সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩২ অপরাহ্ন
আকতার ফারুক শাহিন॥ করোনার ভয়ে ঘরবন্দি মানুষের মাঝে বিরাজ করছে নানা শঙ্কা। কাজ না থাকায় অতিদরিদ্ররাও পড়েছেন বিপাকে। এ বিপদেও তাদের পাশে নেই বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি। সংসদ সদস্য, মেয়র থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার সবারই একই হাল।
এমপিদের দুই-একজন ঢাকায় বসে ভিডিও কনফারেন্সে দলীয় নেতাদের সান্ত্বনা দিলেও সাধারণ মানুষের পাশে থেকে তাদের সহায়তা করতে দেখা যাচ্ছে না। কেউ কেউ আবার মোবাইল ফোন ধরা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন। অথচ এই নেতাদেরই অনেকে ভোটের সময় জনগণের জন্য জীবন দিয়ে দেয়ার ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছিলেন।
করোনা ভীতির খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঘর থেকে বের হচ্ছেন না বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের (বিসিসি) মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। তবে বিসিসির পক্ষ থেকে নগরীর ১১টি পয়েন্টে হাতধোয়া, ৩০টি ওয়ার্ডে জীবাণুনাশক পানি ছিটানো এবং সর্বশেষ সোমবার থেকে দরিদ্র মানুষদের ১০ কেজি চাল, ৫ কেজি আলু এবং ২ কেজি করে ডাল বিতরণ করা হলেও মেয়র সাদিকের দেখা মিলছে না। ফোনেও সাড়া নেই।
উদীচী বরিশালের সভাপতি সাইফুর রহমান মিরন বলেন, ‘দেশের অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনের মেয়ররা জরুরি সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি নিজেরা সশরীরে সাধারণ মানুষের খোঁজখবর নিচ্ছেন। গাজীপুরের মেয়র তো করোনা পরীক্ষার কিট ও মাস্ক পর্যন্ত আমদানি করেছেন। তারা প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের খোঁজখবর নিচ্ছেন। সেখানে আমাদের মেয়র-কাউন্সিলররা একেবারে ঘরবন্দি- এটা সত্যিই দুঃখজনক।’ এ নিয়ে কথা বলার জন্য মেয়র সাদিককে বহুবার ফোন এবং খুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া দেননি।
বরিশাল-১ আসনের এমপি পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদায় পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর নির্বাচনী এলাকায় তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলছে সহায়তা প্রদান। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত চিকিৎসকদের জন্য পিপিই পাঠালেও দেখা নেই বরিশাল-২ আসনের এমপি শাহে আলমের। চলমান পরিস্থিতিতে দরিদ্র মানুষের সহায়তায় তিনি কিছু করেছেন এমন নজির নেই। সর্বশেষ কবে এলাকায় এসেছেন বরিশাল-৩ আসনের জাতীয় পার্টির এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপু তা বলতে পারেননি কেউ।
বাবুগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মকিতুর রহমান কিসলু বলেন, ‘এমপি ঢাকায় অবস্থান করছেন প্রায় এক বছর হল। তার পক্ষ থেকে এলাকায় মাস্ক বিতরণ এবং হাতধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে দরিদ্র মানুষের সহায়তায় এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’ একই পরিস্থিতি বরিশাল-৪ আসনের এমপি পঙ্কজ দেবনাথের। গত ১৮ মার্চ পর্যন্ত তিনি ছিলেন এলাকায়। এরপর থেকে ঢাকায়।
তার পক্ষ থেকেও এলাকায় এখন পর্যন্ত দরিদ্র মানুষের জন্য কোনো সহযোগিতা করার খবর মেলেনি। এছাড়া বরিশাল-৫ আসনের এমপি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামিম এবং বরিশাল-৬ আসনের এমপি জাতীয় পার্টির নাসরিন জাহান রত্না আমিনের পক্ষ থেকে তাদের এলাকায় চাল-ডালসহ নিত্যপণ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে দরিদ্র মানুষের মধ্যে।
ভোলা জেলার ৪টি নির্বাচনী এলাকার মধ্যে সদরের এমপি সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের উদ্যোগে খাদ্য সহায়তা দেয়ার জন্য রোববার সভা করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। এলাকায় না থাকলেও দরিদ্র মানুষের মধ্যে সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন ভোলা-২ এবং ভোলা-৩ আসনের এমপি আলী আজম মুকুল ও নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন। ভোলা-৪ আসনে করোনা পরিস্থিতিতে ‘মানুষ মানুষের জন্য’ কর্মসূচি চালু করেছেন জাতীয় সংসদের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এমপি আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব।
দরিদ্র মানুষের মধ্যে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিতরণে ব্যক্তিগতভাবে তিনি চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন ২৫ লাখ টাকা। এলাকায় না থাকলেও ঝালকাঠি সদর আসনে আওয়ামী লীগের এমপি সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর নামেই সাহায্য সহযোগিতা করছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খান সাইফুল্লাহ পনির বলেন, ‘এখানে জনসেবামূলক কর্মকাণ্ড যাই হয় আমাদের নেতা আমু ভাইয়ের নির্দেশেই হয়।’
বহুদিন এলাকায় আসেন না ঝালকাঠি-১ আসনের এমপি বিএইচ হারুন। দরিদ্র মানুষের জন্য তার পক্ষ থেকেও কাঁঠালিয়া-রাজাপুরে দেয়া হয়নি কোনো সহায়তা। নির্বাচনী এলাকাতেই আছেন বরগুনা সদর আসনের এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। তবে তার মুখ দেখেন না কেউ। মাঝে একবার ১৫ মিনিটের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে ডিসি অফিসে গিয়ে সরকারি ত্রাণ সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেই আবার ফিরে গেছেন বাসায়।
দরিদ্র মানুষের সহায়তায় কোনোকিছু দিয়েছেন এমন নজির নেই। বরগুনা-২ আসনের এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমনও আছেন একই লাইনে। এলাকায় যেমন নেই তেমনি দেননি নির্বাচনী এলাকার কোনো দরিদ্রকে কোনোরকম সহায়তা।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে জেলার সব উপজেলায় দরিদ্র মানুষকে নিত্যপণ্য সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন পিরোজপুর সদর আসনের এমপি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম। পিরোজপুর-২ আসনের এমপি সাবেক মন্ত্রী জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তার পরিচালিত দুস্থ কল্যাণ সমিতির আওতায় সহযোগিতা দিচ্ছেন দরিদ্র মানুষকে। পিরোজপুর-৩ আসনের এমপি জাতীয় পার্টির রুস্তুম আলী ফরাজী ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সহযোগিতা দেননি।
সশরীরে এলাকায় থেকে সাধারণ মানুষকে সহায়তা দিচ্ছেন পিরোজপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন মহারাজ। জেলার সব উপজেলায় নিজে গিয়ে সাধারণ মানুষের খোঁজখবরও নিচ্ছেন তিনি। এলাকায় থাকলেও ঘর থেকে বের হচ্ছেন না পটুয়াখালী সদর আসনের এমপি সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়া। দরিদ্র মানুষের সহায়তায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখন পর্যন্ত কোনো কিছু করার নজির নেই তার। একই পরিস্থিতি পটুয়াখালী-২, ৩ এবং ৪ আসনের এমপি আ স ম ফিরোজ, শাহজাদা সাজু এবং মহিব্বুর রহমান মুহিবের। তিনজনের কেউই নেই এলাকায়।
দরিদ্র মানুষের সহায়তায়ও নেই কোনো ব্যক্তিগত উদ্যোগ। পটুয়াখালীর বাউফল পৌরসভার মেয়র জিয়াউল হক জুয়েল এলাকায় থেকে সাধারণ মানুষকে নানাভাবে সহায়তা করছেন। একইভাবে এলাকায় থেকে দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করছেন কলাপাড়া পৌরসভার মেয়র বিপুল চন্দ্র হালদার, কুয়াকাটা পৌরসভার বারেক মোল্লা এবং আমতলী পৌরসভার মেয়র মতিউর রহমান।
তবে সংসদ সদস্যরা উপস্থিত থাকলে এবং তাদের নিজস্ব উদ্যোগে সহায়তার ব্যবস্থা নিলে চরম এ বিপদের সময় সাধারণ মানুষ আরও সাহস পেতেন বলে মনে করছেন সবাই। বরিশাল নাগরিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘চরম এ বিপদের সময় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এভাবে লুকানো সত্যিই দুঃখজনক। যেখানে ডিসি-ইউএনওসহ সরকারি কর্মকর্তারা সরাসরি মাঠে নেমে কাজ করছেন, সেখানে এমপি-মন্ত্রীদের সমস্যা কোথায়?
নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তারা ঠিকই সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারতেন। কিন্তু এভাবে মানুষের চরম বিপদের সময় তাদের কাছে না গিয়ে লুকিয়ে থেকে তারা কী প্রমাণ করলেন- সেটা তারা যেমন জানেন, তেমনি সাধারণ মানুষও জানল।’সুত্র,দৈনিক যুগান্তর
Leave a Reply