩ হাজার টন খেজুর আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। ফলে সেই খেজুর বাজারে পৌঁছলে উদ্বৃত্ত থাকবে।
পাম তেল
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে ভোজ্য তেলের চাহিদা বছরে ২০ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপন্ন হয় দুই লাখ টন, বাকিটা আমদানি করেই মেটানো হয়। রমজানে তেলের চাহিদা থাকে প্রায় তিন লাখ টন। পাম তেল দুইভাবে দেশে আমদানি হয়। একটি হচ্ছে অপরিশোধিত, আরেকটি পরিশোধিত। ইদানীং পরিশোধিত সয়াবিনই বেশি আমদানি হচ্ছে।
২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে অপরিশোধিত পাম তেল আমদানি হয়েছিল এক লাখ ৪৫ হাজার টন। ২০২২ সালের একই সময়ে আমদানি হয়েছে ১২ হাজার টন। সেই হিসাবে ৯২ শতাংশ আমদানি কমেছে। কিন্তু পাম তেল পরিশোধিত আকারে রেকর্ড আমদানি হয়েছে। ২০২১ সালের ছয় মাসে যেখানে আমদানি হয়েছিল তিন লাখ ৯১ হাজার টন, সেখানে ২০২২ সালের ছয় মাসে আমদানি হয়েছে সাড়ে ৯ লাখ টন। অর্থাৎ আমদানি বেড়েছে ১৪৩ শতাংশ। সেই হিসাবে উদ্বৃত্ত আমদানি হয়েছে এরই মধ্যে। ২০২২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর দুই মাসে দেড় লাখ টন পাম তেল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে।
সয়াবিন তেল
দেশে তিনভাবে সয়াবিন আমদানি হয়। একটি হচ্ছে বীজ আকারে, আরেকটি অপরিশোধিত আকারে এবং তৃতীয়টি পরিশোধিত আকারে। এর মধ্যে পরিশোধিত আকারে আসে শুধু ওষুধশিল্পে ব্যবহারের জন্য। বাকি দুইভাবে আনা সয়াবিন কারখানায় পরিশোধন করেই বিক্রি হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল এসেছে দুই লাখ ৯৭ হাজার টন। ২০২২ সালের একই সময়ে এসেছে তিন লাখ ২১ হাজার টন। ফলে আমদানি বেড়েছে ৮ শতাংশ। আর বীজ আকারে সয়াবিন ২০২২ সালে এসেছে সাত লাখ ১৪ হাজার টন। ২০২১ সালের একই সময়ে এসেছিল পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার টন। ফলে আমদানি বেড়েছে ২৩ শতাংশ।
নভেম্বর-ডিসেম্বরে সয়াবিন আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমেছে। ফলে সেখানে সরবরাহ ঠিক না রাখলে রমজানের পরে সংকট তৈরি হতে পারে।
মসুর ডাল
দেশে মসুর ডালের চাহিদা বছরে ছয় লাখ টন। এর মধ্যে চার লাখ টন আমদানি হয়, বাকি দুই লাখ টন দেশে উৎপন্ন হয়। আর চাহিদা শুধু রমজানেই এক লাখ টন।
আমদানির তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে মসুর ডাল আমদানি হয়েছে এক লাখ ৯৯ হাজার টন। ২০২১ সালের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল এক লাখ ৯ হাজার টন। আমদানি বেড়েছে ৮২ শতাংশ। আর ২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর তিন মাসে ঋণপত্র খোলা হয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার টনের। ফলে মসুর ডালের আমদানি হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ।
পেঁয়াজ
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ৩৫ লাখ টন। দেশে উৎপন্ন হয় ২৮ লাখ টন আর আমদানি হয় সাত লাখ টন। আর শুধু রমজানেই প্রয়োজন হয় চার লাখ টন পেঁয়াজ। সেই পেঁয়াজ কিন্তু দেশে আমদানি হয়েছে।
২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছিল তিন লাখ ৪০ হাজার টন। ২০২২ সালের একই সময়ে আমদানি হয়েছে তিন লাখ ৮৬ হাজার টন। ফলে আমদানি বেড়েছে ১১ শতাংশ। আর শুধু ডিসেম্বরেই ৪৮ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। ফলে বাজারে পেঁয়াজ নিয়ে এখন শঙ্কা নেই।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম মনে করেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের সংকট নেই। ব্যবসায়ীরাও পণ্য আনছেন। কিন্তু ঠিক সময়ে পণ্যটা বাজারে পৌঁছানো এবং সরবরাহ ঠিক রাখাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, ‘যে পরিমাণ ঋণপত্র খোলা হয়েছে, সেগুলো চাইলেই সঠিক সময়ে পৌঁছানো সম্ভব। এখন এই কাজটি গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে। সেটি নিশ্চিত করা গেলে রমজানে বাজারে সংকটের কোনো কারণ আমি দেখছি না।
Leave a Reply