শনিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:৪২ অপরাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ বেসরকারি উৎপাদকদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ না নিয়েই ২০১৯ সালে সরকার সার্ভিস চার্জ বাবদ ৮ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। ২০১০ সালে এ ব্যয় ছিল ১ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। অব্যবহৃত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সার্ভিস চার্জ গত ৯ বছরে ৪০০ ভাগ বেড়েছে। এর ফলে বিদ্যুৎ খাতে অতিরিক্ত উৎপাদনক্ষমতা ও অদক্ষতা বাজেটে আর্থিক চাপ বাড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
বেসরকারি এ গবেষণা সংস্থাটি বলেছে, বিশেষত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কারণে চাপ বাড়ছে। সম্প্রতি করোনাকালীন পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের চাহিদা কমেছে এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদ্যুৎকেন্দ্র অব্যবহৃত থাকছে। কিন্তু সরকারকে বিদ্যুৎ উৎপাদনবাবদ ব্যয় ঠিকই বহন করতে হচ্ছে। ফলে সরকারের আর্থিক বোঝা আরো বাড়বে।
প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাত নিয়ে গতকাল বুধবার সিপিডির এক ভার্চুয়াল পর্যালোচনায় এসব কথা বলা হয়েছে। ভার্চুয়াল পর্যালোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদনসক্ষমতা প্রায় ৪৯.৮ শতাংশ বেশি। করোনা পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের চাহিদা কমায় এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে ৬৩.৩ শতাংশ। গত ১৭ জুন ৪৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ছিল। এর মধ্যে ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জোনে অবস্থিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বেশি। গত বছর ১৭ জুন বন্ধ থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ১৯টি। সংস্থাটির মতে, বিদ্যুতের উৎপাদনব্যয় ও বাজারমূল্যের সমন্বয়হীনতার কারণেও এ খাতে আর্থিক চাপ বাড়ছে।
সিপিডি বলেছে, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদনব্যয় কমলেও সার্বিকভাবে বিদ্যুতের উৎপাদনব্যয় বাড়ছে। গত ২০১৮ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদনব্যয় ছিল ৬.৩৩ টাকা। গত বছর এটি কমে দাঁড়িয়েছে ৬.০১ টাকা। অন্য দিকে পিডিবির ব্যয় ২০১৮ সালে ছিল ৩৮,৫৭৬ কোটি টাকা। গত বছর (২০১৯) এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৪১,২৪৫ কোটি টাকা।
পর্যালোচনায় বিদ্যুৎ খাতে আর্থিক চাপ কমাতে উৎপাদন, পরিচালন, সরবরাহ পুনঃপর্যালোচনার পাশাপাশি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ধীরে চলো নীতি গ্রহণ, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর জন্য এক্সিট প্ল্যান প্রণয়ন ও এ খাত থেকে ক্রমান্বয়ে সরে আসা, করোনায় পরিবর্তিত বিদ্যুৎচাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অব্যবহৃত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সার্ভিস চার্জ পুনর্নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়া এবং ভবিষ্যৎ সমন্বয়ের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এডিপিতে বিদ্যুৎ খাতে অগ্রাধিকার প্রকল্প চিহ্নিত করার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।
বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়ছে। বর্তমানে সরকারি খাতে ৯,৫৬৭ মেগাওয়াট (৪৮.৫ শতাংশ), আইপিপি খাতে ৬,৯১৯ মেগাওয়াট (৩৫ শতাংশ), ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ১,৯৫৮ মেগাওয়াট (৯.৯ শতাংশ) ও আমদানি ১৬০ মেগাওয়াট (৫.৯ শতাংশ) বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫৩.৫ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক, ফার্নেস অয়েল ২৫.৯ শতাংশ, ডিজেল ৯.৪ শতাংশ, কয়লা ৫২৪ মেগাওয়াট, নবায়নযোগ্য জ¦ালানি ও সৌরবিদ্যুৎ ১.৫ শতাংশ। বিদ্যুৎ খাতকে স্বাবলম্বী করার ওপর গুরুত্বারোপ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সরকারের কাছে হাত পাততে হবে না, বিদেশে পাওয়ার বন্ড ছাড়ব। তিনি বলেন, বিশ্ব পরিস্থিতি ও শিল্পায়নের পরিকল্পনা বারবার পরিবর্তন হচ্ছে। ডিমান্ড ফোরকাস্ট ধরে এগোচ্ছে বিদ্যুৎ খাত, ১০৮টি ইকোনমিক জোন হচ্ছে। চার হাজার মেগাওয়াট ক্যাপটিভ পাওয়ার ডিরেটেড ক্যাপাসিটির দুই হাজার অবসরে যাচ্ছে। পুরনো কেন্দ্র থেকে হাতে আছে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে চাহিদা রয়েছে ১২-১৩ হাজার মেগাওয়াট, এটি বাড়তি ক্যাপাসিটি নয়। বিদ্যুৎ খাতকে স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে চারটি বিষয় জরুরিÑ নির্ভরযোগ্য, সাশ্রয়ী, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা।
নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ৩০ বিলিয়ন ডলার লাগবে বলে উল্লেখ করে নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হবে। বৈদ্যুতিক গাড়ি একটা ভালো সমাধান হতে পারে। সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকতে হবে। দামের বিষয়ে ওপেন মার্কেটের জন্য বাংলাদেশের বাজার প্রস্তুত না। ২০১৫ সালের মধ্যে বড় কয়লা বিদ্যুৎ এলে দাম কমত, কিন্তু তা আসেনি। কয়লা থাকবে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট।
আলোচনায় অংশ নিয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ বন্ধ থাকছে, এটা ঠিক নয়, জ্বালানি স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকে। ফার্নেস অয়েলে প্ল্যান্টফ্যাক্টর কমে ৩২ থেকে ১৮ শতাংশে নেমে এসেছে। করোনার কারণে ডিজেলে ১৪ থেকে ১ শতাংশে নেমে এসেছে। এতে অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। সঞ্চালন, বিতরণে জোর দিচ্ছি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নেয়া হয়েছিল জ্বালানি কস্ট কম হওয়ার কারণে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিম বলেন, বেসরকারি সেক্টর এগিয়ে যাওয়া খারাপ কিছু না। সঞ্চালন, বিতরণ ও এনএলডিসির আধুনিকায়ন জরুরি। গ্রীষ্ম ও শীতে চাহিদার একটা বড় তারতম্য থাকে, চার হাজার মেগাওয়াটের মতো এটা একটা বড় সমস্যা। ডিমান্ড ফোরকাস্ট যেটা করা হয়েছে, তা খুব বেশি উচ্চাভিলাষী মনে হয়েছে, মাতারবাড়ি, পায়রা, রামপাল বাদে বাকি প্রজেক্টগুলো বাদ দেয়া উচিত। কয়লা আমদানি এক বড় ঝামেলা। এ জন্য দেশী গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়া উচিত। বছরে একাধিক দাম বাড়ানোর সুযোগ রাখাটা গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করছে না। বছরে শর্তসাপেক্ষে দুইবারের বেশি দাম বাড়ানোর সুযোগ দেয়া উচিত নয়।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের সংগঠন বিপপার সভাপতি ইমরান করিম বলেন, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট সুযোগ না থাকলে এ প্রজেক্টগুলো দাঁড়াত না, এটা বিশ্বের মধ্যে অনেক কম। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর দক্ষতা ভালো। এ জন্য এগুলো উৎপাদনের তালিকায় অগ্রাধিকার পায়। সরকার যেভাবে আশা করেছিল, সেভাবে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়েনি। এ জন্য ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহার বাড়ানো উচিত। কয়লাভিত্তিক প্রকল্প খুব বেশি প্রয়োজন নেই। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম বলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি চালু করা লাভজনক।
Leave a Reply