শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫২ অপরাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ রাজধানীর পল্লবী থানা হেফাজতে ইশতিয়াক হোসেন জনিকে নির্যাতনের একপর্যায়ে তিনি পানি পানি বলে অনুনয়-বিনয় করতে থাকেন। কিন্তু তাঁকে পানির পরিবর্তে থুতু দেওয়া হয়। আদালতের রায়ে এমন কথা উঠে এসেছে। আদালত বলেছেন, থানা হেফাজতে তাঁকে (জনি) যে নির্যাতন করা হয়েছে, তা ঘৃণ্য এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এসআই জাহিদের (জাহিদুর রহমান) করা এই নির্যাতন বাকি দুই পুলিশ সদস্য দেখলেও তাঁরা ভুক্তভোগীকে সহায়তা না করে অপরাধে সহায়তাকরেছেন।
গতকাল বুধবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে এক ঐতিহাসিক রায়ে পুলিশ হেফাজতে জনি নামের এক যুবককে নির্মমভাবে হত্যা করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই হচ্ছে পুলিশ হেফাজতে মামলায় মৃত্যুর প্রথম রায়। ঘটনার ছয় বছর পর গতকাল আদালত মামলার তিন আসামি—পল্লবী থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমান জাহিদ, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রাশেদুল ইসলাম ও এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টুকে (দুজন বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে এসআই) আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। একই সঙ্গে এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। তিন পুলিশ সদস্যের প্রত্যেককে বাদীপক্ষকে দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মামলার অন্য দুই আসামি পুলিশের সোর্স রাসেল ও সুমনকে সাত বছর করে কারাদণ্ডের পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালত এই রায় ঘোষণা করেন। দেশে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর অনেক অভিযোগ উঠলেও মামলা এবং বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনি হত্যা মামলায়ই হলো প্রথম রায়।
রায়ের আগে দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে কারাগারে থাকা এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ ও পুলিশের সোর্স সুমনকে আদালতে হাজির করা হয়। জামিনে থাকা একই থানার এসআই রাশেদুল ইসলামও উপস্থিত হন। আদালত তাঁদের সাজা পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। জামিনে গিয়ে পলাতক এসআই কামরুজ্জামান মিন্টু ও পুলিশের সোর্স রাসেল আদালতে হাজির হননি। এ জন্য তাঁদের দুজনের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মিরপুর-১১ নম্বর সেক্টরে বন্ধুর গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে পুলিশের সোর্সের অশালীন আচরণের প্রতিবাদ করায় ইশতিয়াক হোসেন জনি ও তাঁর ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকিকে পল্লবী থানায় নিয়ে রাতভর পেটানো হয়। জনির অবস্থা খারাপ হলে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকি ৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে মামলা দায়ের করে ছয় বছর ধরে জনির স্বজনরা বিচারের অপেক্ষায় ছিল।
এর মধ্যে হয়রানির শিকার হয় তারা। গতকালও আদালতের সামনে ন্যায়বিচারের আশায় মানববন্ধন করে স্বজনরা। শেষে রায় শুনে সন্তোষ প্রকাশ করেছে তারা। বাবার হত্যার বিচার পেতে মায়ের হাত ধরে আদালতে আসে জনির দুই শিশুসন্তানও। রাষ্ট্রপক্ষ এই ঐতিহাসিক রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে আপিল করবে বলে জানায়।
নির্মম হত্যার বর্ণনা আদালতে : দুপুর ২টায় বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। রায় ঘোষণার আগে বিচারক বলেন, থানা হেফাজতে তাঁকে যে নির্যাতন করা হয়েছে, তা ঘৃণ্য এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা জঘন্যতম অপরাধ। রায়ের সময় বলা হয়, পল্লবী থানা হেফাজতে নির্যাতনের একপর্যায়ে জনি খাওয়ার জন্য পানি চাইতে থাকেন। কিন্তু ওই সময় পানির পরিবর্তে তাঁকে থুতু দেওয়া হয়। তাই এ মামলার তিন আসামিকে এই আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ : ঢাকা মহানগর আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ‘রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হয়েছে। এ জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট। এই রায়ের মাধ্যমে বোঝা গেল, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অপরাধ করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে।’ আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, ‘এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব।
যেভাবে এলো ঐতিহাসিক রায় : আদালত ও মামলার নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ আগস্ট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের তারিখ ঠিক করেন। এ মামলায় মোট ২৪ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মিরপুর-১১ নম্বর সেক্টরে স্থানীয় সাদেক নামের এক ব্যক্তির ছেলের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান চলাকালে পুলিশের সোর্স সুমন মেয়েদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন।
এ সময় জনি ও তাঁর ভাই রকি মেয়েদের উত্ত্যক্তকারী সুমনকে চলে যেতে বলেন। সুমন চলে গেলেও পরদিন এসে আবার আগের মতো আচরণ করতে থাকেন। তখন জনি ও তাঁর ভাই তাঁকে চলে যেতে বললে সুমন পুলিশকে ফোন করেন। পরে পুলিশ এসে দুই ভাইকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। তাঁদের নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন ধাওয়া দিলে পুলিশ গুলি ছোড়ে। পরে থানায় নিয়ে জনিকে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে জনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকি ৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনার পর ওই বছরের ৭ আগস্ট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে নির্যাতন ও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে পল্লবী থানার ওসি জিয়াউর রহমানসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন জনির ছোট ভাই রকি। আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম মারুফ হোসেন পাঁচজনকে অভিযুক্ত ও পাঁচজনকে অব্যাহতির সুপারিশ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্তকালে এএসআই রাশেদুল ও কামরুজ্জামান মিন্টুকে নতুন করে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কামরুল হোসেন মোল্লার আদালত পল্লবী থানার এসআই জাহিদ, এএসআই রাশেদুল, এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টু, সোর্স সুমন ও রাশেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে আসামিদের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন। অভিযোগ গঠনের পর প্রায় সাড়ে চার বছরে এই মামলার বিচারকাজ শেষ হয়।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে ‘পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইন’ প্রণয়ন হয়। এর পর থেকেই আইনটি বাতিল ও সংশোধন চাওয়া হচ্ছিল পুলিশের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে বেশ কিছু মামলাও হয়েছে।
Leave a Reply