বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪১ পূর্বাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অচেতন হয়ে পড়লেও কোনো ডাক্তারের দেখা মেলেনি। খবর পেয়ে সেখানে যান একজন নার্স। তিনি গিয়ে অবস্থা খারাপ দেখে তাঁকে বাইরের হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন। এরপর তাঁকে পাঠানো হয় গাজীপুরের হাসপাতালে।
কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছার আগেই তিনি মারা যান। অথচ কারাগারে কোনো বন্দি অসুস্থ হয়ে পড়লে সর্বোচ্চ ২০ মিনিটের মধ্যে একজন চিকিৎসকের তাকে দেখে চিকিৎসা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। অথচ বাস্তব চিত্র হচ্ছে, গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলেও অনেকের ক্ষেত্রে ২০ ঘণ্টায়ও মেলে না চিকিৎসকের দেখা। নার্স ও ওষুধভাণ্ডারের দায়িত্বরতাই তখন তাদের ওষুধ দেন।
লেখক মুশতাকের মৃত্যুর পর দেশে এ নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে, আর বেরিয়ে আসছে কারাগারে থাকা বন্দিদের চিকিৎসার করুণ চিত্র। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের ৬৮টি কারাগারে ৮৫ হাজারের বেশি বন্দি রয়েছে, যাদের মধ্যে ৪০ বছরের বেশি বয়সের বন্দির সংখ্যা অন্তত ৪০ হাজার। তাঁদের বেশির ভাগই নানা রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত। এত এত বন্দির চিকিৎসার জন্য কারাগারে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনে মাত্র সাতজন চিকিৎসক রয়েছেন। অথচ পদ রয়েছে ১৪১টি। এ ছাড়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ১০৫ জন চিকিৎসক সংযুক্ত রয়েছেন, যাঁদের প্রয়োজন হলে ডেকে আনতে হয়। তাঁরা সপ্তাহে দু-এক দিন কারাগারে গিয়ে চিকিৎসা দেন।
জানা গেছে, ঢাকার কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৭২ শয্যার একটি হাসপাতাল রয়েছে। পুরো হাসপাতালই রোগীতে পরিপূর্ণ। অথচ এই হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য রয়েছেন মাত্র দুজন চিকিৎসক। তাঁদের আবার আউটডোরেও চিকিৎসা দিতে হয়। কারাগারটিতে নতুন একটি রেডিওলজি মেশিন আনা হয়েছে। কিন্তু সেটি চালানোর জন্য নেই কোনো রেডিওলজিস্ট। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আউটডোরে তিন-চার শ রোগী দেখতে হয় একজন ডাক্তারকে। তাঁকে সহযোগিতা করেন দুজন ডিপ্লোমা নার্স ও একজন ফার্মাসিস্ট। প্রতিদিন লাইনে এত রোগী দেখার কাজে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না দুজন ডাক্তারের পক্ষে। রোগীর ভিড়ে অসহায় পড়েন তাঁরা। রোগীদের গালাগালও শুনতে হয় তাঁদের।
৬৮ কারাগারে যে সার্বক্ষণিক সাতজন চিকিৎসক রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কেউই হৃদরোগ বা স্নায়ুরোগ বিভাগের চিকিৎসক নন। অথচ কাগারাগারগুলোতে প্রায়ই বন্দিরা হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে থাকে। মানসিক চিকিৎসা দেওয়ার চিকিৎসক নেই। শুধু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই বর্তমানে ২২ জন মানসিক রোগী রয়েছে।
এক চিকিৎসক জানান, সারা দেশের যত কারাগার রয়েছে, সেসব কারাগারের বন্দিদের উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রথমেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর তাঁরা তাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের হাসপাতাল বা প্রয়োজন হলে পাঠান বাইরের হাসপাতালে। প্রতিদিন দেশের অন্যান্য কারাগার থেকে দেড় থেকে দুই শ বন্দি রোগীকে পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ফলে এত রোগীর চাপ সামলাতে গিয়ে দুজন চিকিৎসককে হিমশিম খেতে হয়।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান শুভ বলেন, ‘আমরা যে চিকিৎসা দিচ্ছি তাতে একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি সন্তুষ্ট নই। কারণ এত রোগী যে তাদের কথা শুনে-বুঝে চিকিৎসা দেওয়া সত্যিই দুরূহ।’ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়।’ আরেক চিকিৎসক জানান, একটি উপজেলা কমপ্লেক্সে ৩১ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসক থাকেন ১৮ জন। আর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৭২ শয্যার হাসপাতালের জন্য চিকিৎসক মাত্র দুজন।
কারা অধিদপ্তরে সার্বক্ষণিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সাতজন চিকিৎসকের মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় করাগারে রয়েছেন দুজন, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেট কারাগারে একজন করে রয়েছেন। অন্য কারাগারগুলোতে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক নেই। এমনকি কাশিমপুরে মহিলা কারাগারসহ চারটি কারাগার থাকলেও সেখানে একজনও সার্বক্ষণিক চিকিৎসক নেই বলে জানা গেছে। কারাগারের হাসপাতালে আরবিএস, ইসিজি ছাড়া আর কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থাও নেই। ল্যাব ফ্যাসিলিটিও নেই।
কারাগারে কাজ করতে অনীহা চিকিৎসকদের : এক কারা চিকিৎসক জানান, সাধারণ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে কাজ করা আর কারাগারে কাজ করার মধ্যে পার্থক্য অনেক। এখানে অনেক প্রভাবশালী বন্দি থাকেন, যাঁরা বাইরের হাসপাতালে বা কারা হাসপাতালে থাকার জন্য চেষ্টা চালান। ফলে অনেক সময় বাধ্য হয়ে চিকিৎসকদের সংশ্লিষ্ট বন্দিকে হাসপাতালে রেফার করতে হয়। কারাগারের কিছু জেলার, ডেপুটি জেলার ডাক্তারদের ওপর বন্দিকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার চাপ দিয়ে থাকেন। ফলে বন্দিকে হাসপাতালে পাঠানোর দায়টি ডাক্তারকেও বহন করতে হয়। এ ছাড়া অনেক কারা কর্মকর্তা চিকিৎসকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন, চিকিৎসা নিতে আসা বন্দিরাও গালাগাল করেন। এসব কারণে কারাগারে দায়িত্ব পালন করতে অনীহা রয়েছে ডাক্তারদের।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন সময় কারা হাসপাতালে চিকিৎসকদের যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হলেও তাঁরা নানা কারণ দেখিয়ে যোগ দিতে অনীহা প্রকাশ করেন।
প্রভাবশালীদের ঠিকই চিকিৎসার সুযোগ মেলে : সাধারণ বন্দিদের চিকিৎসা পেতে কষ্ট হলেও প্রভাবশালী বন্দিদের চিকিৎসাসেবা ঠিকই মেলে কারাগারে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারাগারগুলোতে চিকিৎসকসংকট থাকলেও প্রভাবশালী বন্দিদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নানা পর্যায় থেকে তদবির থাকে। এ ছাড়া বড় বড় সন্ত্রাসীরাও জটিল রোগী না হলেও তাদের রেফার করতে হয় বাইরের হাসপাতালে। কারা কর্মকর্তা ও চিকিৎসকদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাদের এই সুযোগ দেওয়া হয়ে থাকে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কারাগারে গেলেও কেন কারা হাসপাতালের উন্নতি হচ্ছে না—প্রশ্ন করা হলে কোনো কারা কর্মকর্তাই এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তদন্ত প্রতিবেদন জমা
মুশতাকের মৃত্যুর বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি গতকাল বুধবার বিকেলে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। সচিবের দপ্তর থেকে সেটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হবে। তদন্ত কমিটির প্রধান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. তরুণ কান্তি শিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছি।’ মুশতাকের চিকিৎসায় কারা কর্তৃপক্ষের গাফিলতি পাওয়া গেছে কি না—এই বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অন্যদিকে গতকাল বিকেলে কারা অধিদপ্তর থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আইজি প্রিজনসের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত আইজি প্রিজনস কর্নেল আবরার হোসেন। এদিকে গত রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়েছে। মুশতাকের মৃত্যু ন্যাচারাল (স্বাভাবিক মৃত্যু)। এর সঙ্গে অন্য কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।সুত্র কালের কন্ঠ
অন্যদিকে কারা পরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, ‘আমরা কোনো গাফিলতি পাইনি। আসলে ওই মৃত্যুকে (মুশতাকের মৃত্যু) স্বাভাবিক বলছি এই কারণে যে কোনো না কোনো রোগের কারণে তিনি মারা গেছেন। কী রোগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, সেটা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলেই জানা যাবে। আমাদের এখানে (তদন্তে) তাঁর মৃত্যুটা স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে।’
Leave a Reply