শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫১ অপরাহ্ন
এমদাদুল হক মিলন, দিনাজপুর ও মাহাবুর রহমান, বিরামপুর ॥ দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানম ও তাঁর মুক্তিযোদ্ধা বাবা ওমর আলীর ওপর হামলার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের পর উপজেলা যুবলীগের বহিষ্কৃত আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলমকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি স্থানীয়রা মেনে নিতে পারছে না। ছাড়া পাওয়ার পর তিনি গাঢাকা দিয়েছেন। পুলিশ তাঁকে খুঁজে পাচ্ছে না।
জাহাঙ্গীরের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে স্থানীয়রা ধারণা করছে, তিনি ওই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। আর জাহাঙ্গীরকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করেছেন ঘোড়াঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহেন শাহ। রাফে খন্দকার শাহেন শাহ মূলত জাহাঙ্গীরকে দিয়েই টেন্ডারবাজি, জমি দখল, মাদক, পুকুর দখলসহ নানা অপকর্ম করাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব জেনেও স্থানীয় সংসদ সদস্য উপজেলা চেয়ারম্যানকে নিজ দলের লোক বিবেচনায় সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন।
গত মঙ্গলবার এবং গতকাল বুধবার সরেজমিনে ঘোড়াঘাট উপজেলা ঘুরে এসব অভিযোগের কথা জানা গেছে।
ভুক্তভোগীরা বলছে, ঘোড়াঘাটে জাহাঙ্গীর, নবীরুল ইসলাম, আসাদুল, নাহিদ, রুবেল, নান্নু ও মাসুদ রানাদের বিশাল একটি বাহিনী সক্রিয়। এই বাহিনীর প্রধান জাহাঙ্গীর ও আসাদুল। বাহিনীকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করতেন শাহেন শাহ। স্থানীয়রা জানায়, দুবার পরাজয়ের পর শাহেন শাহ এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার পেছনে রয়েছে জাহাঙ্গীর বাহিনী। নির্বাচিত হওয়ার পর এক ডজনের বেশি সরকারি পুকুর লিজ নেওয়ায় জাহাঙ্গীর বাহিনীর প্রভাব কাজে লাগিয়েছেন শাহেন শাহ।
তবে রাফে খন্দকার শাহেন শাহর দাবি, এসব অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমাকে ও সংসদ সদস্যকে জড়িয়ে যে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে, তা সঠিক নয়। এ ঘটনার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগসূত্র নেই। ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তাঁর বাবা ওমর আলীর ওপর হামলা ঘটনায় আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। প্রকৃত দোষীদের বিচার চাচ্ছি।
জাহাঙ্গীরের কর্মকাণ্ড : ঘোড়াঘাট থানা সূত্রে জানা গেছে, জাহাঙ্গীর আলমের নামে ২০০৬ সালে একটি ছিনতাই মামলা, গত মার্চ মাসের ১২ তারিখে ঘোড়াঘাট পৌর মেয়রকে হত্যার উদ্দেশ্যে একটি মামলা, গত ১৩ মে অবৈধভাবে জমি দখল, চাঁদাবাজির একটিসহ মোট তিনটি মামলা রয়েছে। জাহাঙ্গীরের সহযোগী যুবলীগের আরেক বহিষ্কৃত নেতা ইউএনও ওয়াহিদা ও তাঁর বাবার ওপর হামলার মামলায় গ্রেপ্তার আসাদুল ইসলাম এবং ৩ নম্বর সিংড়া ঘোড়াঘাট ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি মাসুদ রানার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা।
স্থানীয়রা জানায়, জাহাঙ্গীরের বাবা পুলিশে চাকরি করতেন। সরকারি দলে পদ-পদবি পাওয়ার পর জাহাঙ্গীর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এলাকায় ভূমি দখল, মাদক কারবার, জমি কেনাবেচায় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ উপজেলাজুড়ে অপরাধের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেন তিনি। শুরুতে কিছু না থাকলেও বর্তমানে তিনি গাড়ি-বাড়িসহ প্রায় ১০ বিঘা জমির মালিক।
উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে জাহাঙ্গীর বাহিনীর স্বার্থের মধ্যে রয়েছে উপজেলা চত্বরে মডেল মসজিদ নির্মাণকাজ। চেয়ারম্যান আগের মসজিদটি ভাঙার টেন্ডার পাইয়ে দেন জাহাঙ্গীরকে। কিন্তু এক দিন পরই কাজটি রানীগঞ্জ বাজারের এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেন জাহাঙ্গীর। লভ্যাংশের একটি অংশ যায় জাহাঙ্গীরের প্রশ্রয়দাতার পকেটে।
অন্যদিকে জানা যায়, উপজেলা চেয়ারম্যান রানীগঞ্জ বাজারটি নিজের নামে ইজারা না নিয়ে স্ত্রী সুরাইয়ার নামে নেন। পরে করোনার কারণ দেখিয়ে চেয়ারম্যান ইজারার টাকা কমিয়ে দিতে ইউএনও ওয়াহিদার ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। এতে সম্মত হননি ওয়াহিদা। এ সময় উপজেলা চেয়ারম্যান শাহেন শাহর কার্যালয়ে রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। নিরাপত্তার স্বার্থে ইউএনও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র অফিস থেকে সরিয়ে বাসায় নিয়ে যান। ইউএনওর ওপর হামলার কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেকে এ ঘটনাও স্মরণ করছেন।
পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ভূট্টু বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানম ও তাঁর বাবাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করার ঘটনায় যে-ই জড়িত থাকুক, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’ জিজ্ঞাসাবাদের পর ৮ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে : ঘোড়াঘাটের ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী এ পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার ও ৯ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনকে দিনাজপুর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তাঁরা হচ্ছেন মো. আসাদুল ইসলাম (৪০), নবীরুল ইসলাম (৩৮) ও সান্টু কুমার বিশ্বাস (৪২)।
গত মঙ্গলাবর বিকেলে আটক হয়েছেন পালশা ইউনিয়নের সভাপতি মইনুল ইসলাম মাস্টার। তাঁকেও ডিবি পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আটক বাকি আটজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদের পর ছাড়া পাওয়ারা হলেন যুবলীগের বহিষ্কৃত আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম, ৩ নম্বর সিংড়া ইউনিয়নের যুবলীগ সভাপতি মাসুদ রানা, নৈশপ্রহরী পলাশ, আরসোলা হেমব্রম, আসাদুলের বড় ভাই আশরাফুল ইসলাম শাওন, ইউএনওর মালি সুলতান হোসেন, সহকারী কমিশনার ভূমির ড্রাইভার ইয়াছিন আলী।সুত্র,কালের কন্ঠ
Leave a Reply