সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৯ অপরাহ্ন
এমকে রানা, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশাল নগরীসহ আশপাশের জেলা উপজেলায় নিখোঁজ পরবর্তী লাশ উদ্ধার ও অপহরণের ঘটনা ঘটছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারীর মধ্যেও খোদ বরিশাল নগরীতে এ ধরণের ঘটনা ঘটার কারণে নগরবাসীর মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (২৪ জানুয়ারী) রাত সোয়া ৮টার দিকে পশ্চিম কাউনিয়া এলাকা থেকে রিপন (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় অপহরণকারীরা। মুক্তিপণ না পাওয়ায় প্রায় ৪ ঘন্টা পর তাকে মারধর করে করে শীতলাখোলা এলাকায় নামিয়ে দিয়ে যায়। এছাড়া একই কায়দায় ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নগরীর বৈদ্যপাড়া এলাকা থেকে মাসুদ (৪৩) নামে আরেকজনকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায় অপহরণকারীরা একটি চক্র। তবে ভয়ে তারা কেউই থানায় অভিযোগ দেয়নি। সচেতন নগরবাসী মনে করে এ থেকে পরিত্রান পেতে হলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারী করতে হবে। আর প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারীর কথা জানিয়েছেন বিএমপি কমিশনার ও জেলা পুলিশ সুপার।
ঘটনা-১ঃ চলতি মাসের ২৪ তারিখ রাত সোয়া ৮টার দিকে কাউনিয়া মরকখোলা পোল এলাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে পশ্চিম কাউনিয়া নিবাসী রিপনকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। এরপর কাশিপুর, রায়পাশা, বৌসেরহাট ঘুরে হাতেম আলী কলেজ মাঠে নিয়েও দেখানো হয় প্রাণনাশের ভয়ভীতি। রিপন তখন বুঝতে পারে এরা ডিবি পুলিশের কেউ নয়। এমনকি গাড়িতে বসেই তাকে এলোপাতারি কিলঘুষি মারে এবং অপহরণকারীদের মুঠোফোন থেকে পরিবারের সাথে কথা বলে ৫০ হাজার টাকা দাবী করে নইলে তাকে মেরে ফেলে রাখা হবে বলে জানায়। রিপনের সাথে থাকা মোবাইল ফোনটি পূর্বেই কেড়ে নিয়ে বন্ধ করে দেয়। রিপন জানান, রাত ১১টার মধ্যেও ঘরে না ফেরায় পরিবারের লোকজন তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ করেই মুঠোফোনে কল ঢুকলেও অপরপ্রান্ত থেকে কোন কথা না বলেই ফের কেটে দেয়। এরপর রাত পৌনে ১২টার দিকে শীতলাখোলা সড়কে মাইক্রো থেকে নামিয়ে সোজা চলে যেতে বলে নইলে গুলি করা হবে বলে শাসিয়ে দেয়। এ কারণে রিপন ভয় পায় এবং তাদের গাড়ি চলে গেলেও গাড়ির নম্বর প্লেট দেখতে পারেনি বলে জানান। তিনি আারো জানান, তার সাথে থাকা ৫ হাজার টাকা নিয়ে গেছে।
ঘটনা-২ঃ গত ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নগরীর বৈদ্যপাড়া থেকে মাসুদ নামে একজনকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয় অপহরণকারীরা। মাসুদ জানান, তাকেও গাড়িতে তুলে মারধর করা হয়েছে। এছাড়া অপহরণকারীরা মাসুদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে জানায়, মাসুদকে বাঁচাতে হলে ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে। এদিকে মাসুদের বড় ভাই আ’লীগ নেতা হওয়ায় তাৎক্ষণিক বরিশাল ডিবি পুলিশের ৮টি টিমের সাথে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হন তার ভাই মাসুদ অপহরণ হয়েছে। পরবর্তীতে অপহরণকারীদের নির্দেশনা অনুযায়ী বিনয়কাঠী এলাকায় একটি বটগাছের নিচে ৪০ হাজার টাকা রেখে আসেন। ভাইয়ের জীবনের নিরাপত্তা চিন্তা করে টাকা রেখে আসলেও নজরদারী করতে পারেনি পরিবারের লোকজন। টাকা রেখে আসার আধাঘন্টা পর অপহরণকারীরা মাসুদকে নগরীর ঘোষ বাড়ির কাছে ফেলে রেখে যায়। এ সময় মাসুদ প্রচন্ড আহত ছিলেন। মাসুদ জানান, অপহরণকারীরা তার চোখ বেধে রাখায় কাউকে চিনতে না পারলেও কথা শুনে বুঝতে পেরেছেন ওই দলে নারী সদস্য ছিল।
তথ্যসূত্রে আরো জানা যায়, বরিশাল নগরী থেকে নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর খোকন সরদার নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার হয় বাবুগঞ্জ উপজেলায় পুকুর থেকে। খোকন সরকার ঝালকাঠী জেলার রাজাপুর এলাকার মৃত মনোরঞ্জন সরকারের ছেলে এবং বরিশাল নগরীর বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. মানবেন্দ্র সরকারের ছোট ভাই। খোকন সরদারও নগরীর নতুন বাজার থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন। নিখোঁজের ১৩ দিন পর গত ৭ জানুয়ারী বরিশালের মুলাদী উপজেলার চরমহেষপুর গ্রামের বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন সরদারের (৩০) লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ওই গ্রামের তালুকদার বাড়ির পিছনের চর থেকে সোমবার দুপুরে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। গিয়াসকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি নিহতের স্বজনদের। গিয়াস উদ্দিনের লাশ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মুলাদী থানার ওসি জিয়াউল আহসান। গত ২৬ জানুয়ারী পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থানার গণধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি উপজেলার নদমুলা গ্রামের আলম জোমাদ্দারের ছেলে সজল জোমাদ্দার (২৮) নামের এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। শনিবার (২৬ জানুয়ারি) দুপুরে ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়া উপজেলার বলতলা গ্রামের একটি মাঠ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। মামলার পর থেকেই সজল জোমাদ্দার নিখোঁজ ছিলেন বলে তার পরিবার জানিয়েছেন।
বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় নিখোঁজের ৩ দিন পর মহসিন হাওলাদার (৩৭) নামে এক ওষুধ ব্যবসায়ীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (১১ ডিসেম্বর) রাতে উপজেলার আন্ধারমানিক ইউনিয়নের লতা গ্রাম থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত মহসিন হাওলাদার উপজেলার লতা গ্রামের মাস্টার বাড়ির হান্নান মাস্টারের ছেলে। তিনি গত ৯ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন। এছাড়া গত এক মাসের মধ্যে বরিশালের বিভিন্ন এলাকা থেকে আটজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনযুবক, এক শ্রমিক, দুই শিক্ষার্থী ও দুই গৃহবধূ রয়েছেন। গত ৩ জানুয়ারি থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া এসব মরদেহের বেশিরভাগেরই মৃত্যুর সঠিক কোনো কারণ জানা যায়নি। আর তাই থানাগুলোতে অপমৃত্যুর মামলাই বেশি রুজু হয়েছে। সূত্রমতে- ১১ জানুয়ারি ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নিখোঁজের ৭ দিন পর যুবক রাসেলের (৩২) মরদেহ উদ্ধার করা হয় কীর্তনখোলা নদী থেকে। ১০ জানুয়ারি নলছিটিতে নিখোঁজের একদিন পর খালের পাশ থেকে হানিফ খন্দকার (৫৮) নামে এক শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ৫ জানুয়ারি উজিরপুরের জল্লা ইউনিয়নের পীরেরপাড় এলাকার ধানক্ষেত থেকে উদ্ধার করা হয় ননী বাড়ৈ (২২) নামে আরেক যুবকের মরদেহ। একই দিন বরিশালের সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীর চরআইচা খেয়াঘাট এলাকা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। যদিও পরবর্তীতে মরদেহটি নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সৈয়দ ফয়সালের (২৩) বলে শনাক্ত করেন তার স্বজনরা।
এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ প্রফেসর হাবুল বলেন, আমাদের বরিশালে কখনোই এ ধরণের কোন ঘটনা ঘটেনি। যদি এরকমটা ঘটে থাকে তবে অবশ্যই তা দুঃখজনক। এ বিষয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারী আরো বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে বরিশালের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম (বিপিএম) বলেন, কেউ নিখোঁজ হলে সাধারণত জিডি করে এবং আমাদের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে পুলিশ পরিচয়ে যদি কেউ কাউকে তুলে নেয় তাহলে তা মারাত্মক অপরাধ। তিনি বলেন, আমাদের জেলা পুলিশের মধ্যে কেউ এ দুঃসাহস দেখাবে না। তবে যদি কখনো এ ধরণের ঘটনা ঘটে তবে অবশ্যই সাথে সাথে পুলিশকে অবহিত করতে হবে। আর আমাদের প্রতিটি থানার দায়িত্বপ্রাপ্তদের এসব অপরাধের কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে এবং আমরা সব সময় সতর্ক আছি। তিনি বলেন, আমার মুঠোফোন সব সময়ই খোলা থাকে যাতে সাধারণ মানুষ আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। এ ব্যাপারে বরিশাল মেট্রোপলিটন (বিএমপি) পুলিশ কমিশনার মোশারফ হোসেন বলেন, যাদেরকে অপহরণ করা হয়েছে তাদেরকে পুলিশের কাছে অভিযোগ দিতে হবে। এছাড়া এরকম কোন ঘটনা ঘটলে সাথে পুলিশকে অবহিত করার পরামর্শ দেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশকে পোষাক পড়েই ডিউটি করতে হবে। ডিবি পুলিশ সাধারণত সিভিল পোষাকে ডিউটি করে। তবে আমাদের মেট্রো এলাকায় কখনোই কাউকে সাদা পোশাকে গ্রেফতারের নির্দেশনা দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, আমাদের কাছে যেহেতু এ ধরণের ম্যাসেজ আসছে আমাদের পক্ষ থেকে অবশ্যই কঠোর নজরদারী করা হবে।
Leave a Reply